চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

প্রাথমিক শিক্ষার বেহাল অবস্থা

অবিক রায় অনিক

২৯ এপ্রিল, ২০১৯ | ১:৪৫ পূর্বাহ্ণ

আপনি জানেন কি, বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৩৫ শতাংশ বাংলা পড়তে পারে না, প্রায় ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণির গণিত পরিক্ষায় সর্বনিম্ন নাম্বার পেয়েও উত্তীর্ণ হতে পারে না! বিশ্বব্যাংকের ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৮’ তাই বলছে। রিপোর্টে আরো একটি হতাশাজনক তথ্য উঠে এসেছে, সেটি হল শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে মাধ্যমিকের গ-ি পার হওয়া পর্যন্ত ১১ বছরের শিক্ষা জীবনে সাড়ে চার বছর নষ্ট হয়ে যায় শিক্ষা পদ্ধতির দূর্বলতা ও অনিয়মের কারণে। প্রাথমিক শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনের ভিত্তি। এখান থেকেই একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন প্রবাহিত হয়। সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে প্রতিনিয়ত অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষার আওতাভুক্ত হচ্ছে, কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার মান আশানুরূপভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
প্রাথমিক শিক্ষার মানের বেহাল অবস্থার কারণ বৈষম্য বললে ভুল হবে না হয়তো। এই বৈষম্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক। দেখা যায়, যে স্কুলে শিক্ষার্থীদের বেতন বেশি; সেই স্কুলে শিক্ষার্থীদের মান অধিকতর কম বেতনের বিদ্যালয় ও সরকারি বিদ্যালয়গুলো থেকে বেশি। শহরকেন্দ্রিক ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল কিংবা ভালো মানের বেসরকারি স্কুলগুলোতে দেখা যায় প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকের গ-ি পার হওয়া একজন শিক্ষার্থীর খরচ হয় কয়েক লক্ষাধিক টাকা। পক্ষান্তরে মফস্বল কিংবা গ্রামের একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য কম মানসম্পন্ন বিদ্যালয়গুলোতে অর্ধলক্ষ টাকাও খরচ করতে পাওে না বা করেও তা ফলদায়ক হয় না। তাই প্রতিযোগিতায় শুরুতেই হেরে যাচ্ছে কম মানসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা। বেসরকারী একটি ওয়েব পোর্টালের প্রবন্ধে দেখানো হয়, একটি সরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্রের পেছনে সরকারের ব্যায় হয় দুই হাজার টাকার কিছু বেশি অথচ ক্যাডেটের একজন ছাত্রের পেছনে সরকারের ব্যায় ৭০ হাজার টাকারও বেশি। সুযোগ ও অর্থের এমন অসম বিন্যাস
সামগ্রিকভাবে কখনোই শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে পারে না।
প্রাথমিক স্তর, এমনকি মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় আরও একটি বিষয় ভীষণ হতাশাজনক। সেটি হল মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব। প্রথমেই নজর দেয়া যাক প্রাথমিক শিক্ষার দিকে। প্রাথমিক শিক্ষার দিকে নজর দিতেই যে বিষয়টি সবচেয়ে উদ্বেগজনক সেটি হল এইচএসসি অর্থাৎ মাধ্যমিক পাশ করেই একজন নারীর প্রাথমিক বিদ্যলয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ পাওয়া। হতে পারে এটি নারীর ক্ষমতায়ন কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার মানের অবনতির অন্যতম কারণও হতে পারে। একজন নারী শিক্ষক যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেনি, কোনো গবেষণা কর্মে অংশগ্রহণ করেনি সে যদি উচ্চমাধ্যমিকের নির্ধারিত ও সীমিত জ্ঞান দিয়ে পাঠদান করেন তবে সেই পাঠদান একজন শিক্ষার্থীর মস্তিষ্ক সঠিকভাবে বিকাশ করতে পারবে না। কেননা শুধুমাত্র তাত্ত্বিক শিক্ষা দ্বারা সম্পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করা যায় না, তার জন্য প্রয়োজন দর্শন, রাজনীতি ও সাহিত্যের চর্চা। উচ্চ মাধ্যমিকের সীমিত গ-িতে যা আদৌ সম্ভব নয়।
প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাবস্থায় আরো একটি হতাশাজনক বিষয় হল বিষয়ভিত্তিক উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ না করেই অনেক শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করছে। উদাহরণস্বরূপ শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের একটা জরিপের কথাই ধরুন, সেই জরিপে বলা হয়েছিলো প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষকের গণিতে কোনো বিষয়ভিত্তিক উচ্চ শিক্ষা না থাকার পরেও তাদের দ্বারা শিক্ষার্থীদের গণিতের পাঠ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে গণিতে অভিজ্ঞ নয় এমন শিক্ষক দিয়ে শিক্ষার্থীদের গণিত শেখানো প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই নয়। মাধ্যমিকেও মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব রয়েছে অনেক। শুধুমাত্র বিষয়ভিত্তিক দক্ষ ও মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবে মফস্বল ও গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী খুবই অল্প। শিক্ষকের অপ্রতুলতার কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে আগ্রহ হারাচ্ছে।
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক সব স্তরেই মানসম্মত শিক্ষকের অভাব রয়েছে, এটির অন্যতম কারণ কম বেতন। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ছাত্র স্বল্প বেতনের কারণে শিক্ষকতা করতে চায় না। এইযে অনগ্রসরতা এটির পেছনে রয়েছে যথাযথ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের অভাব। কিন্তু গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন শিক্ষা খাত বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে লাভজনক, শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে তা দিয়ে একটা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব। কিন্তু জিডিপির যৎসামান্য অংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেয়ায় আশানুরূপ ফল আসছে না শিক্ষাখাত থেকে। তাছাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ম্যানেজিং কমিটির আত্মীয়করণের কারণে ভালো শিক্ষকরা স্থান পাচ্ছেনা বিদ্যালয়গুলোতে, এর ফলে অনেক অযোগ্য ব্যাক্তি শিক্ষকতা করছে বিদ্যালয়গুলোতে।
যেহেতু মানসম্পন্ন শিক্ষকের কথা চলেই আসলো তাই আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র জাপানের একজন শিক্ষক তৈরি হওয়ার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে শেষ করবো লেখাটি। জাপানে শিক্ষক হতে হলে প্রথমে তাকে শিক্ষক বিষয়ক একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়। সেখান থেকে পাস করে বেরোলে সেই শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় টিচিং লাইসেন্স, সেই টিচিং লাইসেন্স পেয়ে শিক্ষক হতে চাওয়া ব্যক্তিটিকে নিয়োগ পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়, সে পরীক্ষায় পাশ করার পর একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের সাথে এক বছর শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে হয়, তারপর সেই ট্রেইনারের মতামত অনুসারে নতুন শিক্ষকটিকে নিয়োগ দেয়া হয়।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয়টি হল, নিয়মিতভাবে প্রতিটি শিক্ষককে তার যোগ্যতা প্রমাণের জন্য পরীক্ষা দিতে হয় এবং কোনো শিক্ষক যদি কোনো নীতিবিরোধী কাজ করে তবে তার টিচিং লাইসেন্স বাতিল করা হয়। প্রক্রিয়াটি একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই বুঝা যায় কতটা পিছিয়ে আছি আমরা, দক্ষ ও মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরির ক্ষেত্রে। শুধুমাত্র বিনে পয়সায় বই বিতরণ নয়, দক্ষ ও মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ না হলে এবং শিক্ষাখাতে সরকারের বিনিয়োগ না বাড়লে আমরা প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তর থেকে ভালো শিক্ষার্থী পাবো না, যারা পরবর্তীতে দেশের হাল ধরবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট