চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শিক্ষিকাদের কাজের জন্য দরকার নিরাপদ পরিবেশ

৯ মার্চ, ২০২০ | ৩:৪০ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষকরা মানুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখেন, পতনের পথ থেকে
বাঁচায়। স্বার্থপরতার লোভনীয় আকর্ষণ থেকে চোখকে সরিয়ে নিয়ে আত্মত্যাগের, মহামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেন। শিক্ষকতা মহান ব্রত যার মূলভিত্তিক হলো আদর্শ। আদর্শ শিক্ষক আলোকিত মানুষ। শিক্ষিকা হিসেবে এ দাবী আরো বেশি সত্য। মহিলা শিক্ষকদের বড় ভাবা দোষের, তাদের ছোট ভাবাও তেমনি দোষের।

মো. সেলিমুজ্জমান মজুমদার
শিক্ষা সেক্টরে শিক্ষিকাদের অংশগ্রহণ আজ সকলেরই দৃষ্টি কেড়েছে। সময়ের পরিক্রমায় শিক্ষালয়ে শিক্ষিকাদের বড়সড় অংশগ্রহণ মানুষকে শিক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে। এতে করে নারীরা যে কেবল সমৃদ্ধ হচ্ছে তাই নয় বরং মানুষকেও সম্পদে পরিণত করা হচ্ছে। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিকাদের প্রশংসাই যথেষ্ট নয় বরং তাঁদের জন্য চাই উপযুক্ত কর্মপরিবেশ। দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়, কারিগরি মক্তব-মাদরাসায় নারী শিক্ষকদের অতীত খুব সহজ-স্বাভাবিক অতীত নয়। পুরুষদের পক্ষপাতদুষ্টার জন্য নারী শিক্ষকরা মাদরাসার পথও কখনো মাড়ায়নি। কট্টরপন্থি তথাকথিত ধর্মীয় মানবরা ধর্মের শাসনদ- দেখিয়ে মক্তব-মাদরাসায় নারী শিক্ষকদের অনুপ্রবেশের পথ রুদ্ধ রাখতে পেরেছিল। এখনও কোন-কোন মহিয়ষী নারী শিক্ষক এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বীয় যোগ্যতার পরিচয় দিলেও ঐ ধর্ম ব্যবসায়ী তথা কথিত পুরুষ শিক্ষক নারী শিক্ষকদের ছলে-বলে কৌশলে দমীয় রাখার জন্য শিক্ষিকাদের পেছনে বকধ্যানে থাকেন। তবে, এর ব্যতিক্রমও আছে যা’ নিতান্তই কম। তবুও কিয়দাংশ এ
নারীবান্ধব শিক্ষকদের ধন্যবাদ জানাই, যাদের একান্ত অনুপ্রেরণায় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে
শিক্ষিকারা অতি ধীরে হলেও প্রবেশ করতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি সরকার সারা দেশের সর্বস্তরের শিক্ষালয়ে নারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ফলে
শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী শিক্ষক নিয়োগ লাভের দ্বার আরো প্রশস্ত হয়েছে। শিক্ষালয়ে সমধিকার প্রতিষ্ঠা এবং পশ্চাদপদ নারীসমাজকে শিক্ষার মূল ¯্রােতধারায় ফিরিয়ে আনার সরকারের এ ধরনের কর্মকা-কে একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমি সাধুবাদ জানাই।
আমার শিক্ষকতা জীবন শুরু হয়েছিল শিক্ষালয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকা উভয়ের সমন্বয়ে। প্রায় প্রতিটি শিক্ষালয়ে প্রায় সমান-সমান শিক্ষক-শিক্ষিকা ছিলেন। আমার ঘরেও তাই। আমি শিক্ষক, আমার স্ত্রী শিক্ষিকা। আমি কলেজ শিক্ষক, তিনি মাদরাসা শিক্ষক। আমি পেশাগত মান-মর্যাদা, অধিকার বিষয়ে লড়াই সংগ্রাম করতে করতে আমার চাকরি মহামান্য হাইকোর্টে জয়লাভ করার পর কলেজের নীতি ও নৈতিকতাহীন অধ্যক্ষের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে তা মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। নগরীর একটি শিক্ষালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিতাম। গত ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ তারিখে এ কলামে ‘ফরম পূরণ শেষ-এবার নাও সেরা প্রস্তুতি’-শীর্ষক লেখা প্রকাশিত হবার পর তাও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন-‘সত্যিকারের শিক্ষক বলেই আমি এখন স্বাধীন হলাম।’
সম্মানিত নারী সহকর্মীদের সাথে কাজ করতে গিয়ে তাদেরকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তাদের সুখ-দুঃখের পেশাগত বহু সমস্যা আমার জানা। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দৃশ্যত কিন্তু পেশাগত সমস্যা আছে যা’ পাঠক ও কর্তৃপক্ষের সামনে নিয়ে আসা দরকার। প্রথমেই আমার জীবনে সংগঠিত পরিচালনা কমিটি (গভর্ণিং বডি) র একটি কালকার্যবিবরণী আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। যেখান থেকে শিক্ষক- শিক্ষিকাদের হয়রানির একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
‘….কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বিষয় ও ক্লাসের সংখ্যার ভিত্তিতে সপ্তাহে প্রতি শিক্ষক ২৪টি ক্লাস পায় মত নতুন করে রুটিন তৈরির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৩ সদস্য বিশিষ্ট রুটিন প্রণয়ন, কমিটি করা হয়। এতে গভর্ণিং বডি’র ২ জন সদস্যও রাখা হয়। রুটিনের শর্তসমূহ নি¤œরূপ ছিল:
১। সপ্তাহে কোন অফ ডে থাকবে না।
২। প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকা সকাল ৯.০০ হতে ২.৩০ সময় পর্যন্ত কলেজে উপস্থিত থাকবেন। ৩। ক্লাস ছাড়াও অভিভাবদের সাথে যোগাযোগ করবেন।
৪। শ্রেণি পরীক্ষা ও উত্তরপত্র- প্রশ্নপত্র রচনা কলেজে বসেই করবেন।
৫। গ্রুপ স্টাডি ও মূল্যায়ন পরিচালনা করবেন, ৬। আজ থেকে কোন শিক্ষক-কর্মচারী অন্য প্রতিষ্ঠানে বিনা বেতনে বা বেতন সহ বা চুক্তিভিত্তিক বা অনারারী কাজ করতে পারবেন না।
৭। আগামী ১০ দিনের মধ্যে শিক্ষক- শিক্ষিকাগণ অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ততা নাই মর্মে লিখিতভাবে অধ্যক্ষকে অবহিত করবেন। ৮। ডিগ্রি (¯œাতক) পাস কোর্সের শিক্ষার্থীগণ যাতে শ্রেণিতে উপস্থিত থাকে সেই মর্মে শিক্ষকগণ অভিভাবকদের নিকট চিঠি লিখবেন বা ফোনে যোগাযোগ করবেন।
৯। পাঠ পরিকল্পনা করে তা অধ্যক্ষের নিকট জমা করবেন।’
সুপ্রিয় পাঠক, এ সিদ্ধান্তটি প্রায় ১০ বছর আগে ২২ বছরের পুরানো কলেজে অধ্যক্ষের চাকরির মেয়াদ শেষে উপাধ্যক্ষ নিয়োগের ঠিক আগের সভায় গৃহীত হয়। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে চলা কলেজে তবে কী অধ্যক্ষ কোন ক্লাস রুটিনই তৈরি করেননি? এ কার্যবিবরণীতে চাকরি শেষে অধ্যক্ষ চলে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কলেজটির প্রশাসন ও একাডেমিক ব্যবস্থা বলতে যে কিছুই ছিল না তারাও একটি চিত্র ফুটে ওঠেছে। উপাধ্যক্ষ হিসেবে যিনি আসবেন তাকে শিক্ষক-কর্মচারীদের সামনে বিতর্কিত করে, হেনস্তা করে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে নিজের (অধ্যক্ষের) চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি করাই ছিল শিক্ষকতাপেশা বিরোধী অধ্যক্ষের এ কাল রেজুলেশন রচনা করা। বলা বাহুল্য যে, এ কাল রেজুলেশন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীরা ফুঁসে ওঠেছিলে যার অনিবার্য পরিণতি উপাধ্যক্ষ হিসেবে আমাকে এখনো দিতে হচ্ছে। জিরি’র এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কলেজের বিশেষ করে আমার সম্মানিত মহিলা শিক্ষকরাই বেশি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাদের এ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার যুক্তিকতা আছে। যেমন :
১. গচঙ সুবিধা ছাড়া তাঁরা অন্য কোন আর্থিক-অনার্থিক সুবিধা পান না।
২. জিবি’ একাডেমিক বিষয়ে হস্তক্ষেপন করতে পারনে না, অথচ এখানো তা করা হয়েছে।
৩. শিক্ষিকাদের জন্য বিশ্রামঘর বা আশ্রয়স্থল, ইবাদাতখানা, শিশু পালনাগার এমন কী আলাদা টয়লেট ব্যবস্থাও নেই।
৪. চাকরির স্থল থেকে বাসা-বাড়ির ব্যাপক দূরত্ব।
৫. পর্যাপ্ত যান-বাহনের অভাব।
৬. অনেকের দুগ্ধজাত ও অসুস্থ শিশুর মা অথবা ঘরে রোগক্রান্ত বৃদ্ধ-মা-বাবা।
৭. কারো-কারো সন্তানদের সকাল বেলায় স্কুলে দিয়ে আসতে হয়।
৮. খাবারের মানসম্মত দোকান বা কেন্টিন সুবিধা নেই।
৯. সারাদেশে এক, এ কলেজের ভিন্ন হবে কেন?
১০. কলেজে বসে প্রশ্নপত্র রচনা, উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে হবে কেন? বোর্ড বা বিশ^বিদ্যালয়ের উত্তরপত্র আমরা ঘরে বসে মনোযোগ সহকারে মূল্যায়ন করি। সেখানে পারলে এখানে এর ব্যাতিক্রম হবে কেন?
১১. মাতৃত্ব ছুটি ৬ মাসের স্থলে তারা ৪ মাস ভোগ করেন কিংবা করতে দেয়া হয়।
১২. যেহেতু, বদলী সিষ্টেম নেই সেহেতু, এ ধরনের সিদ্ধান্ত হুঁট করে না নিয়ে সময় নিয়ে তা করা উচিত ছিল।
১৩. স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরিজীবি।
১৪. বিধি মোতাবেক ছুটি-ছাঁটাও তারা সময়মতো পান না।
১৫. প্রতিষ্ঠান ও ঘরে উভয় জায়গায় তাদের খাটতে হয়।
১৬. এসবব কালা-কানুন শিক্ষিকাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রাখে, যেখানে পূরুষ শিক্ষকদেরও সমর্থন ছিল।
প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইতিবাচক ও কল্যাণকর মানবিক গুণাবলির চারণক্ষেত্র। এটি শিক্ষক-কর্মচারী, ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার আচারিত এমন কিছু অনুসরণযোগ্য বিষয় চাষাবাদের স্থল যেখানে মানুষের জীবন যাত্রা হয়ে ওঠে আরো সুন্দর, নির্মল ও রুচি¯িœগ্ধ। শিক্ষকরা মানুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখেন, পতনের পথ থেকে
বাঁচায়। স্বার্থপরতার লোভনীয় আকর্ষণ থেকে চোখকে সরিয়ে নিয়ে আত্মত্যাগের, মহামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেন। শিক্ষকতা মহান ব্রত যার মূলভিত্তিক হলো আদর্শ। আদর্শ শিক্ষক আলোকিত মানুষ। শিক্ষিকা হিসেবে এ দাবী আরো বেশি সত্য। মহিলা শিক্ষকদের বড় ভাবা দোষের, তাদের ছোট ভাবাও তেমনি দোষের। তাদের সম্বন্ধে সঠিক ধারণা থাকাই যুক্তিযুক্ত।
গোটা বিশ^ব্যাপী আজ ভোগবাদী মানসিকতার ব্যাপক প্রসার লক্ষ করা যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমরা মহিলা সহকর্মীদের কর্ম পরিবেশের বিষয়টি বিবেচনায় আনছি না। কর্মস্থল
ঘরে-বাইরে, কাছে নিকটে, উচিত অনুচিত দাঁড়িপাল্লায় একাকার করে ফেলছি। টানা ক্লাস অথবা ১টি সকাল ১০টা অপরটি বিকাল ২.৩০ ক্লাস দিয়ে রুটিন তৈরি করি। ১টি ক্লাস ৯ম শ্রেণি অপরটি ডিগ্রি ৩য় বর্ষে। ১টি ১নং ভবন আরেকটি ৪র্থ ভবনের ৫ম তলায়। এভাবে অহরহ হয়রানির শিকার হচ্ছে মহিলা শিক্ষকরা। এমন অনেক মহিলা সহকর্মীকে দেখেছি যে, পর-পর ৩টি ক্লাসই পাশাপাশি ভিন্ন ৩ বিল্ডিংয়ের ৫ম তলায়Ñ যিনি সন্তান সম্ভাবা!
দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের সাথে মহিলা শিক্ষকরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই শিক্ষার সার্বিক বিকাশের জন্য চাই মহিলা শিক্ষকদের স্বাচ্ছন্দময় পরিবেশ। কর্তৃপক্ষ শিক্ষিকাদের কাজের পরিবেশ নিরপদ করবেন এবং এ লক্ষ্যার্জনে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা প্রয়োগ করবেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, শিক্ষা বিষয়ক কলামিস্ট

শেয়ার করুন