চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ইসলামে পরিবেশ সুরক্ষা, চাষাবাদ ও বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব

ইসলামে পরিবেশ সুরক্ষা, চাষাবাদ ও বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন

২৬ জুন, ২০২০ | ৬:১১ অপরাহ্ণ

পরিবেশ রক্ষায় বিজ্ঞানীরা বৃক্ষরোপণের ওপর গুরুত্বারূপ করে যাচ্ছেন। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিকে একটি রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক কর্মসূচি অথবা স্বাস্থ্যগত কর্মসূচি মনে করা হয়। ধর্মীয় গুরুত্বটা অনেকের অজানা। তাই বৃক্ষরোপণের ব্যাপারে অনেকের অবহেলা রয়েছে। খালি জায়গা বা জমি পড়ে থাকলেও চাষাবাদ ও বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অনুধাবন করা হয় না। গাছ-পালা ও তরু-লতা যে আমাদের সুরক্ষার মাধ্যম এবং স্বাস্থ্যকর জীবনের অপরিচ্ছেদ্য অংশ- তা আমলে নেয়া হয় না। এর ফলে যেমন খাদ্য ঘাটতি হচ্ছে, তেমনি পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।

বৃক্ষ আমাদেরকে ছায়া দেয়। অক্সিজেন দেয়। একটি পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ দশজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের অক্সিজেন সরবরাহ করে। পঞ্চাশ বছরী একটি বৃক্ষের অবদান আর্থিক মূল্যে প্রায় এক লাখ আটাশি হাজার মার্কিন ডলার (ইন্ডিয়া বায়োলজিস্ট)। বৃক্ষ আমাদের জীবনের উপকরণ হিসেবেও ব্যবহার হয়। বৃক্ষনিধনের ফলে উষ্ণতা বাড়ে। এ উষ্ণতাজলবায়ু পরিবর্তনের কারণ, যাতে প্রকৃতি তার আপন গতি হারিয়ে ফেলছে। এর মন্দ প্রভাব পড়ছে মানুষ ও জীব-জন্তুর ওপর। দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের রোগ-ব্যাধি। হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুস্থ পরিবেশ। দূষিত হচ্ছে প্রাকৃতিক মৌলিক উপাদান-বায়ু, মাটি, পানি। এর প্রভাব পড়ছে মানবসৃষ্ট পরিবেশে, যার নির্মম পরিণতি অসুখ-অশান্তি। শিল্পায়নের ফলে মানবজীবনপদ্ধতি সহজতর হচ্ছে সত্য, তবে এর দ্বারা বিনষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য। জীবনযাত্রার মানকে অতি সহজিকরণ এবং ব্যবসায়িক অতি মুনাফাখোরি চিন্তা ও কর্মপরিবেশ বিনষ্টকরণকে ত্বরান্বিত করছে। তাই অনেকের মতে, যান্ত্রিক জীবন মানুষের জন্য সুখের চেয়ে দুঃখ বয়ে এনেছে বেশি। ডার্টি বা নোংরা ডজন তথা ১২টি রসায়নিক দ্রব্য খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে পৃথিবীর সর্বপ্রকার জীবজন্তুর ওপর তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটাচ্ছে। এ বিষাক্ত দ্রব্যগুলো ত্রুটিপূর্ণ শিশুর জন্ম, ক্যান্সার, ভ্রুণ বিকাশে বাধা ইত্যাদির প্রত্যক্ষ কারণ।

তাই এর মোকাবেলায় বৃক্ষরোপণ ও এর পরিচর্যা তথা বনায়নের বিকল্প নেই। কারণ, মানবচরিত্র একবার কোন সুবিধা ভোগ করলে তা পরিত্যাগ করতে পারে না। শিল্পায়নের ফলে প্রাপ্ত সুফল থেকে মানুষ আর ফিরে আসতে পারবে না। তবে সুস্থ পরিবেশের স্বার্থে শিল্পায়নকে যথাযথ নিয়মের আওতায় আনতে হবে। এর মোকাবেলা করতে হবে বৃক্ষরোপণ ও বনায়নের মাধ্যমে। এটা শুধু পরিবেশ বিজ্ঞানীদের কথা নয়; বরং এর গুরুত্বারোপ করেছেন বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা)। পবিত্র কুরআনে ২৬টি আয়াতে সরাসরি চাষাবাদ বা বৃক্ষরোপণ সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং কয়েকটি ফসল ও বৃক্ষের নাম সরাসরি উল্লেখ হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য তা (পানি) দিয়ে শস্য, জাইতুন, খেজুরগাছ, আঙ্গুর ও সব ধরনের ফল উৎপন্ন করেন। অবশ্য এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা নাহাল: ১১)। আল-কুরআনে ‘শাজার’ তথা বৃক্ষ শব্দটি উচ্চারণ হয়েছে ১৬ বার। পানিকে আখ্যায়িত করা হয়েছে সুস্থ পরিবেশ, সুস্থতা ও জীবন-জীবিকার উৎস হিসেবে। বর্তমানে পরিবেশের মৌলিক উপাদানগুলো দূষিত হচ্ছে নানাভাবে। মাটির ওপর চলছে বহুমুখী অবিচার। বায়ু দোষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলো দোষিত হচ্ছে মানবসৃষ্ট পরিবেশ তথা অপরিকল্পিতভাবে তৈরি বাড়ি-ঘর, দালান-কোটা, মিল-খারখানা ইত্যাদির কারণে।

ইসলামি শরিয়ার দৃষ্টিতে চাষাবাদ থেকে অর্জিত রুজি সর্বোত্তম। গাছ রোপন করার প্রতি আল্লাহর রাসূল (সা) নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন। পাশাপাশি বাগান করা, বাগান রক্ষা করা এবং ফসলি গাছ না কাটার জন্যও তিনি তাগিদ দিয়েছেন। যুদ্ধকালীন শত্রুপক্ষের গাছও নষ্ট করতে নিষেধ করা হয়েছে। ফসল নষ্ট করা ও ভূমিদোষণকে মুনাফিকদের অন্যতম চরিত্র বলা হয়েছে। অপ্রয়োজনে গাছ কাটতে নিষেধ করা হয়েছে। গাছে প্রাণ আছে- বিষয়টি পবিত্র হাদিসে উল্লেখ হয়েছে। কোন জমি যেন চাষাবাদহীন না থাকে, সে জন্য আল্লাহর নবি (সা) তাগিদ দিয়েছেন। বৃক্ষরোপন কর্মসূচির ব্যাপারে পবিত্র হাদিসে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এটাকে সদকায়ে জারিয়া বলা হয়েছে। কেউ যদি নেক আমলের জন্য শেষ সময় পায় তাকে বৃক্ষরোপন করার জন্য বলা হয়েছে।

বৃক্ষের ফল যদি কোন হিংস্র পশু-পাখীও খায় তাতেও বৃক্ষরোপনকারীর সাওয়াব আছে। কোন পাপী ব্যক্তিও যদি ফসল ভোগ করে তাতেও বৃক্তরোপনকারী সাওয়াবপাবে। এমনকি কেউ যদি ঐ গাছের ফসল চুরি করেও ভোগ করে তাতেও বৃক্ষরোপনকারীর সওয়াব কমবে না, যদিও চুরি করার কারণে চোর পাপী হিসেবে বিবেচিত হবে। কেউ একটি গাছ রোপন করল সেই গাছে ফল আসল। বৃক্ষরোপনকারীর গাছের ফসল এবং তার ফসলের দানা থেকে যতদিন গাছ হতে থাকবে এবং এর ফসলা মানুষ বা প্রাণী উপকৃত হতে থাকবে ততদিন পর্যন্ত প্রথম চারারোপনকারীর আমলনামায় সাওয়াব লিপিবদ্ধ হতে থাকবে। বলা হয়েছে, ‘কোন মুসলমান যদি একটি চারা রোপন করে অথবা কোন জমি চাষ করে আর সেটা থেকে কোন পাখী, মানুষ অথবা পশু আহার করে এটা তার (বৃক্ষরোপনকরীর) জন্য ছদকা (দান) করার আমলের সাওয়াব হবে।’ (বুখারি: ২৩২০)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘কোন মুসলমানের রোপিত গাছেরফসল যখন খাওয়া হয় তখন রোপনকারী ছদকার সাওয়াবপায়। সেটি কেউ চুরি করে খায় তাতে ছদকার সাওয়াব পাবে। কোন হিং¯্র প্রাণী সেই সাওয়াব পাবে। কোন পশুও যদি ভক্ষণ করে তাতেও সে সাওয়াব পাবে।’ (মুসলিম: ১৫৫২)।

বৈশ্বিক মহামারিতে এ বছর বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির প্রচার-প্রসার ও বাস্তবায়ন পূর্বের ন্যায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে না-ও হতে পারে। কিন্তু প্রায় ১৮ কোটি নাগরিকের প্রত্যেকজন যদি গড়ে একটি করে চারা লাগায় তাহলে বাংলাদেশ সবুজের বিপ্লব হবে। এতে পরিবেশ সুরক্ষা পাবে। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হবে। খাদ্যে স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি পাবে। মহামারিতে দুর্ভিক্ষের কল্পিত ভয়কে জয় করা যাবে। এর জন্য আগাম প্রস্তুতি হলো চাষাবাদ, কৃষিকাজ ও বৃক্ষরোপণে জোর দেয়া। এটি নাগরিক হিসেবে যেমন দায়িত্ব তেমনি ধর্মীয় দৃষ্টিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই বৃক্ষরোপণের ফযিলতের বিষয়গুলো মসজিদের মিম্বর থেকেও উচ্চারিত হওয়া উচিৎ। পবিত্র কুরআন-হাদিসে ইমান-আমলের পাশাপাশি মানুষের জীবনঘনিষ্ট বিষয়গুলোর প্রতিও তাগিদ দেয়া হয়েছে।

প্রত্যেক হাদিসের কিতাবে ‘কিতাবুল মুসাকাকা ওয়াল মুযারায়াত’ তথা সেচ ও চাষাবাদ বিষয়ক অধ্যায় রয়েছে। যাতে বহু হাদিস সন্নিবেশিত হয়েছে। ছহিহ মুসলিমে সরাসরি এ বিষয়ক সাতটি হাদিস রয়েছে। বক্ষমান প্রবন্ধের শিরোনামটিও উক্ত গ্রন্থের একটি পরিচ্ছেদের শিরোনাম। অতএব এগুলোর বর্ণনা জাতির সামনে আসা উচিৎ। পরিবেশ রক্ষা, সুস্বাস্থ্য, সচেতনতা সৃষ্টির জন্য জুমার খুতবা একটি শক্তিশালী মাধ্যম।ইমাম-খতিবগণ পার্থিব জীবনঘনিষ্ট বিষয়ে কুরআন-হাদিসের আলোকে বয়ান করলে আগামী দিনের সচেতন নাগরিক সৃষ্টি ও কল্যাণকর পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে। বর্তমান প্রজন্ম এমন বয়ান শুনতে আগ্রহী। এর মাধ্যমে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বও প্রকাশ পাবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক মুফতি, চট্টগ্রাম নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসা।

 

 

 

 

 

 

 

পূর্বকোণ/আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট