চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কবি শাহিদ হাসানের কাব্য স্বকীয় সত্তার নিগূঢ় নিবেদন

শোয়েব নাঈম

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ২:০৫ পূর্বাহ্ণ

ভাবনার সঙ্গে ভাষার, ভাষার সঙ্গে ছন্দের ধ্বনিমাধুর্য, ভাবোচ্ছ্বাস কমিয়ে অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রবৃত্তের বুদ্ধিদীপ্ত মেধায়, টেক্সটের শিথিলতা ও অতিভাষী মাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং বোধের ক্ষিপ্রতায় লিবার‌্যাল ও হিউম্যানিস্ট ঘরানায় বিষয় ও বিন্যাসে কবি শাহিদ হাসান নাগরিক বৈদগ্ধ্যে সৃষ্টি করেছেন ‘অনার্যের ঐকিক বেদনা’ কাব্যগ্রন্থ। জীবনের অভিজ্ঞতা আর সাহিত্য পাঠলব্ধ অনুভূতির সুষ্ঠু সমন্বয়ে রিফাইন্ড করেছেন তাঁর গ্রন্থভুক্ত কাব্যপঙ্ক্তিগুলি। আবার এই কাব্যগ্রন্থের নামকরণকে যদি ম্যাটাফিজিক্যাল ফর্মে নিয়ে অন্যভাবে পয়েসি করা হয় তবে এই গ্রন্থের নামকরণের অর্থ দাঁড়ায়
“বিন¤্র সমগ্রতায়/ চিরকাল থেকে যায় অনার্যের ঐকিক বেদনা।/ কূল থেকে কূলান্তরে/ শোকের নৌকায় ভাসে হাজার কালের নির্বাচিতা।”
গ্রন্থের নামরকরণে এখানে প্রথাগত বা ফর্মাল অর্থ বুঝার ক্ষেত্রে বিষয়ের আপেক্ষিকতার চেয়ে কাব্য অনুভবের পরিমাণকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন কবি, আর মলাটের প্রচ্ছদে বিস্তৃত করেছেন কাব্য পাঠ-প্রস্তুতি ইঙ্গিতের প্রবহমানতা। গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে যেমন ধরা আছে বাবা ও ভাইয়ের মৃত্যুবেদনার সাথে মৃত্যুময় বোধে তাঁর সৃষ্টিশীলতার নির্মম মন্থন, আবার সূক্ষ্ম সহজবোধ্যে কবিতা-সূচি পাতাকে স্বকীয়তায় অর্থবোধক বাক্য বিন্যাসে “ভেতরে যাবার আগে”… নিয়মের ভেতরে থেকেই নিয়মের বন্ধনকে ছিন্ন করেছেন নতুনত্ব দিয়ে। আর কবিতার শিরোনাম রচনা আর কবিতার বিস্তৃতির মধ্যে যে পার্থক্য তা কবির ছবি ও ব্যক্তি কবির সশরীরের মতোই ভিন্নতা আছে। ৪৭টি কবিতার শিরোনামে যে পরিমাণ আবেগ আছে প্রজ্ঞার শাসনে তা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত।
পুনঃপুনঃ পাঠে আরও পাঠস্পৃহা বাড়িয়ে পাঠকের বোধের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে এবং বিপরীত অর্থের সন্ধান দেয় গ্রন্থে ব্যবহৃত অনেক পঙ্ক্তি, চিত্রকল্প ও উপমাগুলি। শাহিদ হাসানের এই কাব্যগ্রন্থ ভাবনায় জেগে উঠেছে পুরাণ এবং ইতিহাস জাগ্রতবোধের এক অসামান্য অধিকার।
“[…] মূলত তাদের ঘরে/ ধীরে ধীরে পাল-সেন,/দূরাগত শাদা আর অতিথি-মুঘল।/ জ্বলে ওঠে পলে-পলে কালো বিড়ালের অবিকলে/ লাল-সবুজের তলে জরির পোশাকে দেবতার চোখ…” (মহতী কালের কঁড়ি: পৃ­­­­­­ষ্ঠা ৯)
জীবনকে বিশেষ ক্যাটাগরিক্যাল ধারণায় উপলব্ধি করাতে সমগ্রগ্রন্থে কয়েকটি বিশেষণ পদের পুনঃপুনঃ ব্যবহারকে প্রশস্ত করেছেন। যেমন ‘সবুজ’ ; ‘অবিকলে’; ‘ঝিমঝিম’; ‘অযুত-নিযুত’; ‘ডোরাকাটা’ … ইত্যাদি।
সত্তাকে স্বকীয় করার লক্ষ্যে কালের বিচারে ও মনোগাঠনিক দিক দিয়ে আকুতি করেছেন যেন অস্তিত্বের ধারাবাহিকতায় স্বীয় বিশিষ্টতায় নামপদের ভিন্নতায়, সত্তার নিগূঢ় নিবেদনে ‘এক’ করাই কবি শাহিদ হাসানের মনে হয়েছে তা সত্যের’ই লড়াই। যেমন
“[…] অথচ সাঁঝের আগে আঁচলের প্রবল পবনে
নিভে যায় সবকিছু,/ সরে গেলো একে-একে/ কতগুলো কাঁচা-পাকা অতীত-মনন।/ তখন হয়েছে মনে হেমন্তের উজাড় বাগানে/ হয়তোবা আমি কোন/ নব-বসন্তের এক শাহিদ হাসান…”
(একা ও একক: পৃষ্ঠা ১১) ।
পরোক্ষভাবে উল্লেখিত বিষয় এল্যুয়েশান (ধষষঁংরড়হ) এর প্রভাব ও প্রযতেœ চিত্তের এক প্রসারতায় অপূর্ব নির্মাণে শাহিদ হাসানের কিছু পঙ্ক্তিতে ইঙ্গিত ও ইশারায় কবিচেতনার উন্মেষ ঘটেছে
“[…] কাঁটা চামুচের এই খোঁচার পরশে/ সবতো গিয়েছি ভুলে।/ তবুও হয়-না শেষ, / যাবতীয় খেয়ে মাতাল ইঁদুর…” (হয়তো নিলাম হবে: পৃষ্ঠা ১৩) ।

প্রতীক দ্বারা চিহ্নিত করা এমব্লেম (ঊসনষবস) পঙ্ক্তিও আছে এই কাব্যগ্রন্থে । যেমনÑ
“[…] বেড়ালের অবিকলে/ নামে অতি ধীরলয়ে ডোরাকাটা কাসর-আঁধার।/ শোকের চাদর পরে কঠিন-কর্কশে/
ডেকে যায় অবিরাম, কার্ণিশে-কার্ণিশে…” (ভরা নদীটির পাড়ে নতুন বারতা: পৃষ্ঠা ২০) ।
প্রকরণের মাধ্যমে আকৃতিপ্রদানের অভিপ্রায়ে আর চিত্রকল্পের ভিতর দিয়ে ঘটনাকে অনুসন্ধানার্থে ফিগারেশানধর্মী কবিতাও সৃষ্টি করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে “সিঁড়ির ওপর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে/ রক্তমাখা বৃক্ষ,/চোখ মেলে চেয়ে থাকে আগত অন্ধকারের দিকে…” (সিঁড়ির ওপর: পৃষ্ঠা ২৫)।
কবি শাহিদ হাসান কাব্যবোধ ও তাঁর যাপনের মধ্যেকার নিহিত সম্পর্কের অনুসর্গে ‘অসীম প্রত্যয় দীপ্ত ভাটির গোলাপ’ কবিতায় ৫৬ পৃষ্ঠা থেকে শেষ পৃষ্ঠা ৬৪ পর্যন্ত ১৭৭ লাইনের আখ্যানে টেনে এনেছেন নিজের সামাজিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, ইতিহাসবোধের বিস্তর অভিজ্ঞতা। আর এই কবিতাটি ৮টি অনুচ্ছেদের নিবিষ্টতায় যেন-বা তিনি দাঁড়িয়ে আছেন পোডিয়ামে, আর কবি প্রবল আত্মবিশ্বাসে নিজের মতগুলি জানিয়ে দিচ্ছেন সামনে বসে থাকা শ্রোতাম-লীদের সাথে। এ যেন একজন কবি নিমন্ত্রণ করে শ্রতাদের তাঁর নিজের ভিটায় নিয়ে যাওয়া, তাঁর শেষ-হয়ে-যাওয়া এবং এখনো-শেষ-না-হওয়া ভাটি অঞ্চলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দোলাচল ও ভঙুর অনুভূতি পর্বে পর্বে ভাগ করে করে কবিতার খতিয়ান পাঠ করছেন। এই বয়ানের মাধ্যমে কবি তাঁর কাব্যভাষাকে নানা দিক থেকে ভেঙে প্রচলিত আধুনিক কাব্যধারাকে স্থানচ্যুত করার একটি অবিরাম চেষ্টা করেছেন। যেখানে তিনি প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে উদ্যোগ নিয়েছেন কৃষিনির্ভর ভাটি অঞ্চলের নিজস্ব কাব্যভাষা প্রদর্শনের—
“ […] তোমাকে দাঁড়াতে হবে বিরূপ পবনে।
প্রয়োজনে কড়া নাড়ো
তামাটে অরুণ-বীর রাবণের ঘরে।
সাথে রবে চিরকাল চেতনার প্রতীলতা আর
অসীম প্রত্যয় দীপ্ত
হৃদয়ের অনুগত সূর্য কুমারের সাথে ভাটির অর্জন।
তাদের কারণে
থেমে যাবে একদিন
দূরাগত শাদা-কালো বাঘের গর্জন।” (পৃষ্ঠা ৬৪)

শেয়ার করুন