চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সময়ের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা

সৈয়দা আমাতুল্লাহ্ আরজু

৬ মে, ২০১৯ | ১:৩১ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষা নির্মল, শিক্ষাই বেশ,
শিক্ষায় গড়ব সোনার বাংলাদেশ।
শিক্ষিত দেশ, শিক্ষিত সমাজ, শিক্ষিত জাতি, স্বশিক্ষিত মানুষ তৈরির প্রারম্ভিক স্তর প্রাথমিক শিক্ষা। শিক্ষার আলোয় আলোকিত ব্যক্তি এবং জাতি সবসময় উন্নতির চরম শিখরে অবস্থান করে। শিক্ষা তখনই এরূপ যোগ্যতা সম্পন্ন মানব জাতি তৈরি করতে সমর্থ হয় যখন শিক্ষা হয় মানসম্মত। প্রত্যেক দেশেই জাতীয়
আশা-আকাঙ্খার এবং আদর্শের প্রতিফলন ঘটে প্রাথমিক শিক্ষায়। প্রাথমিক শিক্ষা যে দেশে যত বেশি সুষ্ঠুভাবে দেয়া হয় সে দেশ তত বেশি উন্নত। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তিভূমি দূর্বল হলে ব্যক্তির জীবনেতো বটেই, জাতীয়, সমাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর ও তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। আর মানসম্মত আধুনিক, যুগোপযোগী শিক্ষাই পারে জাতিকে আলোকিত, যোগ্য, দক্ষ করে গড়ে তুলতে। তাই দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সবার জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা দরকার।
জাতিসংঘ সংস্রাব্দ লক্ষ্য মাত্রার অধিকাংশ অর্জনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২০০০ সালে জাতিসংঘ ১৫ বছরে ৮টি সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা বা মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমভিজি) অর্জনের টার্গেট ঘোষনা করে। এ টার্গেট পূরণে জাতিসংঘ তার ১৮৯ সদস্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে যে প্রতিশ্রুতি আদায় করে, সে প্রতিশ্রুতি আদায়ে বাংলাদেশ যার প্রায় সবকটি লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন করে। নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানো, শিক্ষা ক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা অর্জন, ঝরে পড়া শিশুদের প্রাথমিক স্কুলমুখী করা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমডিজির লক্ষ্যমাত্র অর্জনের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে ব্যাপক প্রশংসিত হয়ছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ হয়ে ওঠেছে অনেক দেশের কাছে অনুকরণীয়। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (ঝউএং) হলো ভবিষ্যত আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত একগুচ্ছ লক্ষ্যমাত্রা। ২০১৬ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭টি টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। এর মধ্যে চার নম্বর লক্ষ্যমাত্রা হলো ‘‘মানসম্মত শিক্ষা অন্তর্ভূক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা’’। আর এ লক্ষ্য অর্জনে প্রথমেই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মানসম্মত সার্বজনীন সমতাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা সবার কাছে পৌঁছে দিতে বর্তমান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে অভাবনীয় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যা বিগত দশবছর আগেও ছিল অকল্পনীয়। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। মানসম্মত প্রথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করণে নিষ্ঠার সহিত কাজ করছে কর্মকর্তা, শিক্ষক, কর্মচারী, জনপ্রতিনিধিসহ বিদ্যালয়ের স্টকহোল্ডারগণ। সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে ঝরে পড়ার হার কমেছে। দিন দিন কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়গামী হচ্ছে।
নি¤েœাক্ত পদক্ষেপ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করণে ভূমিকা রাখেছে-
১। ১ জানুয়ারী বই উৎসবের মধ্য দিয়ে সকল শিক্ষার্থীর হাতে এক যোগে দেয়া হচ্ছে নতুন বই। যা বিগত ১০ বছর আগে ও আমাদের স্বপ্নছিল। আর শিক্ষার্থীর বয়স, চাহিদা, সামর্থ্য, সৃজনশীলতা বিকাশ এসব নিরিখে প্রণিত হয়েছে এনসিচিবি কর্তৃক প্রাথমিকের কারিকুলাম।
২। ২০১৮ সালের ৮ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহবানে প্রাথমিক ও গণ শিক্ষামন্ত্রণালয়ের প্রাক্তণ মাননীয় মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার মহোদয় সারা বাংলাদেশের সকল কর্মকতাদের সাথে মিড ডে মিল বাস্তবায়ন করার মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ যুগান্তকারী পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হয় সবার নিরলস প্রচেষ্ঠায়। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে উৎসাহ, উদ্দীপনা, সহনশীলতা বেড়েছে। আর বেড়েছে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার।
৩। প্রতিটি বিদ্যালয়ে সু-সজ্জিত প্রাকপ্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ চালুর পাশাপাশি আলাদা শিক্ষক নিয়োগসহ শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিকে দুই বছর মেয়াদী শ্রেণি কার্যক্রম ৪+ থেকে ভর্তি করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হচ্ছে। উক্ত শ্রেণী সজ্জিতকরণে সরকারের আলাদা বরাদ্দ যা মনোরম পরিবেশে আনন্দ উৎসাহের সাথে খেলার চলে শিশুরা শিক্ষা গ্রহণ করার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে।
৪। সকল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌর এলাকাসহ শত ভাগ উপবৃত্তি দেয়ার মাধ্যমে হত দরিদ্র শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়গামী হয়েছে। এতে ঝরে পড়ার হার কমেছে।
৫। প্রতি মাসেই অনুষ্ঠিত হয় মাসমাবেশ। এতে করে অশিক্ষিত মায়েরা ও সন্তানেদের শিক্ষার ব্যাপারে মনোযোগী হচ্ছেন এবং লেখাপড়ার খোঁজ খবর নেয়ার সুয়োগ পাচ্ছেন।
৬। প্রতি বছর (ঝখওচ) বরাদ্দের পাশাপাশি বড়, ক্ষুদ্র মেরামত, টয়লেট মেরামত, ওয়াশব্লক নির্মান, রুটিন মেইন টেইন্স এর বরাদ্দসহ নিরাপদে লেখা পড়ার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য রাস্তার পাশের বিদ্যালয়গুলোতে নির্মান করা হচ্ছে সীমানাপ্রাচীর। পুরনোভবন সম্বলিত বিদ্যালয় গুলোতে নির্মিত হচ্ছে নতুন ভবন।
৭। শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি তৈরি করা হচ্ছে প্রশিক্ষিত শিক্ষক। রয়েছে শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য দেড় বছর মেয়াদী ডিপিএড কার্যক্রম। বিষয় ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, সাবক্লাস্টার প্রশিক্ষণ, লিডারশিপ প্রশিক্ষণ, ওঈঞ প্রশিক্ষণ, কারিকুলাম ডিসিমিনেশন, মার্কার টেনিং, এছাড়া ও বাছাইকৃত শিক্ষকদের বৈদিশিক প্রশিক্ষণসহ বিএড, এম.এড প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ এবং আধুনিক ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করণে যুগোপযোগী করে তোলা হচ্ছে।
৮। প্রতি বছর একি সাথে প্রতিটি বিদ্যালয়ে বিপুল উৎসাহ উদ্দিপনার মধ্যে দিয়ে স্টুডেন্ট কাউন্সিল প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়। এতে কোমলমতি শিশুদের মধ্যে থেকে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টির অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে। ক্ষুদে ডাক্তারের টিম গঠন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেবার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে।
৯। প্রতিটি বিদ্যালয়ে দেয়া হয়েছে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর। মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পাঠদান কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলছে।
১০। শিক্ষার্থীদের বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা, অপরকে সহযোগিতার মানসিকতা, সৃষ্টিকর্তার প্রতি অবিচল বিশ্বাস ও দেশপ্রেমিক করে গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে রয়েছে কাব ও হলদে পাখির দলের কার্যক্রম।
১১। ঝউএ-৪ অর্জনের জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে পবিস্কার পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্য সম্মত ও পরিবেশ বান্ধব প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য শ্রেণি রুটিনে অর্šÍভূক্ত করা হয়েছে সাপ্তাহিক পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম।
১২। প্রাথমিক শিক্ষার গুনগতমান উন্নয়নের জন্য শিক্ষার্থীদের পঠন ও লিখন শৈলী (জবধফরহম ধহফ ডৎরঃঃরহম ংশরষষং) বৃদ্ধিকরণ এবং ঙহব ফধু ঙহব ড়িৎফ কার্যক্রম সংক্রান্ত
মাননীয় সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় মহোদয়ের নির্দেশনা বর্তমানে সবচেয়ে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে।
১৩। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে প্রতিবছর লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন খেলাধুলা,
সাংস্কৃতিক অনুষ্টানের আয়োজন করা হয়। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টূর্ণামেন্ট, বঙ্গবন্ধুকে জানো, মুক্তিযুদ্ধকে জানো বিষয়ক প্রতিযোগীতা, আন্তঃবিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগীতা, শিশু প্রতিযোগীতা, মৌসুমী প্রতিযোগীতা, মিনা মেলা, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ, শুদ্ধভাবে জাতীয় সংগীত প্রতিযোগীতা, যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় দিবস সমূহ উদযাপন করা হয়।
১৪। এছাড়া প্রতিবছর উপকরণমেলা, উন্নয়নমেলাসহ বিদ্যালয় কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রেষ্ট শিক্ষক, শিক্ষিকা, শ্রেষ্ট বিদ্যালয়, শ্রেষ্ট এসএসসি, শ্রেষ্ট বিদে্যুাৎসাহী, শ্রেষ্ট ঝরে পড়া নিরসন বিদ্যালয়, শ্রেষ্ট কর্মচারীসহ আরো বিভিন্ন ক্যাটাগরীতে জাতীয় শিক্ষাপদক দেয়ার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকলকে উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে। যা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করনে প্রভূত সহায়ক ভূমিকা রাখছে। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চালুর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের পরিক্ষাভীতি দূর করা হচ্ছে।
১৫। প্রতিটি বিদ্যালয়ে তিনধাপে দপ্তরীকাম নৈশপ্রহরী নিয়োগের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের কার্যক্রমকে বেগবান করা হয়েছে। এছাড়া ৬৫ হাজার বিদ্যালয়ে একজন করে অফিস সহকারী নিয়োগ করার পরিকল্পনা চলছে।
১৬। প্রতি বছর প্রতিটি উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের মাঝে এসেসটিভ ডিভাইস দেয়া হয় যাতে শিক্ষার্থীরা মূলধারায় সকল শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ পাচ্ছে।
১৭। শিক্ষার গুনগতমান নিশ্চিতকরণে শিশুর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্বিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আবেগিক বিকাশ সাধনে প্রতিটি বিদ্যালয়ে সততাষ্টোর,
মহানুভবতার দেয়াল, মুক্তিযোদ্ধা কর্ণার, বুক কর্ণার, নারী কর্ণার, বিজ্ঞান কর্ণার, স্বাস্থ্যসেবা কর্ণার, বাগানকরণ, শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল কাজ দ্বারা শ্রেণীকক্ষ সজ্জিতকরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা আর শিক্ষায় নারী পুরুষের সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে রীতিমতো ঘটে গেছে বিপ্লব। স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, বিদ্যালয়ে ভর্তির হার শতভাগ, ছাত্রছাত্রীর সমতা, নারী শিক্ষায় অগ্রগতি, ঝরে পড়ার হার দ্রুত কমে যাওয়াসহ শিক্ষার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। বিশ্ব ব্যাংক, ইউনেস্কো, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্টি, গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশকে শিক্ষার অগ্রগতিতে উদাহরন হিসেবে অভিহিত করছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রথম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে যাওয়া প্রাথমিকশিক্ষাকে যথাযথভবে নিশ্চিত করতে হলে সরকারের সমস্ত কার্যক্রমকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে, সকলের সম্বলিত আন্তরিকতা, তদারকি ও পরিবর্তনের অঙ্গিকারই পারে মান সম্মত প্রাথমিকশিক্ষা নিশ্চিত করতে। আমাদের সকলকে এ মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে- ‘আগামীকালের কাজ করবো আজকে, আজকের কাজ এখনি।’
সবশেষে বলবো-
‘আলোকিত মানুষের খোঁজে,
এসো সবাই শিক্ষার পতাকা তলে’।

সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার
বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন