চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

রেমিটেন্স যোদ্ধাদের অবমূল্যায়নের সুযোগ নেই

মোহাম্মদ শাহজাহান

৭ জুলাই, ২০২০ | ৩:০৬ অপরাহ্ণ

করোনা হঠাৎ বদলে দিয়েছে একটি সুস্থ পৃথিবীর মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। তৈরি হয়েছে সামাজিক দূরত্বের মাপকাঠি। প্রতিটি মুহূর্ত আতঙ্কে কাটছে এক অদৃশ্য এবং অতি ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কাছে। ইতিমধ্যে প্রিয় মাতৃভূমিতে করোনাভাইরাস আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে শুরু করেছে। এই সময়ে কেউই নিরাপদ নয়। প্রতিদিন মনে হয় এই তো আর কয়েকটা দিনের পর পৃথিবীটা আবার প্রাণ খুলে হাসবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশিত দিনগুলো যেন দূরে ঠেলে দিচ্ছে। তাছাড়াও এই করোনা পৃথিবীর কাছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। আমাদের ভাবনায় একসময় করোনার মতো ভাইরাস শুধু স্বাস্থ্যগত বিপর্যয় হিসেবে ছিল, অথচ মহামারি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষের লক্ষণ এখন প্রকাশ্য।

স্বজনদের দেশে রেখে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা রেমিট্যান্স যোদ্ধারা আজ অনেক বড় অসহায়। করোনাভাইরাস ছড়ানোর পেছনে তাঁদেরকে সরাসরি দায়ী করে দেশের মানুষের ঘৃণা ও অযাচিত মন্তব্যে সমালোচিত তারা। তবুও প্রবাস মানে নিঃসঙ্গ এক যাপিতজীবন। জীবনযুদ্ধে নেমে জীবিকার তাগিদে অনেক মানুষই বাধ্য হয় দেশান্তরী হতে আর এই দেশান্তরী হওয়া মানুষগুলোর সুন্দর একটা নাম ‘প্রবাসী’।

প্রিয়জনের সান্নিধ্য থেকে যোজন যোজন দূরে। প্রবাসকে বলা হয় স্মার্ট আধুনিক জেলখানা। কিন্তু সুন্দর জীবনের খোঁজে যাওয়া এই প্রবাসীরা কি আসলেই সুন্দর জীবনের দেখা পায়? যখনই দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধির কথা আসে, তখন সবাই একবাক্যে স্বীকার করে প্রবাসী বাংলাদেশীদের অবদানের কথা; তাদের পাঠানো রেমিটেন্সের কথা। কিন্তু কেমন কাটে প্রবাসীদের জীবন- তার খবর রাখে ক’জন?

সরকার কী সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে তাঁদের কিংবা সমাজ তাঁদের কোন চোখে দেখে- এসব প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিমানবন্দরসহ প্রতিটি স্তরে চরম অবহেলার শিকার হন প্রবাসীরা। এছাড়াও ছুটিতে দেশে আসলে আগে যে মানুষগুলো জামাই আদর দেখিয়ে বুকে টেনে নিতেন, তারাই এখন প্রবাসীদের দূরে সরিয়ে রাখছেন। বিদেশ থেকে কী এনেছেন জিজ্ঞেস না করে প্রবাসীদের দেখে অনেকেই অন্যপথে হাঁটতে শুরু করেছেন। দৃশ্যগুলো প্রবাসীদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক। কারণ তারা বিদেশ থেকে এসে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থেকেছেন। তাদের শরীরে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব মেলেনি। কিন্তু নিজ দেশে ফিরে এভাবে অবহেলিত হতে হবে তা তারা কখনোই কল্পনা করেননি। প্রবাস থেকে এসেছেন শুনলেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে গুজব ছড়িয়ে সামাজিকভাবেও হেয় করার ঘটনাও ঘটছে।

তাঁদের অবমূল্যায়ন করার কোনো সুযোগ নেই। যারা প্রবাসে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের উন্নয়নে সহযোগিতা করছে, ভূমিকা রাখছে; সেই রেমিটেন্স যোদ্ধারা জাতির অহংকার। কেননা প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের দিক দিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে দিন-দিন শক্তিশালী হচ্ছে বাংলাদেশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন এক হাজার ৬৪১ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। অর্থবছরের হিসাবে এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স।

বর্তমানে করোনাকালে বিশ্বের সব প্রবাসীরা গৃহবন্দী। কেউ আইসোলেশনে, কেউ হোম কোয়ারেন্টাইনে, কেউ লকডাউনে, কেউ অর্ধাহারে, কেউ বা অনাহারে। জীবিকা ও জীবনের অত্যাবশ্যকীয় তাগিদে, প্রিয় স্বদেশ, মা, মাটি ছেড়ে বিদেশে পরে থাকেন তারা। দেশকে উন্নত দেশে উত্তরণের অভিযাত্রায় এগিয়ে রাখতে দিনরাত পরিশ্রম করছেন রেমিটেন্স প্রেরক প্রবাসী বাংলাদেশীরা।

দেশের অর্থনীতিতে অক্সিজেনের মতো ভূমিকা রাখছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়নের অন্যতম নিয়ামক এই রেমিটেন্স। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, একজন বাংলাদেশি রেমিটেন্স যোদ্ধা প্রবাসে মারা গেলে তার লাশ পাঠাতে চাঁদা তুলতে হয়। অথচ দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন আমাদের প্রবাসীরা। কিন্তু প্রবাসীদের কল্যাণে কোনো আইন নেই, নেই কোনো কর্তৃপক্ষ। যা আছে তা মুখেমুখে। প্রবাসীদের মালামাল ব্যাগ কেটে রেখে দেয় কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। এমন অনেক ধরনের হয়রানি করে তাঁদেরকে। কেন তাঁদের সঙ্গে এমন আচরণ? প্রবাসে আসার সময় পাসপোর্ট করা থেকে শুরু করে বিমানবন্দর, দূতাবাসসহ সবখানেই হয়রানির শিকার হয় প্রবাসীরা। তবে রেমিট্যান্সযোদ্ধা প্রবাসীর পরবাসের অনুভূতি কেমন, কি তার হৃদয়ের ভাষা তা যে কখনো প্রবাসের কঠোর শৃঙ্খল দেখেনি তার পক্ষে অনুধাবন করা অসম্ভব। দেশে বসে প্রবাসের অনুভূতি নেয়া যায় না। বুলি আওড়ানো যায়, প্রত্যেক প্রবাসীর রয়েছে নীল কষ্ট। এ জীবনযুদ্ধের উপাখ্যান এভাবেই চাপা পড়ে যায় নানা কারণে। পরিবারের সুখের জন্য, ভবিষ্যৎ জীবন উজ্জ্বল করার আশায় নিজের জীবনের সোনালী সময় প্রবাস জীবনে বন্দি। এ এক অন্য বেদনা। ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে প্রবাসীরা গ্রামবাংলার স্মৃতি, পিতা-মাতার নির্মল চেহারা, প্রিয়তমার বর্ণিল হাসি, সন্তানদের প্রাণখোলা নিষ্পাপ মুখ বার বার খুঁজে ফিরে। পরিবারের অনুভূতিই যেন তাদের সুখের অনুভূতি। ঠিক সময়ে মা-বাবার হাতে, প্রিয়তমা, সন্তান, স্বজনদের জন্য টাকা পাঠাতে পারলেই প্রবাসীরা আনন্দ উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন। পরিবারের মুখে হাসি দেখলে তারা আনন্দে বিভোর হয়ে যান। সবকিছুর পরেও প্রবাসীদের জীবন চলে নিরন্তর।

আজ প্রবাসীরা যে পরিমাণ শ্রমশক্তি বিনিয়োগ করছেন, সেই বিনিয়োগকৃত শ্রমের তুলনায় যে পারিশ্রমিক তারা পাচ্ছেন, তা খুবই নগণ্য। তাছাড়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ দেশের অধিকাংশ শ্রমিককেই অদক্ষ বলা হয়। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ও লুটেরা মুনাফাখোর চক্র এ দেশের শ্রম সম্পদকে নানা কৌশলে দক্ষ করতে দেয় না। এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। তবে দেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ এই প্রবাসী আয়ে ধাক্কা লেগেছে করোনা মহামারিতে। যা সামনের দিনগুলোতে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলেও আশঙ্কা দেশী বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার।

অভিবাসন খাতের গবেষকরা বলছেন সংকট মোকাবিলায় প্রবাসী-কল্যাণে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠকরা বলছেন, বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি শ্রমবাজার সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে যোগ্য প্রতিনিধি নিয়োগ, গবেষণা জোরদারসহ বিশেষ পরিকল্পনাও হাতে নিতে হবে সরকারকে।
দেড় শতাধিক দেশের শ্রমবাজারে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি শ্রমিক। যাদের অবদান জিডিপিতে ১২ শতাংশ। এই অবদান মজবুত করেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে। করোনা মহামারীতেও প্রবাসী শ্রমিকের অবদানে রিজার্ভ ছাড়িয়েছে ৩৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু যত দিন পার হচ্ছে বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রকোপে বিপর্যস্ত প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেই সিংহভাগ প্রবাসী কাজ করে, যেখানে জ্বালানি তেলের দাম কমা, পর্যটনসহ অর্থনীতির প্রায় সবখাতেই পড়েছে করোনার থাবা। অন্যান্য দেশেও লকডাউনের কারণে দীর্ঘদিনের কর্মবিরতি চলছে। এরই মধ্যে কাজ হারিয়ে এক লাখের বেশি শ্রমিক দেশে ফিরেছে বলেও জানিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। সেইসাথে ছুটিতে আসা কয়েক লাখ শ্রমিক ফিরতে পারেননি কাজে। সম্প্রতি স্থানীয় কয়েকটি উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে করোনার প্রভাবে বেকার হয়েছেন ১৪ লাখ প্রবাসী শ্রমিক। ভবিষ্যতে এ সংখ্যা বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা আছে। চারপাশের মানুষগুলোর এমন রূঢ় আচরণ তাঁদেরকে কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু তাঁদের কোনো অভিযোগ নেই, কারণ তারা প্রবাসী।

যারা প্রবাসী তারা আমাদের রেমিটেন্স যোদ্ধা। যাদের আত্মত্যাগের ফলে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। তাদের দেশে কিংবা বিদেশে ভোগান্তির শেষ নেই। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাঙালি দূতাবাসের কাছে অনুরোধ রাখব প্রবাসীদের ভোগান্তি দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখুন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রালয়ের কাছে অনুরোধ এসব রেমিটেন্স যোদ্ধাদের দুঃখ দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুণ। যারা প্রবাস থেকে এসে নিজ দেশের এয়ারপোর্টগুলিতে হয়রানির শিকার হন। কর্তৃপক্ষের উচিত বিষয়টি দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নানা পদক্ষেপে হয়ত আমাদের রেমিটেন্স যোদ্ধাদের দুঃখ দূর হবে। দেশের উন্নয়নে রেমিটেন্স যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনি রেমিটেন্স যোদ্ধাদের সহযোগিতা করা সবার নৈতিক দায়িত্ব।

মোহাম্মদ শাহজাহান ব্যাংকার, কলাম লেখক।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট