চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্যালুট করোনাকালের অর্থনৈতিক যোদ্ধাদের

খায়রুল আলম সুজন

২৩ জুন, ২০২০ | ৮:৩৭ অপরাহ্ণ

মহামারী করোনা শুরুর পর থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টরা সুস্থ থাকার জন্য একটাই পরামর্শ দিচ্ছেন–বাসায় থাকুন, নিরাপদ থাকুন । কিন্তু বাসায় থাকার সুযোগ নেই অনেকের। তারা বাসায় থাকলে অর্থনীতি সচল রাখা সম্ভব নয়। এই অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখে চলেছেন নীরব যোদ্ধারা। এই নীরব যোদ্ধারা হলেন বৈদেশিক বাণিজ্যের সিংহভাগ পণ্য পরিবহনকারী সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দরের ছয় হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী।

সরকার যখন ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল, তখনও তারা ছিলেন মাঠে। করোনায় এক মিনিটের জন্যও বন্দর বন্ধ হয়নি। বন্দর সচল রাখতে বন্দরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা–কর্মচারী মৃত্যুবরণ করেছেন। এখনো আক্রান্ত আছে শতের উপরে। উপসর্গ নিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন চার শতাধিক কর্মকর্তা–কর্মচারী। করোনার শুরুতে আকাশপথ ও স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ে। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের একমাত্র নির্ভরশীল মাধ্যমটির নির্ভরতা আরও বেড়ে যায়।

আমরা দেখেছি, এখন চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দিয়ে দেশের আমদানি পণ্যের মোট ৮২ শতাংশ আর রপ্তানি পণ্যের ৯১ শতাংশই পরিবহন হচ্ছে। এই বন্দর যদি কোনোভাবে অচল হয়ে পড়ে তাহলে দেশের অর্থনীতির চিত্রই পরিবর্তন হয়ে যেত। করোনার শুরুতে দেশে যখন আদা–রসুনের সঙ্কট তৈরি হয় তখন বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেরা উদ্যোগী হয়ে খালাস নেয়ার ব্যবস্থা তদারকি করে। সরাসরি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি দিয়ে খাদ্যপণ্য খালাস নেয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। বন্দরের দায়িত্বের মধ্যে না পড়লেও দেশের সঙ্ককটময় মূহুর্তে তারা এই উদ্যোগ নেয়। করোনায় বৈদেশিক বাণিজ্যের পণ্য পরিবহনে যে অচলাবস্থা তৈরি হওয়ার কথা ছিল সেটি হয়নি। এক কনটেইনার রপ্তানি পণ্যও জাহাজীকরণে বিলম্ব হয়নি। বন্দর ইয়ার্ড থেকে পণ্য ডেলিভারি কমে যখন কন্টেইনার জট তৈরি হয় তখনও সচল ছিল বন্দর। জাহাজজট–কন্টেইনার জটের মতো দুরবস্থা সামলে নিয়েছে তারা।

আমরা দেখেছি, করোনা ঝুঁকির সময়ে দায়িত্ব নিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ। এই ঝুঁকির সময়টাতে তাঁর নেতৃত্বে বন্দরের বোর্ড মেম্বার মো. জাফর আলম, কমডোর শফিউল বারীসহ সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারিকে নিয়ে ২৪ ঘন্টা বন্দরকে খোলা রাখায় বৈদেশিক বাণিজ্য সচল ছিল। আবার বন্দর পন্য খালাসে ডেমারেজ চার্জ মওকুফ করে এই দুর্যোগে ব্যবসায়ীদের স্বস্তি দিয়েছে। মাঠ পর্যায়ে পরিবহন বিভাগ, নৌবিভাগ, যান্ত্রিক বিভাগ ও নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের দম ফেলার ফুরসত ছিল না। বন্দরের প্রাণ পরিবহন বিভাগ। এই বিভাগের পরিচালক এনামুল করিম, টার্মিনাল ম্যানেজার কুদরত-ই-খুদা মিল্লাতসহ বন্দর সচল রাখতে একঝাঁক কর্মকর্তা–কর্মচারীদের যখনই সহায়তা চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা তখনই পেয়েছেন। নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক লে. কর্ণেল আহমেদ জুনাইদ আলম খান, উপপরিচালক মেজর মো. রেজাউল হক ও এস এম মাসুদুল ইসলামকে এই যুদ্ধে প্রথম সারিতে রাখতে হবে।

 

 

সরকারি অনেক সংস্থার কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সহায়তা পেতে যখন অনেক বেগ পেতে হয়েছে সেখানে বন্দর কর্মকর্তারা সহযোগিতা করে ভালো নজির তৈরি করেছেন। বন্দর কর্মীদের সঙ্গে অর্থনৈতিক যোদ্ধার তালিকায় শামিল হয়েছেন চট্টগ্রাম কাস্টমস, ফ্রেইট ফরওয়াডার্স , শিপিং লাইন, সিএন্ডএফ এজেন্টসসহ বন্দর ব্যবহারকারী অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

করোনা যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। কতদিন চলবে তাও আমরা জানি না। তবে করোনা থেকে এখনই আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। এই দূর্যোগ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর শিক্ষা নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা সাজাতে পারে। এতে বন্দরের উপর চাপ কমবে, সেই সাথে ঠিক সময়ে আধুনিক বন্দরে গড়ে তোলা সহজ হবে।

এবার সঙ্কটকালীন সময়ে দেখা গেছে, বন্দর সচল রাখার জন্য বন্দরের হাতে অনেক ক্ষমতা নেই। এটা মনে করিয়ে দিয়েছে, সম্মিলিতভাবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্ল্যাটফর্ম থাকা দরকার, যারা সঙ্কটের সময় নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

এখন থেকে প্রয়োজন, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা সাজানো। শুধু পরিকল্পনা নিলেই হবে না, তা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা তদারকি করতে হবে। এখন পণ্য খালাস দেয়ার মতো কাজ হচ্ছে বন্দরের মূল ইয়ার্ডে। এটি বন্দরের কাজ নয়। এটি সরাতে হবে। বে টার্মিনাল ইয়ার্ড করার সিদ্ধান্ত থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এটি যদি এখনই শুরু করা যায় তাহলে সামনে যে কোনো সঙ্কট সামাল দেয়া সম্ভব হবে। কারণ সেখানে ইয়ার্ড হলে পণ্যবাহী ট্রাক–কাভার্ডভ্যান শহরে প্রবেশ করতে হবে না। এলসিএল কার্গো পণ্য খালাসের জন্য এখন বন্দরের বড় বড় শেড আছে। বিশাল জায়গা দখল করে আছে এসব শেড। অথচ এলসিএল কার্গো যদি বন্দর থেকে ডেলিভারি না দিয়ে বন্দরের বাইরের কোনো জায়গা থেকে দেয়া হয় তাহলেও বন্দরে কনটেইনার রাখার জায়গা বাড়বে। এখন বন্দরের এক্স ,ওয়াই শেড, বন্দর অফিসার কলোনির পেছনে অনেক জায়গা খালি আছে। বন্দর চাইলে এসব জায়গায় দ্রুত ইয়ার্ড নির্মাণ করতে পারে। এলসিএল কার্গো ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করতে পারে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদেরও। যেহেতু এল সি এল পণ্য পুরোটাই ফ্রেইট ফরোয়াডার্রা নিয়ন্ত্রণ করে, তাই তাদের হাতে ছেড়ে দেয়া অথবা যৌথভাবে পরিচালনা করা যেতে পারে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত ফরোয়াডার্দের নিজস্ব ওয়ার হাউজের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই পরিকল্পনা মতে বে টার্মিনালে ডিস্ট্রি পার্ক (ডিস্ট্রিবিউশন পার্ক) তৈরি করা গেলে বন্দরের উপর অনেক চাপ কমে যাবে এবং বন্দর থেকে পণ্য চুরি হওয়ার অপবাদ, শহর জটমুক্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। পরিকল্পনামাফিক আধুনিক বন্দর নির্মাণে বে টার্মিনালের কাজ শেষ করা গেলে, দেশের অর্থনিতির চাকা আরও গতি পাবে। পরিশেষে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করা নীরব যোদ্ধাদের স্যালুট জানাই। করোনা থেকে শিক্ষা নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এখনই নামুক–এই প্রত্যাশাও রইল।

লেখক: পরিচালক, বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়াডার্স এসোসিয়েশন (বাফা) এবং পরিচালক, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশন (বিএসএএ)

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট