চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ব্যাংক লেনদেনের উপর সেবাখাতকে বন্ধকবিহীন ঋণ দিন

জাহিদ হোসেন ফিরোজ

২৩ জুলাই, ২০২০ | ১:০১ অপরাহ্ণ

পৃথিবীতে মার্চ ২০২০ থেকে কোভিড ১৯ এর মহামারীর কারণে অর্থনীতিতে যে ধস সৃষ্টি হয়েছে তাতে এই বিপর্যয় ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের জনগণকে কিভাবে পুষিয়ে দেবে সেই কাজে ব্যস্ত। সরকারের কোন প্রণোদনা বা ঋণ ২০২০ সনের এই করোনাকালে দেশের অতি ধণী ১ কোটি ৩০ লক্ষের জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত না। কারণ কোভিড জনিত কারণে পৃথিবীর অর্থনৈতিক মন্দা অতি ধনীদের স্পর্শ করবে না। পাশাপাশি দেশের গন্ডি ছেড়ে যারা বিদেশে ব্যবসা ও স্থাপনা করেছেন; তাদের বিষয়ে দেশের ব্যাংকের কোন দায়িত্ব থাকা উচিত না।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের মতে ৬ কোটি ১৫ লক্ষ লোক এই করোনাকালে দরিদ্র সীমার নীচে নেমে গেছে। দেশের রপ্তানি বাণিজ্য এক বছর আগে থেকেই অবনমন চলছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ‘মার্শাল প্ল্যান’ গ্রহণ করে ইউরোপের দেশগুলো তাদের অর্থনীতিকে আগের চেয়ে উন্নত করেছিল। ক) পৃথিবীব্যাপী কোভিড ১৯ এর প্রাক্কালে: বৃটেনের সরকার যাদের ন্যূনতম ১৬ হাজার পাউন্ড ব্যাংকে জমা ছিল; অন্যদেরকে প্রণোদনা দিয়ে তাদেরকে বলেছে যে, আগে সেখান থেকে খরচ করে চলতে হবে। খ) আমেরিকার সরকার যাদের ১০ হাজার ডলারের নিচে আয় তাদেরকে প্রথম স্ল্যাবে টাকা দিয়েছে। এরপর প্রয়োজন ও আবেদন অনুযায়ী স্ল্যাব বাড়িয়েছে। গ) পাকিস্তান সরকার কমিউনিটি বেজড ফ্রি ওয়েব পোর্টাল আপলোড করেছে। যাদের যা সমস্যা তারা তা সেখানে আপলোড করার জন্য। তারা ১ কোটি ২০ লক্ষ লোককে ৪ মাস ধরে মাসিক ১২ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ঘ) বাংলাদেশ সরকার অতি দরিদ্রদের জন্য ঘর করে দেয়াসহ অর্ধকোটি লোককে সরাসরি তাদের মোবাইলে টাকা দিয়েছে। কারা পেয়েছে সেটা একটা ওয়েব পোর্টালে দিয়ে দিলে কিংবা প্রিন্ট মিডিয়ায় দিয়ে দিলে অনেক প্রশ্ন কমে যেত।। একটা দেশের অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত হয় তখন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সেই দেশের শিল্পখাত ও সেবাখাতকে পৃষ্ঠপোষকতা করা। প্রধানমন্ত্রী ১৩ এপ্রিল, ২০২০ ইং তারিখে একটা পরিপূর্ণ প্যাকেজ ঘোষণা দেন। যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় দেশের ব্যাংকসমূহকে। ব্যাংকগুলোর কর্তারা সমানে বলে যাচ্ছে যে, ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের টাকা মেরে দিচ্ছে। তাহলে কি করতে হবে? ব্যাংকগুলো কি তাহলে ঋণ দেয়া বন্ধ রাখবে। আর কর্তারা কি তাহলে শুধু বসে বসে বেতন খাবে? ব্যবসা হচ্ছে অর্থনীতির রক্ত প্রবাহ। আর ব্যবসায়ী হচ্ছে তার হৃদপিন্ড। সেই ব্যবসায়ীকে জীবন দেয়া, বাঁচানো, অক্সিজেন দেয়া একটি সরকারের কাজ বা দায়িত্বের অংশ।

একজন ব্যবসায়ী হচ্ছে একজন উদ্যোক্তা। একজন ব্যবসায়ী কখনো বসে থেকে জীবন অতিবাহিত করে না। সে সরকারকে কর দেয় কর্মসংস্থান করে। করোনাকাল শুরুর প্রথম থেকেই সরকার ঘোষিত প্যাকেজের মাধ্যমে সরকার বুঝিয়ে দেয় যে, এই বিষয়ে সরকার সজাগ। একজন ব্যবসায়ীকে ঋণ দেয়ার আগে ও পরে ব্যাংক তার উপর বিভিন্ন রকম দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান, ঘোষিত ও অঘোষিত খরচের কাঁচি চালাতেই থাকে। এটা করে তারা কিছু বাড়তি আয় করে নেয়। পৃথিবীব্যাপী কোভিড ১৯ জনিত কারণে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়লেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আগে থেকেই মন্দা চলছিল। বেশীর ভাগ গার্মেন্টস আগে থেকেই বন্ধ হয়ে পড়ছিল। সরকার ১ লক্ষাধিক কোটি টাকার ১৯টি প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে। যার সিংহভাগ হবে ব্যাংকের মাধ্যমে। জনগণকে প্রণোদনা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখাও সরকারের কাজ। সরকার নিজে খাদ্য সাহায্য দিয়েছে ও দিচ্ছে। যেহেতু সরকারের যথেষ্ট মজুদ আছে। সরকার জনগণকেও দরিদ্রদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে আহবান জানিয়েছে। এই প্যাকেজ মোট জিডিপির সাড়ে তিন (৩.৫) ভাগের বেশী না। অতি ধনীদের অন্যান্য দেশের মতো দরিদ্রদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়াতে তেমন একটা দেখা যায়নি। যা করেছে তা হচ্ছে, সমাজের মধ্যবিত্ত সচেতন অংশ থেকে।

ব্যাংকের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো যে, সে মর্টগেজ চায়। মর্টগেজ খুবই অযৌক্তিক একটা শর্ত। যে কোন লোন দেয়ার আগে ব্যাংক সেই লোন ফেরত পাওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই করে নেয়। যে কোন লোক মর্টগেজ নিয়ে ব্যাংক হাজির হলেই ব্যাংক তাকে লোন দেয় না। আবার কোন উদ্যোক্তাকেও লোন দেয় না। গাড়ির জন্য বা গৃহঋণ দেয়ার আগে বা অন্য কোন ব্যবসার জন্য ঋণ দেয়ার আগে; ব্যাংক যাচাই করে নেয় গ্রাহক ঋণ শোধ করতে পারবে কিনা। ১৩ এপ্রিল ২০২০ তারিখে সরকার শিল্পখাত ও সেবা খাতের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি শাখা থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে । শিল্পখাত তার ফ্যাক্টরির জায়গা, অন্যান্য জায়গা, তার নতুন ও পুরাতন আমদানি করা মেশিন বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে লোন নিতে পারে। সেবা খাত যদি এটা দিতে পারতো তাহলে তো তারা শিল্পই স্থাপন করে ফেলত।

সেবা খাত হচ্ছে মেধা ও অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে অর্থ ও সময়ের প্রয়োজন হয়। বন্ধকী বাড়ি, গাড়ি, জায়গা ২০-৩০ ভাগ দামে নিলামে বিক্রি করে খেলাপী ওই গ্রাহককে পথে বসিয়ে তারপর তাকে জেলে ঢোকানোর ব্যবস্থা করে। যা অযৌক্তিক। বিভিন্ন কারণে একজন উদ্যোক্তা তার ব্যবসা হারিয়ে ফেলতে পারে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যার কারণে এটা হতে পারে। অতি খরচ বা অতি বাকি দিয়ে। বা অতি সুদের কারণেও হতে পারে। মূলতঃ যাদের মর্টগেজ দেয়ার মতো সম্পদ রয়েছে, তারাই শুধু ব্যাংকের কাছে ঋণের জন্য আবেদন করতে পারে। তৃতীয় জনের জায়গাও বন্ধক দেয়া যায়। একজন গ্যারান্টারও লাগে। বেচারা গ্যারান্টার কোন লাভের অংশীদার না। তথাপি ব্যাংক কর্মচারীরা গ্যারান্টারের জীবন ওষ্ঠাগত করে ফেলে। আবার হেনস্তা করার জন্য ভাড়াটে লোকজনও রাখে।

একজন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীকে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে সরকারের কর্তব্য। যারা মর্টগেজ দিতে পারবে না। রাজস্ব বিভাগে দেয়া তাদের স্থিতিপত্র ও ব্যাংকে লেন-দেনের উপর ভিত্তি করে; সরকারের তাদেরকে ঋণ দেয়ার জন্য একটা নূন্যতম বরাদ্দ রাখতে হবে। মর্টগেজ রাখার ব্যাংক মানসিকতা কোন কোন পর্যায়ের জন্য শিথিল না হলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। সৎ মানসিকতায় সরকার ঘোষিত প্যাকেজ ব্যাংক মানসিকতার কারণে বাস্তবায়ন হওয়ার সুযোগ নেই। যদিও আয়কর বিভাগে পাশ হওয়া স্থিতিপত্র যাচাই করার কথা বলে এবং ক্রেডিট রেটিং করতে উদারতা পোষণ করে সরকার খুবই যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। একজন ব্যবসায়ী ব্যাংক বহির্ভূত লেনদেন করার পরে ব্যাংকে যা লেনদেন করে তা না করলে কর বিভাগ তাকে ধরবে। এটা তাকে করতেই হবে। ব্যাংকে এই লেনদেনের উপর ভিক্তি করে তার ঋণ প্রাপ্যতা নির্ধারিত হবে। এই ঋণ প্রাপ্যতার ৩০ ভাগ সে ৩ বছরের জন্য ঋণ হিসাবে দিলে আশা করা যায় যে, গ্রাহক টাকা শোধ করতে পারবে।

একমাত্র সমস্যা হচ্ছে এখন, মর্টগেজ। সরকারকে তার ঘোষিত নীতিমালার উপর ভিত্তি করে মর্টগেজ বিহীন লোন দিতে হবে। ঋণ শোধ করার নিয়মে ব্যাঘাত ঘটলে ১২ মাস পর্যন্ত গ্রাহককে সময় দেয়া উচিত। কারণ ব্যবসার গতি সবসময় এক রকম থাকেনা। সরকার প্রায় ১৬ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা এপ্রিল ও মে ২০২০ এর দুই মাসের সুদ মওকুফ করেছে। পাশাপাশি ৯ মাসের জন্য যে কোন ঋণের শ্রেণীমান নির্ধারণ করতে বলেছে। এটা স্বস্তিদায়ক হবে। তবে এটা ১২ মাসের জন্য করলে আরও স্বস্তিদায়ক হবে। কি কারণে জানি না আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এটা প্রযোজ্য হয়নি। ভুল করে কিনা কে জানে। এক দেশে দুই নীতি। প্রত্যেক গ্রাহককে অনধিক ১ কোটি টাকা করে সুদ + আসল মওকুফ করলে ১৬ হাজার ৫৫০ জন গ্রাহক এই টাকা মওকুফ পেত। বা ৫০ লক্ষ টাকা করে মওকুফ করলে দ্বিগুণ প্রান্তিক গ্রাহক সুযোগ পেত। সরকার দুই মাসের সুদ মওকুফ করেছে। কে- কতটুকু লাভবান হয়েছে বোঝা মুশকিল। কিন্ত ব্যাংকগুলির কর্তারা টিভি ফাটিয়ে ফেলছে এই বলে যে, ব্যবসায়ীরা আবারও কিছু সুবিধা নিয়ে নিল।

ব্যাংক কর্তাদের কাছে প্রশ্ন, সুবিধাগুলো কার জন্য বা কাদের জন্য হবে? যারা কর দেয় ও কর্মসংস্থান করে তাদের জন্য? নাকি যারা সুবিধার মধ্যে বসে আছে তাদের জন্য আরো আরো সুবিধা? ১ কোটি টাকাতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ি কেনার জন্য এই কর্তারা পেয়ে থাকেন। সাথে আরো অনেক সুবিধা ওনারা পান। তাতে জনগণ কখনো কোন আপত্তি করে নি। কর্তারা সমস্বরে বলছে যে, মোট ঋণের পরিমাণ ১২ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে আসল কতো? সুদ কতো? মোট ঋণ গ্রাহক কত জন? কত জন কত টাকা খেলাপি? তার হিসাব থাকলেও প্রকাশ করা হয় রেখে ঢেকে। ব্যাংক থেকে যাদের অনেক বেশি টাকা নেওয়া আছে, সরকার ঘোষিত এই দুই মাসের সুদ মওকুফ তাদের জন্য কোন প্রণোদনা হবে না। উদ্দেশ্য থাকতে হবে যেন কোন একটা প্রান্তিক গ্রুপ যাদের এই মওকুফ কাজে লাগবে।

এজন্য আমার প্রস্তাবটি হচ্ছে, সবার জন্য সমান মওকুফ (২ মাসের সুদ ঢালাওভাবে মওকুফ দিয়ে নয়) তাহলে কম ঋণ নেয়া প্রান্তিক গ্রুপটি সরাসরি সুবিধা পাবে। সেটা ১ কোটি হতে হবে তা আবশ্যিক নয়। অনধিক ১ কোটি হতে পারে। শেষ কথা হচ্ছে যে, স্থিতিপত্র, ব্যাংক লেন-দেন ও ব্যবসা বা কোম্পানির বয়সের উপর বন্ধকবিহীন ঋণ অপরিহার্য।

 

ইমেইল: [email protected]

 

 

 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট