চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

পিঙ্ক অক্টোবর ও স্তন ক্যান্সার

ডা. নূরেন জান্নাত নওরীন

৩০ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে ব্রেস্ট ক্যানসার বা স্তন ক্যান্সার এর প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। তথ্য মতে, প্রতি একলক্ষ নারীর মধ্যে বাইশ জন নারী এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, যদিও উন্নত দেশগুলোতে এর প্রকোপ আরো কয়েক গুণ বেশি।
আমাদের দেশে অক্টোবর মাস ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা মাস হিসাবে পালিত হচ্ছে। বিভিন্ন হেলথ ক্যাম্পেইন (ঐবধঃয ঈধসঢ়ধরমহ) এর মাধ্যমে মানুষের মাঝে সচেতনতা ও দ্রুত ক্যান্সার সনাক্তাকরণের প্রচেষ্টা হচ্ছে।
সেই উদ্দেশ্য নিয়েই স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে এই কলামটি লেখা।

স্তন ক্যান্সার কাদের হয় : কার স্তন ক্যান্সার হবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না, তবে বিজ্ঞানীরা গবেষণার পর কিছু কারণ খুঁজে বের করেছেন, যেসব কারণ থাকলে এই ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। কারণগুলো হল:
(১) বয়স : বয়স বাড়ার সাথে সাথে ব্রেস্ট ক্যান্সার এর ঝুঁকি বাড়ে। ৩৫-৪০ বছরের পর থেকে এই ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এবং ২০ বছরের নিচে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ৫০/৬০ বছরের পর ঝুকি তুলনামূলক বেশি।
(২) খাদ্যাভ্যাস : যারা চর্বিযুক্ত খাবার (ঋধঃ) বেশি খেয়ে থাকেন তাদের ঝুঁকি বেশি থাকে ক্যান্সার হওয়ার।
(৩) শরীরের ওজন : যারা অনেক বেশি ওজনের অধিকারী তাদের এই রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
(৪) জেনেটিক কারণ : অন্যসব কারণ থেকে এটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমাদের শরীরে প্রতিটা জিনিসের কিছু জিন (মবহব) থাকে। এই জিনগুলোর মধ্যে কিছু ব্রেস্ট ক্যান্সার এর জন্য দায়ী। যেমন ঃ ‘ইজঈঅ-১ মবহব̕’, ‘ইজঈঅ-২ মবহব̕’,এই ২টি জিন-এর সরাসরি সংযুক্তি পাওয়া গেছে। এবং এই জিনগুলো বংশানুক্রমে দেহে সঞ্চারিত হয়। এই যাদের পরিবারের প্রথম শ্রেণীর আত্নীয় যেমন ঃ মা, নানী, খালা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন তাদের মধ্যে হওয়ার সম্ভাবনা অন্যান্যদের তুলনায় বেশী। ( ৩ থেকে ৬ গুণ বেশি)
(৫) জন্মনিয়ন্ত্রণ এর পিল : এছাড়াও, যারা জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি ঙঈচ (ঙৎধষ ঈড়হঃৎধপবঢ়ঃরাব চরষষ) কম্বিনেশানগুলো দীর্ঘদিন খেয়ে থাকেন তাদের মধ্যেও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি দেখা গিয়েছে।
(৬) ব্রেস্ট ফিডিং : যারা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ান না, তাদের মধ্যে ক্যান্সারের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি।
ব্রেস্ট ক্যান্সার একটি ভয়ানক ব্যাধি। তাই এই বিষয়ে সচেতনতা ও প্রাথমিক অবস্থায় সনাক্তকরণ ও চিকিৎসার ফলাফল ভালো হবে এবং আয়ুষ্কাল বাড়বে।

কিভাবে বুঝবেন ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে কি না
সেলফ এক্সামিনেশান : নিজের ব্রেস্ট নিজে পরীক্ষা করাকে সেল্ক এক্সমিনেশান অফ ব্রেস্ট বলা হয়।
পদ্ধতি :
১। আয়নার সামনে দাড়াবেন, দুই পাশের ব্রেস্ট ভালো করে লক্ষ্য করবেন, এরপর দুই হাত উপরে উঠিয়ে আরো ভালো করে লক্ষ্য করতে হবে। আকৃতিগত কোন পার্থক্য কোন ফোলা অথবা চামড়ায় কোন গর্ত দেখা যায় কিনা অথবা নিপল এ কোন পরিবর্তন চোখে পড়ে কিনা।
২। এরপর আপনার দুই হাত কোমড়ের উপরে রেখে একসাথে চাপ দিতে হবে এতে আপনার বুকে যেসব মাংসপেশী আছে তা সংকুচিত হবে এবং ব্রেস্ট এর কোন পরিবর্তন থাকলে ভাল বোঝা যাবে। এইভাবে কোন পরিবর্তন চোখে পড়ে কিনা দেখতে হবে।
৩। বিছানায় শুয়ে ডান কাঁধের স্তনের নিচে বালিশ দিয়ে ডান হাত উপরে রেখে বাম হাতের আঙ্গুলের ডগা দিয়ে অনুভব করতে হবে, কোথায় কোন চাঁকা অনুভূত হয় কিনা। নিপলে চাপ দিয়ে কোন রস বের হয় কিনা পরীক্ষা করতে হবে। এইভাবে বাম ব্রেস্ট ডান হাত দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে। যে পাশের ব্রেস্ট পরীক্ষা করা হবে, ঐপাশের বগালেও একই সাথে হালকা চাপ দিয়ে কোন চাঁকা অনুভব হয় কিনা দেখতে হবে।
৪। এবার প্রতিটা ব্রেস্ট এর হাতের আঙ্গুলের ডগা দিয়ে উপরে-নিচে এবং পাশাপাশি চাপ দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে।
এই পদ্ধতিতে প্রতিমাসে একবার পরীক্ষা করতে হবে। ভাল হয় মাসিক হওয়ার ৩-৫ দিন পর যদি করা হয় ।
নিজে হাতে পরীক্ষা করে যদি আপনার মনে হয় কোথাও কোন অস্বাভাবিক কিছু আছে, তা হলে দেরি না করে “সার্জারী” বিভাগের ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। ডাক্তার আপনাকে ফিজিক্যালি দেখে যদি মনে করেন পরীক্ষার প্রয়োজন আছে তাহলে উনি আপনাকে নিচের পরীক্ষাগুলো করতে দিতে পারেন।
(১) আল্ট্রসনোগ্রাফি অব ব্রেস্ট
(২) ম্যামোগ্রাফি (গধসসড়মৎধঢ়যু)
(৩) গজও ড়ভ ইৎবধংঃ
(৪) ঋঘঅঈ ( ঋরহব হববফষব অংঢ়রৎধঃরড়হ
ঈুঃড়ষড়মু).
ডাক্তার পরীক্ষা করে কোন অসুবিধা খুঁজে পেলে আপনাকে ব্রেস্টের আলট্রাসনোগ্রাম করতে দেবেন। অনেক সময় খুব বেশি ছোট টিউমার হলে আলট্রাসনোগ্রাফিতে ভালো বোঝা যায় না। এক্ষেত্রে ম্যামোগ্রাফি করতে দেয়া হয়। এই রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বুঝবেন আপনার পরবর্তী আর কোনো পরীক্ষা লাগবে কি না। অনেক সময় টিউমারটি কতটা খারাপ অথবা অপারেশন করা লাগবে কি লাগবে না বোঝার জন্য ঋঘঅঈ ( ঋরহব হববফষব অংঢ়রৎধঃরড়হ ঈুঃড়ষড়মু) সুই দিয়ে ব্রেস্ট এর কিছু টিস্যু নিয়ে ল্যাব-এ পরীক্ষা করতে দেয়া হয়। ঋঘঅঈ একটি ছোট পরীক্ষা। যদি ডাক্তার আপনাকে এই পরীক্ষা করতে বলে, তাহলে দেরি না করে দ্রুত পরীক্ষাটি করে ফেলা উত্তম।
আপনার ফ্যামিলিতে যদি ব্রেস্ট ক্যান্সারের ফ্যামিলি হিস্ট্রি থাকে তাহলে আপনি সেলক এক্সমিনেশান এর পাশাপাশি ২/৩ বছর অন্তর অন্তর ম্যামোগ্রাফি করতে পারেন।

ব্রেস্ট টিউমারের আছে প্রকারভেদ। কিছু খারাপের খারাপ টিউমার কিছু খারাপের ভালো টিউমার। মানে কিছু টিউমার কেবল ব্রেস্ট টিসুতেই সীমবাদ্ধ থাকে, যাকে আমরা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ (ঝধভব) মনে করি, এদের নাম ‘ইবহরমহ ঞঁসড়ঁৎ’। কিছু টিউমার কিছু মাসের ব্যবধানে ব্রেস্ট থেকে বিভিন্ন গ্রন্থি, লিভার, ফুসফুস, হাঁড়ে ছড়িয়ে যায়। এদের আমরা ‘গধষরমহধহঃ ঞঁসড়ঁৎ’ বলি। ক্যান্সার বিভিন্ন ভাবে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে। তাই অতিসত্বর ছড়ানোর আগে যদি চিকিৎসা নিলে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা এবং বাঁচানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অনেক সময় আমাদের কাছে রোগী অনেক দেরি করে আসেন তখন লিভার ফুসফুসে ছড়িয়ে যায়। তখন অপারেশন করে আমরা খুব একটা ভালোর দিকে নিতে পারি না। তাই প্রথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার সনাক্ত করা খব জরুরি।
চিকিৎসা ব্যবস্থা ঃ
১. যদি আপনার ‘ইবহরমহ ঞঁসড়ঁৎ’ (খারাপের ভালো) ধরা পড়ে তাহলে হয়তো শুধু টিউমারটি ফেলে দিয়েই
চিকিৎসা করা সম্ভব।
(২) আর যদি ‘গধষরমহধহঃ ঞঁসড়ঁৎ’ হয় তাহলে আপনাকে ব্রেস্ট সার্জারি যাকে আমরা ম্যাসটেকটমি (গধংঃবপঃড়সু) বলে থাকি, তাই করতে হবে। এতে আপনার ব্রেস্ট টিস্যু ফেলে দেয়া হয়, যেন ক্যান্সার কোষগুলো আপনার অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে না পড়ে।
টিউমারের সাইজ বেশি বড় হলে আগে কেমোথেরাপি দিয়ে এরপর সার্জন অপারেশানে অগ্রসর হতে পারেন। টিউমারের সাইজ খুব বেশি বড় না হলে আগে অপারেশন করা হয় এবং অপারেশানের ক্ষত শুকানোর পর রেডিওথেরাপি অথবা কেমোথেরাপি নেয়ার জন্য ‘অনকোলাজি’ বিভাগে পাঠানো হয়। কারণ দেখা গেছে অপারেশানে ব্রেস্ট টিস্যু অপসারণ করা হলেও ক্যান্সার কোষ বিভিন্ন জায়গায় সুপ্ত থাকতে পারে। যা পরবর্তীতে আবার ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। তাই রেডিেেথরাপি ও কেমোথেরাপি দিয়ে সেই কোষগুলো নির্মূল করার চেষ্টা করা হয়।
তাছাড়াও এখন বেশ কিছু নতুন হরমোনাল থেরাপিও দেয়া হয়। এর জন্য হরমোন এনালাইসিস করা হয়। যদি
পজিটিভ রেজাল্ট আসে তাহলে তাদের ক্ষেত্রে হরমোন থেরাপি ভাল কাজ করে। অনেকে ব্রেস্ট টিস্যু অপসারণের এই বিষয়টা নিয়ে ভয় পান, এবং অপারেশনের পর আকার আকৃতিগত পার্থক্য নিয়ে মানসিক অসুস্থতায় ভুগেন। তাদের জন্য আছে ব্রেস্ট কনজারবেটিভ সার্জারি (ইৎবধংঃ ঈড়হংবৎাধঃরাব ঝঁৎমবৎু)। এর অর্থ সম্পূর্ণ ব্রেস্ট টিস্যু অপসারণ করা হয় না । কিন্তুু এই ক্ষেত্রে ক্যান্সার পরবর্তীতে আবার হওয়ার সম্ভাবনা অত্যাধিক।
এসব ক্ষেত্রে গধংঃবপঃড়সু করে পরবর্তীতে ব্রেস্ট জবপড়হংঃৎঁপঃরড়হ ঝঁৎমবৎু ভাল পদ্ধতি। এটি কসমেটিক সার্জারি বলা চলে। বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই ক্ষেত্রে ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট অন্যতম। তাই জবপড়হংঃৎঁপঃরড়হ ঝঁৎমবৎু-গুলো কিছুটা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। তবে ব্রেস্ট সার্জারি হওয়ার রোগীদের জন্য এটি বিনা দ্বিধায় খুবই উপকারি। তাদের মানসিক হীনমন্যতা দূর হয় বহুলাংশে।

সর্বশেষে বলতে চাই, এখন পর্যন্ত সঠিক সময়ে যারা ডাক্তারের শরনাপন্ন হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন, ব্রেস্ট সার্জারি এবং পরবর্তীতে নিয়মিত রেডিও ও কেমোথেরাপি নিয়েছেন তাদের সবাই স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। তবে সার্জারির পরও সেলফ এক্সামিনেশন করতে হবে এবং ডাক্তারের সাথে ফলো-আপ করতে হবে। কারন যাদের একপাশের ব্রেস্ট এ ক্যানন্সার হয়, অপর পাশে হওয়ার অনেক সম্ভাবনা থাকে। কারো ব্রেস্ট ক্যান্সার শুধুমাত্র ব্রেস্ট টিস্যুতে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে চিকিৎসার পর রোগীর আরো ৫ বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৯৯%, ১০ বছর আয়ুষ্কাল ৮৩%, তাই যথাসময়ে চিকিৎসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমার দেখা অনেক ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগী সার্জারি, কেমোথেরাপির পর এখনো ভালো আছেন। স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। সার্জারির পর পূণরায় ক্যান্সার হয়েছে এরকম রোগীর সংখ্যা খুবই নগন্য। তাই ভয় না পেয়ে মনে সাহস নিয়ে ব্রেস্ট ক্যান্সার মোকাবেলা করতে হবে। আমার একজন রোগী শেফালী (ছদ্ম নাম)। ২০০৪ সালে তার ডান পাশে ব্রেস্ট এর ব্যাথা ও জ্বর নিয়ে আসেন। প্রথমে মনে করা হয় তার ফোঁড়া হয়েছে, পরে ঋঘঅঈ করার পর ক্যান্সার ধরা পড়ে। কিন্তু ক্যান্সার ছিল ব্রেস্ট টিস্যুতে সীমাবদ্ধ, যাকে খড়পধষরুবফ ঞঁসড়ঁৎ বলা হয়। তাকে ঈযবসড়ঃযবৎধঢ়ু দেওয়া হয় এবং ব্রেস্ট কনজারভেটিভ সার্জারি করা হয়। কারন তিনি ছিলেন অবিবাহিত। পরে সার্জারির পর তাকে জধফরড় ঞযবৎধঢ়ু দেওয়া হয়। তিনি স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করেন। ২০০৫ সালে তার বিয়ে হয় এবং এর মাঝে তার আবার স্তনে ব্যথা শুরু হয়। তখন তার হরমোন থেরাপি শুরু করা হয়। তিনি স্বাভাবিকভাবে ২০১০ সালে সন্তান ধারণ করেন এবং একটি সুস্থ ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। ২০১৯ সালে আবার বাম পাশের ব্রেস্টে চাকা অনুভব করেন, তাই তার ঈড়ৎব ইরড়ঢ়ংু করা হয় এবং ধরা পড়ে ইবহরমহ ঞঁসড়ঁৎ যা খারাপ নয়। এখন পযর্šÍ তিনি ভাল আছেন ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। তাই ভয় না পেয়ে মনে সাহস নিয়ে ক্যান্সারের মেকাবেলা করতে হবে। আর তাই আমরা খুব সহজেই বলতে পারি, ক্যান্সার মানেই শেষ নয়, ডব হববফ ঃড় ঢ়ৎবাবহঃ পধহপবৎ ্ ঋরমযঃ পধহপবৎ ঃড়মবঃযবৎ, ঞযবৎব রং ধষধিুং ঐড়ঢ়ব.
চিকিৎসক
বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট