চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

একান্ত আলাপে বাউল শিল্পী ফকির শাহাবউদ্দিন

কখন যে বাউল গানের প্রেমে পড়ে যাই বুঝতে পারিনি

মরিয়ম জাহান মুন্নী

৬ নভেম্বর, ২০১৯ | ৩:১৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে কিছু বিদেশি সংস্কৃতি। তবে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি, সারি ও বাউল গান বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির। বাঙালির কাছে এসব গানের আবেদন চিরায়ত। এই বাউল গান নিয়ে এখন মঞ্চ মাতাচ্ছেন ফকির শাহাবুদ্দিন। যার জন্ম চট্টগ্রামে।

চট্টগ্রামের সন্তান বাউল শিল্পী ফকির শাহাবুদ্দিন তাঁর বাউল গানের সুরে মাতোয়ারা করেছেন বাংলার মানুষকে। শুধু বাংলার মানুষ বললে ভুল হবে। তাঁর খ্যাতি বাংলা ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও কম নয়। চট্টগ্রামের গর্ব শিল্পী ফকির শাহাবুদ্দীনের সাথে এক পড়ন্ত বিকেলে নির্মল প্রকৃতিক পরিবেশে আড্ডা হয় সিআরবির তাসফিয়া গার্ডেনে। আলাপকালে শিল্পী ফকির শাহাবুদ্দিন ব্যক্ত করেন তাঁর অনেক মধুর স্মৃতির পাশাপাশি কিছু কষ্টের কথাও।

পূর্বকোণ : কেমন আছেন?
ফকির শাহাবুদ্দিন : আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, আর ভালো আছি বলেই আজ আপনাদের সামনে।
পূর্বকোণ : বাউল শিল্পের প্রতি ভালবাসা কখন থেকে শুরু?
ফকির শাহাবুদ্দিন : এ আমার ভালোবাসার

জগত। খুব ভলোবাসি এই সঙ্গীতকে। তবে প্রথমে আমি গণসঙ্গীত করতাম। কারণ গণসঙ্গীত দেশের কথা বলে, মাটি ও মানুষের কথা বলে। চট্টগ্রামে কত মঞ্চে গণসঙ্গীত করেছি তার হিসাব বলতে পারবো না। সেই গানগুলোয় এক অন্যরকম ভালোলাগা ছিল। জানেন! গানের মধ্যে একটি অদ্ভুত বিষয় আছে। গানের মাধ্যমে আপনি একজন মানুষের মনে নিখুঁত দেশ প্রেম তৈরি করে দিতে পারবেন। আমরা যখন গান গাইতাম মানুষ দল বেঁধে গান শুনতো। আর আমাদেরও ভালো লাগতো। এভাবে কখন যে বাংলা গান, বাউল গানের প্রেমে পড়ে যাই বুঝতে পারিনি।
পূর্বকোণ : বাউল সঙ্গীতে প্রাতিষ্ঠানিক হাতেখড়ি কার মাধ্যমে?
ফকির শাহাবুদ্দিন : আমিতো চট্টগ্রামের ছেলে, আর চট্টগ্রামে তো সেভাবে বাউল শিল্পী নেই বললেই চলে। বলতে পারেন আমিই একমাত্র বাউল শিল্পী। তাই আমি এ শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করিনি। তবে ঢাকায় যাওয়ার পরে প্রায় ৯০ এর দশকে শিল্পী রুহী ঠাকুরের মাধ্যমে শাহ আব্দুল করিমের সান্নিধ্য পেয়েছি। এভাবে তার সাথে দীর্ঘ ২০বছর এ শিল্পচর্চা করেছি। এইযে ব্যান্ড, পপসহ যে সঙ্গীত আছে এগুলো বিদেশি কালচার। তাই আমি বাউল গানে আগ্রহী হয়ে উঠি।

মুলত সেখান থেকে বাউলগানের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। ’৮৫ সাল থেকে পুরোপুরিভাবে বাউলগানের সাথে জড়িয়ে যাই। কারণ আমি বরাবরই চাইতাম মা, মাটি ও দেশের গান গাইবো। এর বাইরে মেকি কিছু করবো না। আমি বাঙালি আর বাংলার নিজস্ব সম্পদ বাউল গানই আমার সব।
পূর্বকোণ : সঙ্গীত চর্চার ক্ষেত্রে পারিবারিক সহযোগিতা কেমন পেয়েছেন। কোনো বাধা এসেছে কিনা।
ফকির শাহাবুদ্দিন : আমি চট্টগ্রামে যখম গণসঙ্গীত করতাম তখন তারা জানতো খুব সাধারণভাবে। বিষয়টি সেভাবে দেখতো না। তাই এতোটা জানে বলা যাবে না। কিন্তু ঢাকায় যাওয়ার পরে যখন আমি শাহ আব্দুল করিমের সাথে গান করছি এভাবে একদিন টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠানে গান করি। সবাই আমাকে টেলিভিশনে দেখে অবাকও হয়েছে! আমি গান করছি। আমার গ্রামের বন্ধু, আত্মীয় স্বজনরা সবাই দেখে নানা প্রশ্নও করেছে। তখনই সবাই জানতে পারে আমি গান করি। তারা দেখে খুশিই হয়েছে। তাই পারিবারিকভাবে কোনো সমস্যায় পড়িনি।
পূর্বকোণ : আপনার পছন্দের কয়েকজন শিল্পীর নাম জানতে চাই। যাদের দেখে আপনি আরো বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এই বাউল সঙ্গীতে?
ফকির শাহাবুদ্দিন : যেহেতু বাউল সঙ্গীত আমাদের নিজস্ব কালচার। আর বাউল গানের অন্যতম ব্যক্তিত্ব স¤্রাট লালন শাহ। তার গান আমাকে খুব টানতো। তার গানের অর্থ বিশাল। লালন চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু তার ভক্ত যুগ যুগ ধরে জীবিত থাকবে। সেখান থেকেই আমি আরো আগ্রহী হয়ে উঠি।

পূর্বকোণ : আপনার ভালোলাগার একটি গান শুনতে চাই, যদি আপত্তি না থাকে।
ফকির শাহাবুদ্দিন : আমার অনেক ভালো লাগার গান আছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবো। তবে এই মুহূর্তে মনে বাজছে যে গানটি সেটাই চেষ্টা করছি।
‘যা দিয়েছ তুমি আমায় কি দেব তার প্রতিদান
মন মজালে ওরে বাউলা গান। আমার, মন মজালে ওরে বাউলা গান
অন্তরে আসিয়া যখন দিলে তুমি ইশারা
তোমার সঙ্গ নিলাম আমি সঙ্গে নিয়া একতারা
এখন মন মানে না তোমায় ছাড়া তোমাতে সঁপেছি প্রাণ
মন মজালে ওরে বাউলা গান।
পূর্বকোণ : আপনার নিজের সবচেয়ে কোন গানটি বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। যে গানের মাধ্যমে ফকির শাহাবুদ্দিনকে এক নামে সবাই চিনে?
ফকির শাহাবুদ্দিন : আমার গানের প্রায় সবগুলোই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তাই নির্দিষ্ট করে বলা খুব কঠিন। তবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটার নাম বলতে পারি। এই যেমন, ১.তুই যদি হইতি গলার মালা ২. আমারে আসিবার কথা কইয়া মান করে রাই, রইয়াছো ঘুমাইয়া রাধেগো-
পূর্বকোণ : বর্তমানে আপনার কয়টি এলবাম আছে?
ফকির শাহাবুদ্দিন : আমি এ্যালবাম বাহির করবো এবিষয় ততটা ভাবিনি। আমি বাউল গানকে সংগ্রহ করতে গিয়ে সারা বাংলাদেশ হেঁটেছি। তবে বর্তমানে আমার ৫টি এ্যালবাম আছে।

পূর্বকোণ : সেগুলোর মধ্যে কোন এ্যালবামটি বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে?
ফকির শাহাবুদ্দিন : আমার সবগুলো এ্যালবামই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু তার মধ্যে ‘ফকির’ এ্যালবামটি বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
পূর্বকোণ : ১ম কত সালে টেলিভিশনে শো করেছেন?
ফকির শাহাবুদ্দিন : ১৯৯৬ সালে ১ম বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রে গান করি। সময়টা ছিল বৈশাখ মাসের। তাই আমার গানটি ছিল, আইশ বন্ধু বৈশাখী গান গাইয়া, তুমি জৈষ্ঠ মাসে আইশ বন্ধু আম কাঁঠাল জাম লইয়া।
পূর্বকোণ : এখনো পর্যন্ত বাউল গানের ¯ী^কৃতিস্বরূপ কোন পুরস্কার পেয়েছেন?

ফকির শাহাবুদ্দিন : আমি গান নিজের ভালোলাগা আর ভালোবাসা থেকে করি। স্বীকৃতির লোভে নয়। তবে মরার আগে হয়তো একটি পেতে পারি।
পূর্বকোণ : আপনি ছাড়া চট্টগ্রামে পরিচিত কোন বাউল আছে কি।

ফকির শাহাবুদ্দিন : চট্টগ্রামের মত একটি জায়গায় কোনো বাউল শিল্পী নেই, এটি আমাদের জন্য সত্যি দুঃখজনক। যেখানে চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সব দিকে এগিয়ে, সেখানে বাউল গানের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগীতের অঙ্গ পুরোপুরি পিছিয়ে। আমি যে একজন বাউল শিল্পী আছি চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ছেলে, বাংলাদেশের মানুষ তাও জানে না। তারা আমাকে মনে করে আমার বাড়ি সিলেটের দিকে হবে। আমি আমার পরিচয় না দিলে মানুষ বলতেও পারে না আমার বাড়ি চট্টগ্রাম।
পূর্বকোণ : চট্টগ্রামে বাউল শিল্পী গড়ে তোলার ব্যাপারে আপনার অভিমত কি?
আমি চাই চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গন বাউল গানের দিকে নজর দিক। মনে রাখতে হবে এটি আমাদের দেশীয় কালচার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট