চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ইতিহাসের আলোকে ঈদ ও সময়ের প্রেক্ষিত

আজাদ মণ্ডল

৪ মে, ২০১৯ | ২:৪৯ অপরাহ্ণ

ইতিহাসের আলোকে
ঈদ ও সময়ের প্রেক্ষিত
আজাদ মণ্ডল
আমরা সবাই জানি, ঈদ মানে খুশি ঈদ মানে আনন্দ। প্রতি বছর ইসলাম ধর্মালম্বীদের জীবনে ফিরে আসে খুশি আর আনন্দের ঈদ। ঈদের সামাজিক আর আভিধানিক অর্থই হলো যথাক্রমে উৎসব আর পুনরাগমন বা বারবার ফিরে আসা। মূলত ঈদের আনন্দ বা উৎসব দুটি। প্রথমটি ঈদ-উল-ফিতর বা রোজার ঈদ, দীর্ঘ একমাস রোজা রাখা বা সিয়াম সাধনার পর সমগ্র মুসলিম জাহানে পালিত হয় এই উৎসব, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ঈদ-উল-আজাহা বা কোরবানির ঈদ। সারা বিশ্বের ইসলাম ধর্মালম্বীগণ ঈদের উৎসব পালন করে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য আর আনন্দের সাথে। অপরিসীম ত্যাগ-তিতীক্ষা আর ভ্রাতৃত্বের মিল-বন্ধনে ইদের আনন্দে ধনী-গরিব, আপন-পর, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এক অপার মানবিকবোধে। জাতি ধর্ম বর্ণ সর্বপ্রকার ভেদাভেদ ভুলে ঈদের উৎসব সবাই পালন করে হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে।
পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি বা গোষ্ঠীর বিভিন্ন ধর্মে যেসব প্রধানতম ধর্মীয় উৎসব উদযাপিত হয়, সেগুলোর মধ্য ঈদ-উল-ফিতর হচ্ছে সময়ের হিসেবে কনিষ্ঠতম। কিন্তু এর আয়োজন-প্রয়োজন ব্যাপকতর এবং সর্বোচ্চ উচ্চাসীন। এই সু-মহান ও চির-শান্তিময় উৎসবের পালন শুরু হয় প্রায় ১৪০০ সৌরবছর আগে থেকে। ইসলাম ধর্মের প্রর্বতক এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মদিনাতে হিযরতের অব্যবহিত পরই ঈদ-উল-ফিতর উৎসব পালন শুরু হয়। তৎকালিন আরবদের ধ্যান-ধারণা জাহেলি প্রথার পরিবর্তে দুই মানবতাবাদী ঈদ ছিল মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে মুসলমানদের জন্য অনন্য এক ঘোষিত উপহার।
ইসলামি আদর্শে উজ্জীবিত আরববাসীগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নির্দেশে শুরু করল ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা উৎসব। এর আগে পৌত্তলিক ভাবনায় অগ্নিপূজকদের নওরোজ এবং মূর্তিবাদীদের মিহিরজা নামে দুটি উৎসবে মদিনাবাসী শরিক হতো। আরবরা এই মেলায় অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ,আদিম উচ্ছলতায় মেতে উঠত। এই বিকৃত-মস্তিষ্ক, ন্যায়-নীতি বিবর্জিত খেয়ালখুশির লীলা ছিল উচ্চবিত্তের এক চরম খেয়ালিপনার উৎসব। এর পরিবর্তে জন্ম নিলো শ্রেণিবৈষম্য-বিবর্জিত ,অশ্লীল-কুরুচিমুক্ত ইবাদতের আমেজমাখা সদা-সুন্দর, মন-প্রাণ আর খুশি- আনন্দভরা ঈদ উৎসব। আমেজের দিক থেকে স্নিগ্ধ, নির্মল, আচরণের দিক থেকে হৃদয় উজাড় করা প্রীতি আর মিলনের উৎসব ঈদ-উল-ফিতর। ইসলাম ধর্মের আবর্তে এই উৎসব হলেও সাম্য-মৈত্রী, শান্তি-সম্প্রীতির ধর্ম ও ঈদের অর্থ আনন্দ বিধায় ঈদ সব মানবের তরেই কল্যাণ বয়ে আনে। তাই সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ ঈদ উৎসবে আনন্দ করে এক হয়ে।
এই যে ঈদ, আমাদের দেশে এই উৎসব প্রথমে কীভাবে উদ্ভব হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস ও তথ্য বৃতান্ত আজও জানা যায়নি। তবে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশ মুসলিম শাসনের অধিকারে এলেও এদেশে নামাজ, রোজা ও ঈদ উৎসবের প্রচলন শুরু হয়েছিল তার অনেক আগে থেকেই। বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ ও ঐতিহাসিক সূত্র এই তথ্যই প্রদান করে।
এদেশ মুসলিম অধিগ্রহনের অনেক আগে থেকেই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলিম সুফি, দরবেশ ও সাধকগণ ধর্ম-প্রচারের লক্ষ্যে উত্তর ভারত হয়ে পূর্ব-বাংলায় আসেন। বাণিজ্যিক সম্পর্কের জন্যও অনেক আরবীয় ও অন্যান্য মুসলিম দেশের বণিকেরা চট্টগ্রাম নৌ-বন্দেরের মধ্যমে এদেশের সাথে পরিচিত হন। এভাবেই মুসলিম সাংস্কৃতিক তথা তাদের একটি ধর্মীয় প্রভাব এদেশের মানুষের উপড় পড়েছিল।
এ বিষয়ে নানান ইতিহাসগ্রন্থ পর্যালোচনা করলে আরও দেয়া যায় খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকেই বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন ঘটে এবং মনে করা হয় এই সুফি, দরবেশ, তুর্কী, আরব বণিকদের হাত ধরেই বর্তমানের বাংলাদেশের নামাজ রোজা ঈদের সূত্রপাত হয়েছিল। তবে তা পালন ছিল একান্তই ঐসব আগমনকারীদের।
এই দেশে প্রথম রোজা পালনের ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় তাসকিরাতুন সালহা নামক গ্রন্থে। এই গ্রন্থের আলোকে দেখা যায়, শেখউল খিদা নামক জৈনিক আরবীয় ঢাকায় আসেন। তিনি চন্দবংশীয় রাজা শ্রী চন্দের শাসনকালে ( ৯০৫-৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় আগমন করে বলে মনে করা হয়। বঙ্গদেশে ইসলাম আগমন পূর্বকালে শাহ সুলতান রুমি নেত্রকোনা এবং বাবা আদম শহীদ বিক্রমপুরের রামপালে আস্তনা গেড়ে ইসলাম প্রচার শুরু করেন বলে জানা যায়। তবে এদের প্রভাবে পূর্ব বাংলায় রোজা, নামাজ ও ঈদ প্রচলিত হয়েছিল, তা বলা সমীচীন নয়। এরা ব্যক্তিগত জীবনে ওইসব ইসলাম ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব পালন করতেন একথা বলাই সঙ্গত।
ঢাকার ইতিহাসবিদ হাকিম হাবীবুর রহমান বলেছেন, ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবেদার শাহ সুজার নির্দেশে তাঁর প্রধান আমাত্য মীর আবুল কাশেম একটি ঈদগাহের নির্মাণ করেন। ঈদগাটি ভুমি থেকে ১২ ফুট উঁচুতে, যার দৈর্ঘ্য ছিল ২৪৫ ফুট এবং প্রস্থে ছিল ১৩৭ ফুট। ঈদগাহের পশ্চিম দিকে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে সেখানে মেহেরাব ও মিনার নির্মাণ করা হয়। মুগল আমলে দরবার, আদালত, বাজার ও সৈন্য ছাউনির কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল এই ঈদগাহ। প্রথম দিকে কেবল অভিজাত মুঘল কর্মকর্তা এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনরাই এখানে নামাজ পড়তে পারতেন । পরে অবশ্য সকলের জন্য ঈদগাহটি উম্মক্ত করে দেওয়া হয়। উনিশ শতকের শেষদিকে এর পাশে একটি মেলারও তারা আয়োজন করে।
বাংলা একাডেমির পরিচালক শামসুজ্জামান খান তাঁর বাংলায় ঈদ, বাঙালির ঈদ’ নিবন্ধে বলেছেন, “ঈদোৎসব শাস্ত্রীয় ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তবে দ্বাদশ শতকে বাংলায় ইসলাম এলেও চার/পাঁচশত বছর ধরে শাস্ত্রীয় ইসলামের অনুপুঙ্খ অনুসরণ যে হয়েছিল তেমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। সেকালের বাংলায় ঈদোৎসবেও তেমন কোন ঘটা লক্ষ্য করা যায় না। এর কারণ হয়ত দুটি: এক, গ্রাম-বাংলার মুসলমানরা ছিল দরিদ্র; দুই, মুসলমানদের মধ্য স্বতন্ত্র কমিউনিটিবোধ তখনো তেমন প্রবল হয়নি। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে একটা সামাজিক ভিত্তির উপড় দাঁড় করানোর অবস্থা তখনো সৃষ্টি হয়নি। আর এটাতো জানা কথা যে সংহত সমাজভিত্তি ছাড়া কোন উৎসবই প্রতিষ্ঠা লাভ করে না। বৃহৎ বাংলায় ইদোৎসব সপ্তদশ, অষ্টাদশ এমনকি ঊনবিংশতকেও তেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। নবাব-বাদশারা ইদোৎসব করতেন, তবে তা সীমিত ছিল অভিজাত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে, সাধারণ মানুষের কাছে সামাজিক উৎসব হিসেবে ইদের তেমন কোনো তৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল না। তবে গোটা ঊনিশশতক ধরে বাংলাদেশে যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন চলে তার প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পড়েছে নগর জীবন ও গ্রামীণ অর্থবিত্তশালী বা শিক্ষিত সমাজের উপড়। মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাও এই চেতনাকে শক্তিশালী করেছে। আর তাই এই অনুকূল পরিবেশেই ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে এক শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেন্দ্রে রেখে পরিচালিত বাংলাদেশ আন্দোলন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার যে নবরূপায়ণ ঘটেছে তাতে ঈদোৎসব রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে নতুন গুরুত্ব পেয়েছে।”
ঊনিশশতকের শেষের দিকে ঈদের আনুষঙ্গিক আনন্দ হিসেবে যুক্ত হয় একটি লোকজ মেলা, এই মেলা মুঘল আমলে যে ঈদমেলা হতো তার থেকে বহুগুণে ব্যপকতর, দেশের সর্বস্তরের মানুষ এতে সমানভাবে আনন্দ উপভোগ করে, বর্তমান সময়েও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেই ধারাবাহিকতায় ইদমেলার আয়োজন করা হয়। সামর্থ্যও জোড়াতালির ভিতরেও ঈদমেলা এখন অনেক বেশি জমজমাট ও উৎসবমুখর।
বর্তমান সময়ে দেশের প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ঈদের ব্যপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ঈদকে সামনে রেখে দেশের ঈদের বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে, সেই সাথে চাঙ্গা হয়ে ওঠে অর্থনীতি। ঈদের নতুন পোষাক কেনা ছাড়াও রয়েছে আরো হরেক রকমের কেনাকাটার প্রস্ততি। ঈদ উপলক্ষ্যে প্রবাসিরা বিপুল পরিমাণে রেমিটেন্স দেশে পাঠায়, ফলে ঈদের সময় গ্রামীণ অর্থনীতির বাজারও চাঙ্গা হয়ে উঠে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর লেনদেন এ সময় অনেকগুন বেড়ে যায়। দেশ বা সমাজের ধনীক সম্প্রদায় ইদ উপলক্ষে যাকাত-ফেতরা গরিবদের দান করে ঈদের উৎসব উদ্ভাসিত করে তুলে।
সামাজিক মিল-বন্ধন অটুটের সবচেয়ে কার্যকরি উৎসব হলো ঈদ। ঈদ উৎসবে মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে যায় আপনজনদের কাছে, আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশি সকলে মিলে মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে পালন করে ঈদ উৎসব। সরকারি-বেসরকারি সকল প্রকার প্রতিষ্ঠান ইদ উপলক্ষে ছুটি প্রদান করে। দেশের টিভি চ্যানেলগুলো ঈদ উপলক্ষে প্রচার করে বিভিন্ন মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান, জাতীয় পত্রিকাগুলো প্রকাশ করে ঈদের বিশেষ সংখ্যা।
মুসলমানদের জীবনে ঈদের তাৎপর্য অনেক, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একই কাতারে মানবসম্প্রীতির এক অনবদ্য নিদর্শন পবিত্র ঈদ।
তবুও আজকের দিনে ঈদ উৎসবকে ঘিরে কিছু নিন্দনীয় কর্মকা-ও লক্ষ্য করা যায়। লোক দেখানো দান-খয়রাতের হীনকাজ যেন অহরহ চলে সমাজে। অনেক সময় তাতে করে অনেক গরিব মানুষের প্রাণ পর্যন্ত চলে যায়। ‘অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই’ ইসলামের এই চিরন্তণসুন্দর বাণীর তোয়াক্কা না করে অনেকেই কেনাকাটার এক ঘৃণ্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কেউ কেউ বিদেশ যেয়েও ঈদের কেনাকাটা করতে দ্বিধা করে না। অমিতব্যয়ী ভ্রষ্ট অহমিকায় পর্যবসিত হয় মূল ঈদোৎসব। উৎসবে আতশবাজির আলোকে ¤্রয়িমাণ করে তুলে ধর্মীম ভাব-গাম্ভীর্যের পবিত্রতা।
মহান রাব্বুল আলামিন উম্মতে মুহাম্মাদীকে দুটো ঈদ প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন, এর অন্তনিহিত মর্মের আলোকে উত্তম ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে বলিয়ান হয়ে দেশ তথা সমাজের সবার মাঝে ঈদ উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে উদ্যাপন করাই হবে প্রকৃত মুসলমানের বৈশিষ্ট্য তথা নবী মুহাম্মদের প্রকৃত উম্মতের কাজ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট