চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আনন্দময় ও শিশুবান্ধব পরিবেশে পাঠদানের বিভিন্ন অন্তরায়সমূহ

রাজিয়া সুলতানা মুন্নি

৬ মে, ২০১৯ | ১:৩১ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষা যে কোন শিক্ষাব্যবস্থার মূলভিত্তি। এ ভিত্তি মজবুত ও সুদৃঢ় না হলে জাতির জন্য একটি দক্ষ, কর্মক্ষম ও সময়োপযোগী জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে এখনো বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকে বাস্তবসম্মত ও কার্যকরভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। শিক্ষা আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার। শিক্ষক হলো তার সুনিপুণ কারিগর। শিক্ষা ছাড়া সমাজ আলোকিত করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। একজন শিক্ষকের কিছু কাজ ও দায়বদ্ধতা আছে। এ কাজ ও দায়বদ্ধতা সহকর্মীদের কাছে, সমাজের কাছে, দেশও জাতির কাছে, আগামী প্রজন্মের কাছে। একজন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। শিক্ষক শুধুই সফল মানুষ হতে নয়, ভাল মানুষ হতেও শেখান। মানবিক বিপর্যয় বা বৈশ্বিক, অর্থনৈতিক সংকটে আক্রান্ত হয়েও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিনির্মানে শিক্ষকরা অবিরাম ভূমিকা রেখে চলেছেন। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মূল কার্যক্রম শিশুকেন্দ্রিক। শিশুর সার্বিক বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কাঠামো পরিকল্পনার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমিকভাবে প্রণীত নীতিমালার বাস্তবায়ন সাপেক্ষে ভবিষ্যত স্বপ্ন রচনার ভীত প্রস্তুত করাই হলো আমাদের অর্থাৎ শিক্ষকের দায়িত্ব। জাতিকে একটি সুন্দর সুশৃঙ্খল জ্যোর্তিময় একদল কুসুমকলি যা সৌন্দর্যে ও সৌরভে চারদিক ভরিয়ে দেবে সে উদ্দেশ্যই শিক্ষকের কর্মপ্রিয়তা। নানান প্রতিকুলতা ডিঙ্গিয়ে কখনও শিক্ষকরা সাফল্যের মুখ দেখেন কখনও আবার মাঝপথেই তারা আশাহত হন। শিক্ষকের শত আন্তরিকতা থাকা সত্তেও পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে শিক্ষকরা শিশুবান্ধব ও আনন্দমুখর পরিবেশে শিক্ষাদানে ব্যর্থ হয়। যেমন-
১) একটি বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় ভবন, কক্ষসংখ্যা ও আসবাবপত্র অর্থাৎ ভৌতকাঠামোগত অপূর্ণতার কারণে আনন্দঘন শিখন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।
২) পারিপার্শ্বিক অবস্থার ত্রুটিগত কারণে একজন শিক্ষকের স্বপ্ননোদিত কার্যক্রম বিঘিœত হয়। অর্থাৎ আকর্ষণীয় পরিবেশেই সুন্দর শিক্ষা পরিবেশন সম্ভব যদি বিদ্যালয়ের পরিবেশগত উৎকর্ষতা বজায় রাখা না যায় তবে শিশুবান্ধব ও আনন্দময় শিখন সম্ভব নয়।
৩) প্রাথমিক শিক্ষায় দক্ষ ও মানসম্মত শিক্ষকের অভাব থাকলেও এ কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হতে পারে।
৪) অতিরিক্ত কাজের চাপ শিক্ষকদের নাভিশ্বাস অবস্থা। প্রাথমিক শিক্ষকদের শ্রেণিতে পাঠদান ছাড়াও বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হয়। এতে করে তাদের
মানসিক অস্থিরতা বেড়ে যায়। তাতে কখনও শিশুবান্ধব আনন্দময় পাঠদান সম্ভব নয়।
৫) সহকর্মীদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত তারতম্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্টান কর্মরত শিক্ষকদের মেধা, যোগ্যতা ও আন্তরিকতা যেমন এক নয়, ঠিক তেমনি রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গিগত দূরত্ব। শিক্ষকদের মাঝে যদি পারষ্পরিক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের অভাব থাকে তাহলেও আনন্দময় পাঠদান সম্ভব হয় না।
৬) একটি শিশুর বেড়ে উঠার পেছনে অভিভাবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষক-অভিভাবক সম্পর্ক হতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ। শিক্ষকের সাথে যদি
অভিভাবকরা যোগাযোগ না রাখে তাহলেও আঁধারেই ঢাকা পড়ে যায় শিশুবান্ধব ও আনন্দময় শিখন।
৭) সমাপনী ও বৃত্তি পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের জন্য ও শিক্ষকদের নানা রকম চাপের মুখে থাকতে হয়। উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছে জবাবদিহিতা করতে হয় বলে শিক্ষকরা অনেকসময় আনন্দময় ও শিশুবান্ধব পড়ালেখার থেকে দূরে সরে যায়।
৮) প্রত্যক শিক্ষক যদি প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত হয় তাহলেও আনন্দময় শিক্ষা বাধাগ্রস্থ হতে পারে।
৯) প্রাথমিক স্তরে পঠিত বিষয়গুলির পাশাপাশি
সহশিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়াদির ওপর বিশেষ
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাবে ও শিশুবান্ধব শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
১০) দরিদ্র পীড়িত প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদেরকে বিদ্যালয় অভ্যন্তরে দুপুরের খাবার ব্যবস্থা সরকারি ও আঞ্চলিক অর্থায়নে করার কথা থাকলেও সব বিদ্যালয়ে এ ব্যবস্থা চালু করা এখনও সম্ভব হয়নি। প্রাথমিকে অধ্যায়নরত অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা অভূক্ত অবস্থায় বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। আর ক্ষুধা অবস্থায় আনন্দময় পড়ালেখা শিক্ষার্থীর কাছে ফোঁড়াই ঘাঁ এর মত।
উল্লেখিত প্রতিবন্ধকতা নিরসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে আনন্দঘন ও শিশুবান্ধব পরিবেশে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে সমাজের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষক সকলের সহযোগিতা নিয়ে যখন সাবলীল ও প্রাণবন্ত পাঠদানে সফল হতে পারবেন তখনই স্বার্থক হবে শিক্ষা সংক্রান্ত সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপগুলো।
প্রাথমিকে অধ্যায়নরত শিশুরা কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় এরা দেশ ও জাতির সম্পদ। এদের সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখানোর দায়িত্ব আপনার, আমার, আমাদের সকলের।

লেখক- সহকারী শিক্ষক
কধুরখীল বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট