চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পরিবেশ বিশুদ্ধকরণে ছাত্র-শিক্ষকের আকুতি

মো. সেলিমুজ্জমান মজুমদার

২ মার্চ, ২০২০ | ৩:১৭ পূর্বাহ্ণ

মানুষের বহু চেষ্টা, স্বপ্ন ও সাধনার পবিত্র ফলই হল আজকের সভ্যতা। উৎপাদনের অন্যতম মৌলিক উপাদান মূলধন ও শ্রমশক্তির তিল তিল দানে সে গড়ে তুলেছে সভ্যতার এ তিলোত্তমা মূর্তি। এ মূর্তির বেদিমূলে মানুষ মুক্ত মনে ঢেলে দিয়েছে হৃদয়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা। বলা বাহুল্য যে, এ ভালোবাসা মানুষের ভালোবাসা-এ ভালোবাসা ছাত্র-শিক্ষকের ভালোবাসা।
আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ। পরিবেশের সঙ্গে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক। পরিবেশের সঙ্গে আমাদের
বাবা-মায়ের সম্পর্ক। পরিবেশের সঙ্গে আমাদের অস্তিত্বের সম্পর্ক। প্রকৃতি ও মানুষের সৃষ্ট এসব পরিবেশের সঙ্গে সাম্য ব্যবস্থা বজায় থাকলে কোন সমস্যা সৃষ্টি হয় না। কিন্তু যখন সাম্য ব্যবস্থার ফাটল ধরে তখনি ঘটে বিপর্যয়। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সৃষ্ট এ ফাটলকে বলা হয় পরিবেশ বিপর্যয় বা পরিবেশ দূষণ। পৃথিবীর উন্নত দেশের সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ ক্রমান্বয়ে আমাদের দেশেও শুরু হয়েছে। আগেই বলেছি যে, যুগ-যুগান্তরের স্বপ্ন ও সাধনায় গড়া আমাদের এ প্রিয় সবুজ বাংলা, এ বাংলার স্বচ্ছ আয়নায় এ যেন কলঙ্কের তিলক। এ রূপসী বাংলার পরিবেশ প্রতিবেশ নিয়ে
দেশ-বিদেশে আহাজারী করছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তাঁর আকুল আবেদন দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে সর্বোপরি স্বীকৃতিও এসেছে। এনেছেন দেশের জন্য সম্মান। দেশের জন্য অর্জিত এ সম্মান ধরে রাখার জন্য দেশের সব শ্রেণির মানুষের পাশাপাশি ছাত্র-শিক্ষকদের এ ধরনের কল্যাণকর কাজে সামিল হওয়া দরকার। দেশের পরিবেশ বিশুদ্ধ রাখার ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষকের কাজ করার বিরাট সুযোগ আছে। তাদের উভয়ের যোগ্যতাও আছে। তাই, আজ থেকেই তাদের কোমরে গামছা বেঁধে নামতে হবে। এ লক্ষ্যার্জনে আমরা কর্তৃপক্ষের সহায়তা চাই।
মা ও পরিবেশ উভয়ই আমাদের জীবনদাত্রী। মা সব প্রতিকূলতাকে ডিঙ্গিকে সন্তানকে আগলে রাখেন আর পরিবেশ আমাদেরকে জীবন ধারণের সব উপকরণ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন। প্রাণ রক্ষাকারী অক্সিজেন তা কেবল পরিবেশই সরবরাহ করে। যে খাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকি তাও কেবল আমাদের আলো-বাতাস-মাটি-পানি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে, সে পরিবেশের এসব মৌলিক উপাদানসমূহ ক্রমান্বয়ে মরণ তুল্য হয়ে উঠছে। পৃথিবীর এরূপ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ছাত্র-শিক্ষক সমাজকে জেগে ওঠতে হবে এবং তা এখনই। প্রসঙ্গক্রমে পরিবেশকন্যা গ্রেটা থানবার্গ এর ঘটনাটি পাঠক সমাজে তুলে ধরলাম। ১৬ বছরের সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কি আন্দোলনে সোচ্চার এক পরিবেশ কন্যা ২০ আগস্ট, ২০১৮ সুইডেনে নিজের মতো করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে সে। সুইডেনের পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে তার ‘ঝপযড়ড়ষ ঝঃৎরশব ভড়ৎ পষরসধঃব’ শীর্ষক প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঋৎরফধুং ভড়ৎ ঋঁঃঁৎব’. আন্দোলনে অনেক স্কুল শিক্ষার্থীই অনুপ্রাণিত হয়। এরপর এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে অনেক দেশে। নজর কাড়ে বিশে^র। ১৬ মে, ২০১৯ টাইম ম্যাগাজিন তাকে ‘আগামী প্রজন্মের নেতা’- হিসেবে নির্বাচিত করে। পরিবেশ বিশুদ্ধকরণ বা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জনমত তৈরি করতে পারায় গ্রেটা এখন পুরো বিশে^র কাছে এক নামে পরিচিত।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে সমানতালে। এ বিষয়ে অনেক আগেই সতর্ক করে রেখেছেন বিজ্ঞানীরা। তবুও কমেনি পরিবেশ দূষণ, বন উজাড় ও কার্বন নিঃসরণ। জাতি সংঘের আন্তঃরাষ্ট্রীয় জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেল (ওচঈঙ) ১৫৩টি দেশের ১১,২৫৮ জন বিজ্ঞানীও জলবায়ু ও পরিবেশ দূষণ বিষয়ে হুঁশিয়ারী দিয়েছেন। প্রায় প্রতিটি পাঠ্যপুস্তকে পরিবেশ-জলবায়ু বিপর্যয় সম্বন্ধে বিষয়সূচী আছে। আমরা শিক্ষকরা তা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াই শিক্ষাথীরা পড়ে বটে কিন্তু প্রয়োগে নেই। প্রয়োগের ক্ষেত্রও সীমিত। তাগিদও সীমিত।
দেশে চলছে গণতান্ত্রিক শাসন। বর্তমান সময়ে গোটা দেশে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা- চলছে। জোরদার হচ্ছে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন। শিক্ষা ও পরিবেশ খাতে সরকার অঢেল অর্থকড়ি ব্যয় করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামকেও প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সুন্দরের শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বহুমুখী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের দাবী হল প্রতিটি শিক্ষালয়ে মিনি চিড়িয়াখানা, মিনি পার্ক, ফুল বাগান ও
খেলাধুলার মাঠ এবং সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণে ছাত্র শিক্ষক উভয়কে সম্পৃক্ত করা হোক। গঠন করা হোক শিক্ষালয় ভিত্তিক শিক্ষা ও পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটি। দেশের উন্নয়নে ছাত্র শিক্ষক সমাজকে সম্পৃক্ত করে এসব কর্মকা-ে আগ্রহীদের
আর্থিক-অনার্থিক সমর্থন দেয়া হোক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সূচিত সব উন্নয়ন কর্মকা-ে শিক্ষক-কর্মচারীদের ‘উন্নয়ন কমিটি’র সাথে কমরত সবাই যাতে উন্নয়নের একটা নির্ধারিত বরাদ্দ পেতে পারে কর্তৃপক্ষকে সে ব্যবস্থা করে দেয়া উচিত। দেশের সব উন্নয়ন কর্মকা-ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সবাই যাতে সুবিধাদি পায় সে ব্যবস্থা থাকলে, সবাই সামনভাবে সুবিধাদি পাবে এবং সেটার গ্রহণযোগ্যতাও ঢের বেশী পাওয়া যাবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নও হবে সমভাবে। আলোচ্য ক্ষেত্রে কথাটি আরো বেশী প্রযোজ্য। শিক্ষালয়ে সূচিত উন্নয়ন কর্মকা- থেকে সাধারণ শিক্ষক কর্মচারীরা এক কানাকড়িও পায় না। বিষয় একেবারেই অবিবেচনাপ্রসূত। এ অবস্থার আশু পরিবর্তন হওয়া উচিত। যাক মূল আলোচনা ফিরে যাই।
বর্তমান সময়ে আলো ও শব্দ দূষণ নতুনমাত্রা পেয়েছে। আলো দূষণ সম্পর্কে ছাত্র ছাত্রীরা সচেতন নয়। মোবাইল, কম্পিউটার, টেলিভিশন, ঘরে বাইরে ইলেক্টিক লাইট আমাদের ঘুম নষ্ট করে দিচ্ছে। কাজে কর্মে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। অধিক রাতেও না ঘুমানো ছাত্র ছাত্রীরা শ্রেণিকক্ষে ঘুম ঘুম ভাব দেখায়, অমনোযোগিতা পেয়ে বসে তাদের। অধিক আলো তাদের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিচ্ছে। এ আলো দূষণ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি গোটা দেশবাসীকে সচেতন করার দায়িত্ব শিক্ষকসমাজকেই নিতে হবে। ধর্ম, কর্ম ও শরীর সুস্থ রাখার জন্য জীবনমুখী শিক্ষার বিকল্প নেই। দিবসের শেষাংশে পরিবেশ বিশুদ্ধকরণ সংক্রান্ত কার্যাবলি আমরা শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা করতে পারি। এতে আমাদের শরীর, মন, শিক্ষাসহ আর্থিক স্বচ্ছলতা কুড়াতে পারি। প্রতিটি শিক্ষালয় কেন্দ্রিক স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি আমরাও পরিবেশ সংরক্ষণ তথা দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারি। দেশ ও জাতির অধিকতর কল্যাণ নিশ্চিত করণে দেশের শিক্ষক-কর্মচারী ও ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকারের পরিবেশবান্ধব নানা কর্মসূচী আমরা সফল করতে পারি। ডায়াবেটিক রোগের মত পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। এসব ক্যলাণকর চিন্তা চেতনার উন্মেষ কেবল কর্তৃপক্ষই ঘটাতে পারে। যেমন, মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলা, বিশেষ করে মাংশের প্রতি আসক্তি কমিয়ে উদ্ভিদ খাদ্য গ্রহণ। কার্বনমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি, জনসংখা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ। জীবাশ্ম জ¦ালানি ব্যবহারের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ¦ালানি ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে আমরা শিক্ষক কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা পাড়া মহল্লায় গণসচেতনতায় কাজ করতে পারি।
¯œাতক পর্যায়ে বহু শিক্ষার্থী পারটাইম কাজ চায়। বিকাল-সন্ধ্যা-রাতে সুবিধামতো পরিবেশ বিশুদ্ধকরণে এরা কাজ করতে পারে। পরিবেশবান্ধব এরূপ যেকোনো কাজে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা হোক। দেশের পরিবেশ বিশুদ্ধকরণে শিক্ষার অংশ হিসেবে আমরাও গর্বিত সেবক হতে চাই।

শিক্ষাবিদ, শিক্ষা বিষয়ক কলামিস্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট