চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

করোনা : নারীর সুরক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে সবাইকে

জান্নাতুল মাওয়া শাখি

৩১ মার্চ, ২০২০ | ৯:৩৫ অপরাহ্ণ

করোনাভাইরাস এই মুহুর্তে প্রায় গোটা বিশ্বকে ভীত সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। মরণঘাতী এই ভাইরাসের আতঙ্কে  কাঁপছে বিশ্ব। কোভিড-১৯ হল একটি সংক্রমক অসুখ যা একটি নতুন ভাইরাসের কারণে হয় এবং যা এর আগে মানুষের মধ্যে শনাক্ত করা যায়নি।

করোনার কারণে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দের তালিকায় ঢুকে পড়েছে ‘লকডাউন’ ও ‘কোয়ারেন্টাইনের’ মতো শব্দগুলো। কোথাও রাষ্ট্র বা প্রশাসনিক নির্দেশে মানুষ নিজেকে বন্দি করছে, কোথাও মানুষ স্বেচ্ছাবন্দি হচ্ছে।

এরই মধ্যে এই ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছয় লাখেরও বেশি এবং বিশ্বব্যাপী মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ত্রিশ হাজার (২৯ মার্চ পর্যন্ত)। এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে থামবে তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, এই নতুন মহামারীতে নারীদের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। স্বাস্থ্যগত, অর্থনৈতিক, পারিবারিক সবদিক থেকেই ক্ষতির শিকার হতে পারেন নারীরা।

করোনাভাইরাসে যারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন তারা হলেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। বিশেষ করে চিকিৎসক ও নার্সরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পুরো পৃথিবীতে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত কাজে নিয়োজিত লোকবলের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় হিসাব অনুযায়ী, সে দেশে স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে নারী ৭৬ শতাংশ। আমাদের দেশেও এই সংখ্যা কম হবে না। আমাদের দেশে স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়াও নারী পোশাক শ্রমিকরাও রয়েছেন বড় ঝুঁকির মধ্যে। পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে এই রোগ ছড়ালে সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবেন নারীরা। তখন পরিস্থিতি যে ভয়াভহ রূপ ধারণ করতে তা আমাদের চিন্তারও বাইরে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি এট বাফেলোর স্বাস্থ্যনীতি বিষয়ক বিভাগের ডিন ন্যান্সি নিয়েলসেন বলছেন, স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে যেসব নারী কাজ করেন, তাঁদের মা-বাবাসহ বয়স্কদের দেখাশোনার দায়িত্বও আছে। এছাড়াও সন্তানদের দেখাশোনা করেন তাঁরা। এমন পরিস্থিতিতে এসব নারীর ওপর আলাদা চাপ পড়ছে।

এছাড়াও নারীরাই পরিবারের প্রাথমিক দেখভাল বা প্রিয়জনদের যত্নআত্তি করার দায়িত্ব পালন করেন। এফ.কে.এ’র (ফ্যামিলি কেয়ারগিভার এলায়েন্স) দেয়া তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে পৃথিবীতে ৭৫ শতাংশের বেশি নারী পরিবারের ক্ষেত্রে এই ভূমিকা পালন করেন। পুরুষেরা নারীদের সহযোগিতা করলেও পরিবারের সদস্যদের যত আপত্তি বা সেবা করার ক্ষেত্রে নারীদেরই সময় দিতে হয় বেশি। হিসাব অনুযায়ী, এক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীরা ৫০ শতাংশ বেশি সময় দেন।

কর্মজীবী নারীদের নিয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠান এলিভেট নেটওয়ার্ক’র প্রধান নির্বাহী ক্রিস্টি ওয়ালেস বলেন, একটি পরিবারে নারীদের সাধারণত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, প্রধান বিনোদন কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা এই তিন ধরনের কাজই করতে হয়। সংকটকালে যখন আমরা কী করব বুঝে উঠতে পারি না এবং আতঙ্কগ্রস্থ ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি, তখন এতগুলো ভূমিকা পালন করা নারীদের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে।

গর্ভবতী নারীদের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণ :

ইউনিসেফ’র দেয়া তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত এমন কোন প্রমাণ হাতে নেই যাতে বলা যেতে পারে যে, গর্ভাবস্থায় এই ভাইরাস মায়ের থেকে তার সন্তানের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। এছাড়াও, শিশুর উপর এই ভাইরাসের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে মন্তব্য করার মতোও কোন প্রমাণ নেই। বর্তমানে এ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এই ভাইরাসের সংক্রমণের হাত থেকে গর্ভবতী নারীদের রক্ষা পেতে হলে জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট জাতীয় লক্ষণ দেখা  দেয়ার সাথে সাথে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা এবং আগেভাগেই চিকিৎসা সেবা নেওয়া উচিত।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মায়েদের বুকের দুধ সন্তানদের জন্য কতোটা নিরাপদ?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফে’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, আক্রান্ত এবং ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের সকল মা যাদের জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্টের লক্ষণ রয়েছে, তাদের দ্রুত চিকিৎসা সেবা নেয়া উচিত এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের পরামর্শ অনুসরণ করা উচিত।

বুকের দুধ খাওয়ানোর সুবিধা এবং বিভিন্ন ধরনের শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাস সংক্রমণে বুকের দুধের গৌণ ভূমিকা বিবেচনা করে বলা যেতে পারে যে, প্রয়োজনীয় সকল সতর্কতা অবলম্বন করে মায়েরা তাদের সন্তানদের বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে পারেন।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ রয়েছে এমন মায়েরাও বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন। তবে তারা যখন সন্তানের কাছে থাকবেন এবং দুধ খাওয়াবেন তখন মাস্ক পরবেন, সন্তানের সংস্পর্শে আসার আগে ও পরে (দুধ খাওয়ানোর সময়) ভালো করে হাত ধুয়ে নিবেন, এবং জীবাণু রয়েছে এমন জায়গা ভালভাবে পরিস্কার করবেন। কোভিড-১৯ এ নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত বা এই ভাইরাসে আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে এমন যে কোন মানুষ শিশুসহ অন্যদের সংস্পর্শে আসার সময় সকল ক্ষেত্রে উপরোক্ত সতর্কতাগুলো অবলম্বন করবেন।

মা যদি খুবই অসুস্থ হয়, তখনও বুকের দুধ সংরক্ষন করে তার সন্তানকে দেয়ার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করা উচিত। এই দুধ কোন পরিস্কার কাপ বা চামুচে করে  দেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে একই ধরনের সংক্রমণ প্রতিরোধ সতর্কতা অনুসরণ করতে হবে।

নারীদের জন্য সুখবর :

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এখন পর্যন্ত মৃত্যুহার বেশি পুরুষদের মধ্যে। নারীদের মধ্যে মৃত্যুহার অনেক কম। ইতালিতে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি পুরুষ। চীনে কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, মোট মৃত মানুষদের মধ্যে ৬৪ শতাংশই পুরুষ। দক্ষিণ কোরিয়ায় এটি ৫৪ শতাংশ।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, পুরুষদের বেশি মারা যাওয়ার পেছনের একটি হচ্ছে জীববিজ্ঞানগত। নারীদের দুটি ‘এক্স’ ক্রোমোজম থাকে। এই ‘এক্স’ ক্রোমোজোমে রোগপ্রতিরোধী বেশ কিছু জিন থাকে। যেহেতু পুরুষদের একটি ‘এক্স’ ক্রোমোজম থাকে, তাই তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নারীদের তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই কম থাকে। ফলে রোগের সঙ্গে লড়াই ও সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠার প্রবণতা নারীদের বেশি থাকে। এই সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র হিউম্যান জিনোমিকস নামের একটি জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।

হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের রোগ এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন। মহিলাদের  ক্ষেত্রে এ ধরণের দীর্ঘস্থায়ী রোগ তুলনামূলক কম হয়। আর সে কারণে করোনাও নারীদের শরীরে সুবিধা করতে পারে না।

হেপাটাইটিস সি এবং এইচআইভিসহ বিভিন্ন সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য পুরুষদের সহজাত কম এন্টিভাইরাল প্রতিক্রিয়া বাড়ানোর জন্য হরমোনগুলোও প্রধান ভূমিকা পালন করে বলে বিশ্বাস করা হয়।

এই গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, পুরুষের দেহে একটি এক্স ক্রোমোসোম রয়েছে। নারীদের রয়েছে দুটি। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই নারীদেহ বেশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী। গবেষকরা দেখেছেন, পুরুষের তুলনায় নারীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এ ক্ষেত্রে বেশি ভূমিকা রেখেছে। নারীরা প্রাকৃতিকভাবে ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ভূমিকা পালন করে।

বিশ্বের যেকোন মহামারী নারীদের জন্য বৈষম্যমূলক পরিস্থিতি তৈরি করেন। মহামারীর যত ইতিহাস আছে তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মহামারী পরবর্তী পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে নারীর জন্য। এছাড়াও এই সময়ে নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা ও যৌন নিপীড়নের ঘটনাও বেড়ে চলে পাল্লা দিয়ে। সাধারণত লকডাউন পরিস্থিতিতে এসব ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা যায়। বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরা এর জন্য দায়ী করেছেন উদ্বেগ, মদ্যপান ও আর্থিক সংকটের মতো বিষয়গুলোকে। তাই আসুন আমরা করোনার এই সময়টাতে এবং করোনা পরবর্তী সময়ে নারীর প্রতি সদয় হই। নারীকে ‘নারী’ নয় মানুষ হিসেবে বিবেচনা করি। নারীর সুরক্ষায় এগিয়ে আসি।

লেখক : শিক্ষার্থী। অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট