চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ, আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার

পূর্বে প্রকাশিত হবার পর থেকে

মো. সেলিমুজ্জমান মজুমদার

২৮ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:১৩ পূর্বাহ্ণ

এ পর্বে আচরণিক, ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে লেখা। অল্প কথায় মানুষের বাহ্যিক ও দৃশ্যমান কাজকর্মই হলো আচরণ। ব্যক্তির এ আচরণই অন্যের নিকট ব্যক্তি সম্পর্কে ভাল-মন্দ ধারণা দেয়। মানুষের আচরণের ভাবধারা এতটাই শক্তিশালী যে কেউ তার আচরণ দ্বারা অন্যদের চিন্তার জগতে ঝড় তুলতে পারে, ভেঙে দিতে পারে দীর্ঘদিনের জমা থাকা বাধার দেয়াল, দূর করতে পারে অবিশ^াস ও বিদ্বেষের বহমান ধারা। আবার ব্যক্তির নেতিবাচক আচরণও একইভাবে অন্যদের দীর্ঘদিনের আস্থা ও সুধারণাকে নিঃশেষ করে দিতে পারে। মানুষের আচরণকে বাহ্যিক (ড়াবৎঃ) এবং অভ্যন্তরীণ (পড়হাবৎঃ)-এ দুভাগে ভাগ করা যায়। মানুষের যে সকল আচরণকে বাহ্যিকভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। যেমন- তার কাজ, কথাবার্তা, হাব-ভাব, স্বভাব চরিত্র ইত্যাদি।

অন্যদিকে মানুষের যে সকল আচরণ বাহ্যিকভাবে দৃষ্টিগোচরযোগ্য নয়, যেমন- মানুষের চিন্তা, চেতনা, স্বপ্ন আবেগ, অনুভূতি ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ আচরণ। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। প্রতিটি মানুষ মর্যাদাবান। বুদ্ধিদীপ্ত জীব হওয়ায় সৃষ্টির সকল বিষয়ের উপর স্বীয় শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে মানুষ ওয়াকিবহাল। মানব জাতি হিসেবেই নয় ব্যক্তি হিসেবেও প্রতিটি মানুষ অন্যের নিকট থেকে তার মর্যাদা প্রত্যাশা করে। আগেই বলেছি যে, প্রতিটি মানুষকে ‘৩স’- থিউরি মেনে চলা উচিত। ৩স’-এর একটি হলো ‘সদাচারণ।’ একজন শিক্ষকের মনে নিশ^াসের মত তাঁর সদাচারণবোধ জাগ্রত রাখা উচিত। শ্রেণিকক্ষের প্রায় সব ছাত্র-ছাত্রীই সচেতন এবং ভাল মন্দ, উচিত-অনুচিত বিষয়ে ওয়াকিবহাল। তাদের সাথে শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ করা হলে তারা মর্মাহত হয়। তাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হলে কর্মক্ষেত্রে তারা বিড়ম্বনা বা হয়রানির শিকার হলে বর্ণ, ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, বয়স, মেধা সর্বোপরি পড়ালেখা বিষয়ে অতি শাসন, অনুশাসন, ভাষণ ইত্যাদি ভেদে অবিচার করা হলে, তারা দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হয়। তাই, শিক্ষকদের মনে রাখা উচিত, শিক্ষক তাঁর নিজ স্বার্থ, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের স্বার্থ দেখা এবং যতটা সম্ভব শিক্ষার্থীদের সাথে নৈতিক ব্যবহার করা। আমাদের মনে রাখা উচিত জীবনে সংঘটিত ৮০% কাজই আচরণ সংশ্লিষ্ট যা’ মৃত্যুর পর জায়নামাজ শেষে কবরে শায়িত করার আগে সমবেত মুসল্লিদের ৩ বার জিজ্ঞাস করা হয় ‘মৃত ব্যক্তি কেমন ছিলেন?’

প্রাচীনকাল থেকেই শিক্ষালয়ে কখন আসতে হবে, কিভাবে বসতে হবে, কিভাবে কথা বলতে হবে, কখন কি পড়তে হবে, চলতে হবে, ফিরতে হবে, কিভাবে শিক্ষকের অনুগত হতে হবে- এরকম হাজারো নিয়ম-কানুন শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেয়া হতো। এরকম অনুশাসনকে শ্রেণি শৃঙ্খলা বলা হতো। ‘হাজেরা-তজু স্কুল এন্ড কলেজ’ এবং একই সঙ্গে ‘চিটাগাং কি-ারগার্টেন স্কুলের প্রতিষ্ঠালগ্নের ডায়েরী রচনা করার এক দুর্লভ সুযোগ আমি পেয়েছি। দুটি প্রতিষ্ঠানের ডায়েরী প্রস্তুত করার জন্য আমি চট্টগ্রাম
মহানগরীর নাম করা প্রায় ২০টিরও অধিক শিক্ষালয়ের ডায়েরী যোগাড় করি। এসব ডায়েরীতে শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয়ের নিয়ম কানুন সম্পর্কিত রাশি রাশি শর্ত জুড়ে শৃঙ্খলার নামে ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকদের ওপর স্বৈরতান্ত্রিক অনুশাসন চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। মানবিকতার বালাই নেই, আইনের মান্যতা নেই, পবিত্র সংবিধানের স্পর্শ

নেই- মনের মাধুরী মাখিয়ে তাও আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর অসংখ্য নিয়ম কানুন চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি অবাক হলাম। এসব অনাচার দেখার, বুঝি কেউই নেই। একটি স্বাধীন দেশে কীভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর নিয়মের দোহাই দিয়ে অনিয়ম চলছে?

সুপ্রিয় পাঠক, আপনারা জানেন যে, শিক্ষালয় কিংবা শ্রেণিকক্ষে শৃঙ্খলা চাপিয়ে দেয়ার বিষয় এবং ইহা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়ও নয়, উপযুক্ত পরিবেশ থাকলে শিক্ষালয় কিংবা শ্রেণিকক্ষে শৃঙ্খলা এমনিতেই এসে যাবে। এ বিষয়ে সম্প্রতি একটি বেসরকারী সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত জরিপের ফল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। শিক্ষালয়গামী ৩৩ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আশপাশের পরিবেশকে অনিরাপদ মনে করে। অনেক প্রতিষ্ঠানে পাহারাদার নেই, নির্যাতনের শিকার হতে হয় অন্য শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের দ্বারা। শিক্ষালয়ে যাতায়াতের পথেও হয়রানির শিকার হতে হয় অনেককে। এটা স্বস্তিকর কোন তথ্য নয়। শিক্ষার্থীরা নরম মাটি তুল্য যারা অনুকরণ প্রিয়। এরা শিক্ষালয় শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক ও চারপাশের পরিবেশ হতে যা দেখে শোনে তা মস্তিষ্কে গ্রোথিত করে। বস্তুত এ শিক্ষা ব্যক্তিগত জীবনেও প্রয়োগ করে। এ শিক্ষার মধ্যে যদি নেতিবাচক আলামত থাকে তবে তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় শিক্ষার্থীর জীবনাচরণেও। অনেক স্কুলের দেওয়ালে গেইটে এবং টয়লেটের ভিতর বাইরে অশ্লীল ছবি ও আপত্তিকর লেখা থাকে। অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকার নামেও অনেকে দেওয়াল, টয়লেট এবং মোবাইল ফোনেও

কুরুচিপূর্ণ কথা উক্তি, আঁকা লেখা বাইরের কেহ যেমন করতে পারে তেমনি অসৎ সঙ্গে বিপথগামী কোনো শিক্ষার্থীও করতে পারে। যারাই করুক না কেন, এর প্রভাব পড়ে সব শিক্ষার্থীর ওপর। একথাও সত্য যে, একজন শিক্ষার্থী বাইরের যে জগতে বড় হয়, তার প্রতিফলন পড়ে শিক্ষালয় সর্বোপরি, শ্রেণিকক্ষের পরিবেশেও। আমার আদরের ছাত্র-ছাত্রীদের বলি, তোমরা এসব অনাচার থেকে দূরে থাকবে। মা-বাবা এবং শিক্ষকদের কেবল সম্মান করলে, সালাম-আদাব করলেই চলবে না বরং তাঁদের জুতা-সেন্ডেলকে পর্যন্ত যত্ন করবে, তাঁদের মান্য করবে, তাঁদের পায়ের জুতা তোমার মাথার মুকুটতুল্য সম্মান করবে। তবেই তুমি বিনয়ী, তবেই তুমি সত্যিকারের জ্ঞানী ব্যক্তি। আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমাদের নজরকাড়া শিক্ষার্থী। একই কথা শিক্ষকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শিক্ষক যত বেশী ন¤্র-ভদ্র, সদাচারণী হবেন, যত বেশী ছাত্র বান্ধব হবেন, ছাত্রদের সহযোগী হবেন তিনি তত বেশী শিক্ষার্থীর নিকট গ্রহণযোগ্য ও আদর্শ শিক্ষক হবেন। একশ্রেণির শিক্ষককে জাতীয় প্রচার মাধ্যমে বিশেষ করে টক শো/শিক্ষালয়/ শ্রেণিকক্ষে দলের আদর্শপুষ্ট হয়ে দলের পক্ষে সাফাই গাইতে দেখি। হাটে-মাঠে, রাজনৈতিক মঞ্চে, সভায়, দোকান-পাঠ, বিয়ে বাড়িতে সর্বোপরি শ্রেণিকক্ষে কখনো এরূপ আলোচনায় যুক্ত হওয়া উচিত নয়। একথা, একজন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের মেধা বিকাশের শ্রেষ্ঠ স্থান হচ্ছে শ্রেণিকক্ষ। যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষকে যত বেশি কাজে লাগাতে পারে সে তত বেশী সফল হবে। এজন্যে সকল পক্ষকে শ্রেণিকক্ষে মনোযোগী হবার জন্য বারংবার তাগাদা দিই। শ্রেণিকক্ষে ৪ প্রকার শিক্ষককে আমরা দেখি। হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিষয়ের এক অধ্যাপক’র (নাম না বলা স্বত্তে) এ ৪ প্রকার শিক্ষক হলেন যথা- প্রভাষক বা লেকচারার, তিনি নিজে পড়েন এবং শিক্ষার্থীদের পড়ান। দ্বিতীয় জন হলেন, সহকারী অধ্যাপক : তিনি পড়ান কিন্তু নিজে পড়েন না।

তৃতীয় জন হলেন, প্রফেসর : তিনি নিজে পড়েনও না এবং পড়ানও না। আর চতুর্থ জন হলেন, অধ্যক্ষ­- যিনি পড়েনও না, পড়ানও না। এবং ক্লাসও করান না।’ বলা বাহুল্য যে, এর ব্যতিক্রমও আছে যাঁরা আমাদের অনুকরণীয় আদর্শবান শিক্ষক।
আবার শ্রেণিকক্ষে ৩ প্রকার শিক্ষার্থীর দেখা পাই। এক প্রকার শিক্ষার্থী আছে যারা শিক্ষকের লেকচার এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে- এরা অমনোযোগী। আরেক প্রকার শিক্ষার্থী- শিক্ষকের লেকচার কান দিয়ে শুনে ঠিকই কিন্তু কতক্ষণ পরই তা ভুলে যায়- এদেরকেও আমরা অমনোযোগী বলি। অন্য আরেক প্রকার শিক্ষার্থী আছে যারা শিক্ষকের লেকচার কান দিয়ে শুনে, গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট সাথে সাথে খাতায় লিখে নেয় এবং ঘরে গিয়ে বিষয়বস্তু বুঝার চেষ্টা করে, রিভাইজ দেয়- আসলে এরাই মনোযোগী।
এ পর্যায়ে শ্রেণিকক্ষে আদব কায়দা ও শিষ্টাচার সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলি।
প শিক্ষক ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখাবে এবং শিক্ষক সালাম-আদাব, গুড মর্নিং… বললে সাথে সাথে এর জবাব দিবে।

প ক্লাস হলো লেখা, পড়া, শোনা ও বলার স্থান, তবে এসব কেবল শিক্ষকের সাথে কোনো শিক্ষার্থীর সাথে নয়। ঘনিষ্টজনের সাথে কখনো ক্লাসে বসবে না। মনে রেখো, যার সাথে তোমার ঘনিষ্টতা তার সাথেই তোমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা,
প প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশগ্রহণ করবে এবং অতি সংক্ষেপে শোনা এবং লেখা দুটি কাজই শ্রেণিকক্ষে করতে হবে।
প ক্লাস চলাকালে সহপাঠীদের সাথে দুষ্টুমি করবে না, জানালা দিয়ে তাকাবে না, মোবাইল ব্যবহার করবে না। প্রস্রাব-পায়খানা কিংবা বেতন দেয়া কিংবা স্কাউটিংয়ে যোগ দেয়া বা সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের নামে ক্লাস বাদ দেয়া যাবে না।
প প্রাইভেট-কোচিংয়ের মাধ্যমে পরীক্ষায় প্রস্তুতি নিতে পার, এসব তোমার সহায়ক হতে পারে। কখনো ক্লাসের বিকল্প হতে পারে না।
প শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ে একের প্রতি অপরে শুভেচ্ছা সালাম-আদাব বিনিময়ের মাধ্যমে ক্লাস শেষ করা।
ডিসকাস করা, লেকচার শোনা, লেখা, পড়া, বলা, বাড়ির কাজ আদায়, ক্লাসের পাঠে অংশগ্রহণ, ভাবের বিনিময়, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করাসহ সব কিছু মিলে পৃথিবীর সর্বোকৃষ্ট শিক্ষার স্থান হল শ্রেণিকক্ষ। অব্যাহত এ মিলন স্থানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য দোয়া করবে।

আদব-কায়দা, বিনয়-ন¤্রতা ও ভদ্রতায় একে অপরকে উচ্চ মাত্রায় নিয়ে যাবে। শ্রেণিকক্ষে ন্যূনতম শিষ্টাচার যথা- ৩স’ সত্যবাদিতা, সময়ানুবর্তিতা এবং সদাচারণ বজায় রাখতে হবে ছাত্র শিক্ষক সবাইকে। আর সঠিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি এবং কলুষমুক্ত মন, শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের পূর্বে পবিত্র হওয়া গভীর মনোযোগসহকারে সৃষ্টিকর্তার সহায়তা কামনা, ধৈর্য্য সহকারে শ্রেণিকার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া, প্রাণবন্ত থাকা, শরীর মন সুস্থ না থাকলে শ্রেণিতে আসা উচিত নয়, শ্রেণি কার্যক্রম ভালো করে বুঝা, ভান করে হলেও বুঝার ও শান্ত থাকার চেষ্টা করা এবং শ্রেণির লেখাপড়ার জন্য আফসোস করা। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট যে কোন বিষয়ে শ্রেণিকক্ষ এমন কী শ্রেণির বাইরে ছাত্র-শিক্ষক একে অপরের সাথে মমতার সম্পর্ক বজায় রাখা। শ্রেণি কার্যক্রমে যা করা উচিত তা করা এবং যা উচিত নয় তা না করা। (সমাপ্ত)

লেখক : শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিষয়ক কলামিস্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট