চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

বিষণœ সকাল

আজাদ মন্ডল

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ২:০৫ পূর্বাহ্ণ

মাঘের শেষ দিকের ঝলমলে সকাল। কমলালেবুর কোয়ার মতো সূর্য দেবের আলো। রাস্তার খুঁটিতে জড়ানো অসংখ্য অগোছালো তার আর জানালার প্রটেকশন গ্রিলে বাঁধা পেয়ে সূর্য আলোয় চাঁদের কলঙ্ক। আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তারপরও হালকা শীতে লেপের নিচে থাকার আরাম ব্যহত হয় বুয়ার রান্নাঘরের টুংটাং শব্দে কথায় হাসি আর গানে। প্রতিদিনই হয়। তবে, আমার না থাকলেও সবার ছুটির দিন নিজের মনে হয়। সেই রেশে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে মনে সায় দেয় না। কিন্তু, সেই আরাম বা আলস্য বুয়া ঠিক বুঝতে চায় না। কিংবা তার হয়তো মনে থাকে না। সে টুংটাং শব্দের সাথে সারাক্ষণ একমনে নিজে নিজে কথা বলে কখনো হাসে কখনো বা গানের সুরে সুরে কাঁদে। তার মনোজাগতিক উতাল-পাতাল আসলে যে কী সেটা বুঝা যায় না। বাঁধা বা বলে কয়েও কাজ হয় না। বড়জোর একদিন বন্ধ করা যায়। কিন্তু, তৃতীয় দিন থেকে যেই লাউ সেই কদু অর্থাৎ তার মুদ্রদোষের বাদ্যবাজনা শুরু হয়। অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের দশজনের মেস মেম্বারের একই। ফলে, বিষয়টা পড়েছি মোড়লের হাতে খানা খেতে হবে সাথে এই প্রবাদের রেশে প্রায় প্রত্যেকেরই সয়ে গেছে। আরো বাড়িয়ে বললে বুয়া একদিন না আসলে তার মুদ্রাদোষের জন্যই বেশির ভাগ মেসমেম্বার একটা কিছুর শূন্যতা ফিল করে। সকলের সূর্যোদয়ের সাথে রিলেটেড বাইরের অসংখ্য হাঁকডাক ভ্যা-পু শব্দ লাগে লবণ ছাড়া তরকারির মতো। সেদিন কারো কারো অফিস যাওয়া লেটও হয়ে যায়।
আমার অফিস আদালত নাই। লেখাপড়া শেষ করে আছি চাকরি নামক সোনার হরিণের দেনদবারে। ওতোটা চাপও নাই। মাথার ওপর ছায়া হিসেবে আছে বিদেশে চাকরিরত বড়ভাই। তাতে করে, যান্ত্রিক আর শাব্দিক নগরে সকালে কমলার কোয়ার মতো সোনা রোদের আলো মানবসৃষ্ট বাঁধায় কলঙ্কিত হলেও তা মনের সুখে গায়ে মাখি। অভিজ্ঞতা কুড়িয়ে বেড়াই এই ঘিঞ্জি নগরীর তৃণমূল মানুষের অন্তঃকোণের শষ্যক্ষেতের। তাতে, কখনো পেয়ে যাই সাহারার মরুভূমির অনন্ত হাহাকার আবার কখনো আরাধ্য সুখ মিলে মরুভূমির বুকে অচীন বৃক্ষের ছায়ার মতো। আমার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান বাড়ে। আমি সামাজিকভাবে শিক্ষিত হওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু, কোন এক অজানা তাড়াহুড়োয় আমাদের বুয়াযুগী ভিক্ষা এখনো পায় নাই অর্থাৎ তার মর্মমূলের সুখ-দুখ হিসেবের অংক এখনো আমার কষা হয় নাই। আজ না কাল, এভাবে কখনো মুগ্ধ আবার কখনো বিরক্ত হয়ে কেবল তার মুদ্রদোষের পিঠে কান রেখে চলেছি।
বুয়ার তালবেতাল মনোগত আবেগ আর মেসমেম্বারদের কর্পোরেট তাড়াহুড়োয় আমি সকালবেলা সাধারণত বাইরে বেড়িয়ে পড়ি। তাতে করে, দুই ধরনের লাভ হয়। এক. বাথরুমের চাপ একজনের হলেও কমে, দুই.বাইরের রাস্তায় কর্মজীবী মানুষের ¯্রােত দেখা যায়। এই তৃণমূল মানুষের তো আর শুক্র-শনি নাই। তাদের সাথে হাঁটা যায়। কথা বলা যায়। যা এক মনোগত আনন্দ বা গভীর কিছু ভাববার শিক্ষা পাই।
অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান হোক আর রুমমেটদের কর্পোারেট ঝামেলা এড়িয়ে চলা হোক, রুম থেকে বের হয়ে গেটের দারোয়ানের প্রতিদিন কর্মলিপির ব্যতিক্রম চোখে পড়ে প্রথমে প্রথম শ্রেণ্রির ধাক্কা খেলাম। তার কানে হেডফোন গোঁজে মোবাইল ফোনে কথা বলা নাই! তার বদলে সে বসে আছে বিষণœ মুখে মাথায় মাফলার জড়িয়ে? এটা কী করে সম্ভব? পূর্বে তাকে যতবারেই দেখেছি ততবারই ফোনে কথা বলা অবস্থায়। কৌতূহল কম হয়নি। পঞ্চাশোর্ধ একজন মানুষ সারাক্ষণ ফোনে কথা বলে কার সাথে? আর এতো কিসের কথা? এই কথা বলার জন্য সে মালিকের প্রায় প্রতিনিয়তই বকাঝকা খায়। একদিন তো এও শুনলাম ‘মিয়া এই বয়সে আজাইরা পীড়িত বাদ দিয়া ঠিক মতো ডিউটি করেন, চাকরি চইলা গেলে ফোনে ইটিস পিটিস পাছার মধ্য দিয়া বার হইবো।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা! পরের দিন থেকেই দারোয়ান কানে হেডফোন গুঁজে শুরু করে আগের মতো কথা বলা। বুয়ার মুদ্রদোষের মতো দারোয়ানের ফোনে কথা বলার ব্যাপারটাও দীর্ঘদিনের হেতু আমার মগজে গেঁথে গেছে। আজকে তাকে কথা না বলতে দেখে সকালটা ঐ লবণ ছাড়া তরকারির মতোই মনে হলো। মনে হলো গ্রাউন্ড ফ্লোরের পুরো জায়গাটা সূর্যেরআলোর জন্য নয় দারোয়ানের ফোনে কথা না বলার শোকে অন্ধকার, কিছুটা হলেও অসুখী।
দারোয়ানের সামনে যাওয়ার আগেই গেটের বাইরে হট্টগোলের শব্দ শুনে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। সরু গলির রাস্তা বিপরীতমুখী দুই রিকশার সংঘর্ষে চালকদ্বয়ের মধ্যে বিশ্রি ভাষায় গালাগালি। পাশদিয়ে মেইন রোডের দিকে কর্মজীবী মানুষের আষাঢ়ের মেঘের মতো ঢল। পাশে দাঁড়িয়ে তিনটি কুকুর উপর দিকে মুখ তুলে অনবরত ঘেউ ঘেউ করছে। কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে রিকশচালকদ্বয়ের উচ্চস্বরে একে অপরের দোষারোপের জন্য নয়। ওরা ঘেউ ঘেউ করছে সামনে একতলার ছাদে একটি বানর দেখে। আমিও প্রতিদিন ঐ একটি বানরকে দেখি। কোথা থেকে বানরটি দলছুট হয়ে এই গাছপালাহীন কংক্রিটের শহরে এসে পড়েছে কে জানে? তবে, কুকুরগুলোর তাতে দোষ দেওয়া যায় না। ওরা অনেক কাল আগে থেকেই মানুষের মাঝে বসবাস করার কৌশল শিখে নিয়েছে। কিন্তু বানররা তো এখনও সেই অভিযোজন ক্ষমতা আয়ত্ব করতে পারেনি। এই কুকুরদের এলাকায় সে অহেতুক।
রিকশাওয়ালাদের বিপরীতমুখী গালিগালাজ নতুন মনে হলো না। এই ধরনের ঝামেলা প্রায় ঘটে। অসংখ্য রিকশা অসংখ্য রিলশাচালক সেই তুলনায় সরু আবার অসংখ্য খানা খন্দকে পুরো রাস্তার শরীর। ফলে, হিসেবের কথা রিকশায় রিকশায়, রিকশায় গাড়িতে সংঘর্ষ কপালের লিখন না, হবেই। তবে সুখের কথা এইসব ঝগড়া ফ্যাসাদ কুকুরদের ঘেউ ঘেউ-র মতোই বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কুকুরদের যেমন রাস্তার মানুষ হুস হুস বা ঢিল মেরে তাড়িয়ে দেয়। রিকশাচালকদেরও তেমনি মানুষ মধ্যস্থ করে কখনোবা নিজেদের তাগিদেই সরে পড়তে হয়, তা না হলে পিছনে লেগে যায় বিশাল বহরের জ্যাম।
আমি উজানমুখী মানুষের ঢলে মিশে কিছুক্ষণ হাঁটলাম। আজ খুব একটা স্বস্তি পেলাম না। হতে পারে বুয়াকে নিয়ে বেশিক্ষণ চিন্তা-ভাবনা নতুবা গেটের দারোয়ানের ফোনে কথা না বলতে দেখা এই অস্বস্তির কারণ। মেইনরোড পর্যন্ত যাওয়া হলো না। গলির মোড়ের এক কোনায় ছোট টেবিল বসিয়ে এতিমখানার জন্য মাইক দিয়ে টাকা তোলা হচ্ছে, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখানে কিছুটা ভালো লাগল। সেটা হতে পারে, হুজুরদের টাকা চাওয়ার সুর শোনে নতুবা কিছুক্ষণ বলার পর যে গজল (‘ওরে ও মাঝি, তুই হেলা করিস না, ছেঁড়ে নৌকা আমি যাবো মদিনা’) সেটা শোনে কি না তা বুঝা গেলো না। তবে, স্বস্তি পেলেও মুক্তি পেলাম না, গজলের কথা অনুযায়ী পাল তোলা নৌকায় কী সেই আরব দেশে যাওয়া সম্ভব? অন্তকোণে প্রশ্নের অস্বস্তি ঘনিভূত হওয়ার আগে বিদায় নিলাম। এখন কোন প্রশ্ন হুজুরদেরকরা যাবে না। সারাদিনের মধ্যে সকালবেলাটা ওনাদের টাকা কালেকশনের মোক্ষম সময়। এসময় ডিস্টাব করাটা ঠিক হবে না।
আরেকটু এগুলেই চোখে পড়ল ইলেকট্রিক খুঁটির গোড়ার এক ক্যানভাসারকে। ভ্যানের উপর নানা রকম ওষুদের ডালি সাঁজিয়ে টেপরেকোডার ছেড়ে দিয়েছে, ‘ চিপায় চাপায় ঘা, হাতে রানে ঘা, চুলকাইতে চুলকাইতে যারা জীবন অতিষ্ট করে ফেলছেন তারা আমাদের প্রচারগাড়ি লক্ষ্য করে চলে আসুন, লাগিয়ে দিন এই পাগলা মলম, দুই মিনিটে চুলকানি বন্ধ।’ ‘ মাইরা ফ্যালান মাইরা ফ্যালান ছাড়পোকাগুলা মাইরা ফ্যালান, যাদের ঘরে ছারপোকা আছে তার চলে আসুন এই প্রচারমাইক লক্ষ্য করে নিয়ে যান এই ওষুদ, ছাড়পোকা জনমের মতো বিদায়।’ কথাগুলো কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনলাম তবে পাগলা মলম আর ছাড়পোকার ওষুদ কেনা হলো না। আমার চিপায় চাপায় কোন চুলকানি আর ঘরে কোনো ছারপোকাও নাই।
বাসার গেটে যখন ফিরে এলাম তখনও সামনের ছাদে বানরটা জিম মেরে বসে ছিলো। তবে কুকুরগুলো ছিলো না। বানরটির জন্য মায়া অনুভব করলাম। একটা জীবন তার চলে যাবে অথচ তার যেখানে মরার কথা সেখানে মরতে পারবে না। সারাজীবন পথ খুঁজতে খুঁজতে আর কুকুরের ধ্যাতানি খেতে খেতে চলে যাবে।
ঘোর কাটল দারোয়ানের কাশি শুনে। মুখটা তখনও বিষণœ। মালিক মনে হয় তার ফোনালাপ নিয়ে খুব করে বকা দিয়েছে। আমি কথা বললামÑ
-চাচা মিয়া ভালো আছেন?
সে একবুক হতাশা নিয়ে উত্তর দিলো-
-আর ভালো! গরীবের আবার ভালো মন্দ!
-আপনার মোবাইল কি নষ্ট হয়ে গেছে?
-হ রে বাবা, কাইল টয়লেটে পইড়া গেছিল।
-আ হা, তাইলে তো আপনার কথা বলা বন্ধ।
-হ, দুইদিন ধইরা মুখটা পাইনশ্যা হইয়া আছে।
-এতো কার সাথে কথা বলেন?
-এই প্রশ্ন সবাই করে রে বাবা। কাউরে কইবার পারি না। বহু চেষ্টা তদ্বির কইরা বুইড়া হইছে এক পোলা। হেই পোলার আবার সবসময় অসুখে ধইরা থাহে। তাই একটু খোঁজ খবর রাখি। তাই নিয়া কতজনে কতকিছু কয়।
-ও, আপনি আমার ফোন ব্যবহার করতে পারেন।
– নারে বাবা, বেতন পাইলে কিনা নিমু। দুইদিন কথা না কইলে কি হইবো।
দারোয়ানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস শুনে প্রথমের চেয়ে দ্বিগুন ধাক্কা খেলাম। তবে কী এই গলি ধরে উজানে যাওয়া কর্মজীবী প্রত্যেক মানুষের চমকে দেওয়ার মতো ইতিহাস আছে? রাস্তায় টাকা উঠনো হুজুরদের? ক্যানভাসারের রানের চিপার খবর কী? তার ঘর কী ছারপোকা মুক্ত? আর বুয়া? তার অনবরত কথা বলা হাসা গুনগুন করে গান গাওয়ার ইতিহাস কী?
বুয়ার ইতিহাস শোনার জন্য আমি দৌড়ে উপরে এলাম। কিন্তু তাকে পাওয়া গেলো না। রান্নাবান্না শেষ করে সে পরিপাটি করে সবকিছু সাজিয়ে রেখে গেছে। মেসমেম্বাররা কেউ কেউ উঠে সকালকৃত্য সাড়ছে। আমি দারোয়ানের মতো বিষণœ মুখে রুমে ঢুকলাম। কমলার কোয়ার মতো কলঙ্কযুক্ত আলোও এখন রুমে নাই। সূর্যটা একটু উপরে উঠতেই তা কোন এক বিল্ডিংয়ের আড়ালে চলে গেছে হয়তো..

শেয়ার করুন