চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

তাসলিমা খানমের ‘ছোবল’ ও ‘শিশির জলের নোলক’ প্রসঙ্গে কিছু কথা

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ২:০৫ পূর্বাহ্ণ

তাসলিমা খানমের ‘ছোবল’ বইটির উপজীব্য মুক্তিযুদ্ধ। এটি একটি স্মৃতিচারণমূলক গল্প যেখানে মুক্তিযুদ্ধের খ- খ- ঘটনার মাধ্যমে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও দালিলিক লেখা ইতিপূর্বে লেখা হয়েছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টি এমনই অনন্য যে এটি কখনো পুরনো হবে না। এটি সবসময় যুদ্ধকালীন ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহের বিভিন্নতা ও মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষার তীব্রতায় উজ্জ¦ল।
‘ছোবল’-এর গল্প মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটি সত্যিকারের গল্প। এ গল্প লেখার কারণ লেখিকা তাসলিমা খানম তাঁর বইয়ের মুখবন্ধে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহের দুঃসহ স্মৃতি তাঁকে তাড়িত করেছে এ গল্প লিখতে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সেই গল্প লিখে তিনি নিজেকে ঋণমুক্ত করতে চেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন মাতৃজঠরে। কি অপরিসীম শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা ও বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে তার মা তাকে জন্ম দিয়েছেন তা তার লেখনীতে বর্ণিত হয়েছে।
লেখিকা অত্যন্ত দক্ষতার যাথে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি থেকে শুরু করে যুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছেন। গল্পের চরিত্রগুলোকে তৎকালীন সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এমনভাবে চিত্রিত করেছেন যে বর্তমান প্রজন্মের মেয়ে ও ছেলেরা শুধু যে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধে সশরীরে অংশগ্রহণ করতে না পারার মনঃকষ্টে ভুগতে পারে। গল্পে ব্যবহৃত ভাষার অলঙ্কার মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে ছবির মতো চোখের সামনে চিত্রকল্প রচনা করেছে। ভাষার এই শক্তিশালী ব্যবহার বইয়ে বর্ণিত ঘটনাসমূহের আবেগকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতেও সাহায্য করেছে। লেখিকা যে শব্দমালায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বর্ণনা করেছেন তা আমাকে মুগ্ধ করেছে (পৃষ্ঠা ৭১)। এ বইটি পড়তে গিয়ে সংবেদনশীল পাঠক মনের অজান্তেই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গল্পের ভেতরে প্রবিষ্ট হয়ে যেতে পারেন।
পরিশেষে বলব ‘ছোবল’-এর গল্প আমাকে ভীষণভাবে আবেগাপ্লুত করেছে কারণ গল্পটি সত্য। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য লেখিকার মুক্তিযুদ্ধের এ গল্প লেখার উদ্দেশ্য সার্থক হয়েছে বলেই আমার মনে হয়। একজন গুণমুগ্ধ পাঠক হিসেবে আমি লেখিকা তাসলিমা খানমের মঙ্গল কামনা করি এবং তাঁর কাছে আরও নতুন লেখার প্রত্যাশা করি।
বই : ছোবল
লেখক : তাসলিমা খানম
বিষয় : মুক্তিযুদ্ধ
প্রকাশক : সমগ্র প্রকাশন
‘শিশির জলের নোলক’ উপন্যাসটি একদিকে যেমন নৈতিক বিশুদ্ধতার প্রতীক অন্যদিকে এখানে বর্তমান সমাজের নৈতিক স্খলনের প্রতি প্রচ- ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। গল্পটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মূলধারা থেকে বিচ্যুতি ঘটেনি একটুও।
ছেলেবেলায় আমরা আদর্শ লিপির শেষ অংশে নৈতিক জ্ঞান অধ্যয়ন করতাম। শিশু বয়সের সেই শিক্ষা ধীরে ধীরে বিবেকের আকারে আত্ম-প্রকাশ করে আমাদের পরবর্তী জীবনে অর্থাৎ ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সমাজ থেকে নৈতিকতা ও বিবেক আজকাল অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। অন্যায়কেও নানা উপায়ে বৈধ করার প্রক্রিয়া চলছে যা লেখিকাকে দারুণভাবে পীড়িত করেছে।
নৈতিক অবক্ষয় সমাজে বৃহৎ পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারই শুধু করে না, একটি পরিবারকেও বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়। লেখিকা তার উপন্যাসে রম্যরস ও হালকা মেজাজের উপস্থাপনায় খুব সুন্দরভাবে এই বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন। উপন্যাসে কাহিনীর প্রতিটি চরিত্রকে সমান গুরুত্ব দিয়ে তিনি উপস্থাপন করেছেন।
গল্পের মূল নায়িকা অবন্তিকা যাকে ভালোবেসেছে সে পিতার কু-কর্মের জন্য লোকসমাজে ঘৃণিত। অথচ একই সাথে তাকে বিশুদ্ধতার প্রতীক ও বিবেকের ছায়া হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অর্ণব নিজেকে পরিবার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ঘৃণা আর লজ্জার কালি ছুঁড়ে দিয়েছে অন্যায় ও নীতিহীনতার বিরুদ্ধে। এইদিক থেকে গল্পের নামকরণ সার্থক হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্বলিত লেখিকার প্রথম উপন্যাস ‘ছোবল’ অত্যন্ত গুরুগম্ভীর ও ভাবনির্ভর হলেও ‘শিশির জলের নোলক’ সরল ও ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন তাসলিমা খানম। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের অগ্রগামী চলার পথে বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও সময়ের দাবি বলে মনে হয়েছে।
বই : শিশির জলের নোলক
লেখক : তাসলিমা খানম
বিষয় : সামাজিক আবেদনমূলক উপন্যাস
প্রকাশক : বাতিঘর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট