চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

আদিবাসী শিক্ষার মান উন্নয়নে দরকার সচেতনতা

আদিবা আনজুম

২ মার্চ, ২০২০ | ৩:১৭ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় খ–খ- হয়ে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছে। এভাবেই বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিভাগের প্রশাসনিক অঞ্চল বান্দরবানেও অনেক আদিবাসীদের বাস। কিন্তু এসব আদিবাসীরা আমাদের দেশের জনসংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের প্রাপ্য অধিকার হতে পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের সকল প্রকার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া সরকারের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য।
এই জেলায় বিত্তবান পরিবার ছাড়া মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত পরিবারের জীবনযাপন খুবই কষ্টের। শিক্ষার ক্ষেত্রে এখানে বিত্তবান পরিবারের শিশুরাই সযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে। মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা সুযোগ পেলেও অর্ধেক পড়া শেষে তাদের পরিবারের আর্থিক সামর্থ্যরে কথা চিন্তা করে পড়ালেখার বলিদান দিতে হয় এবং নি¤œবিত্ত পরিবারের শিশুরা এই সুযোগ পায় না বললেই চলে।

ব্যবসায় সুবিধা নেই এখানে। তাদের কথামতে তাদের ব্যবসা থাকে শুধুমাত্র শীতের মৌসুমের ৩ মাস। বাকি ৯ মাস তারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু এখন তাদের এই কাজেও অনেক বাধা বিপত্তি আছে। তারা তাদের পেশা হিসেবে এই কাজকে নিতে পারে না কেননা তাদেরকে সেই জায়গা দেওয়া হয় না। তাদের ভোট দেওয়ার সুযোগও কেড়ে নেওয়া হয় তাদের কাছ থেকে।

১০৭ আইএলও কনভেনশনে ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ঐতিহ্যগতভাবে অধিকৃত ভূমির উপর যৌথ বা ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার স্বীকৃত করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশ এই কনভেনশনের ভিত্তিতে দেশের আদিবাসীদের অধিকার এর কোনো ব্যবস্থা করেনি।
তাছাড়া আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদসমূহে আদিবাসীদের মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা উপভোগের অধিকার রয়েছে। আদিবাসীদের আদি উৎপত্তি অথবা পরিচয়ের ভিত্তিতে যেকোনো বৈষম্য থেকে মুক্তিলাভের অধিকার রয়েছে। তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ করার অধিকার রয়েছে। এই অধিকারবলে তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা নির্ধারণ এবং অবাধে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রাখার অধিকার রয়েছে। একই অধীকারবলে তাদের অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ে স্বায়ত্তশাসন ও স্বশাসিত সরকারের অধিকার রয়েছে। তাদের জীবন, শারীরিক, মানসিক মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা লাভের অধিকার রয়েছে। তাদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকার রয়েছে। আদিবাসী শিশুদের বৈষম্যহীনভাবে রাষ্ট্র প্রদত্ত সকল স্তরের ও সকল প্রকারের শিক্ষালাভের অধিকার রয়েছে।

তাই সরকারের কাছে প্রশ্ন একটাই। আদিবাসীদের কি তাদের প্রাপ্য অধিকারগুলো দেওয়া উচিত নয়?
অবশ্যই তাদের প্রাপ্য অধিকার তাদের দেওয়া উচিত।
রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি এবং শিক্ষা, ভূমি ও জীবনের অধিকারের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন আদিবাসীরা। এ বিষয়ে সরকার নীরব বলেও অভিযোগ তাদের। আদিবাসীদের আদি উৎপত্তি অথবা পরিচয়ের ভিত্তিতে যেকোনো বৈষম্য থেকে মুক্তিলাভের অধিকার দিতে হবে। তাদের শিক্ষা, জীবন, শারীরিক, মানসিক মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা লাভের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। তাদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা প্রদানের জন্য তাদের সাংস্কৃতিক রীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ পাঠদান ও শিক্ষাপদ্ধতি অনুসারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে দিতে হবে এবং সেসবের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আদিবাসী শিশুদের বৈষম্যহীন ভাবে রাষ্ট্র প্রদত্ত সকল স্তরের ও সকল প্রকারের শিক্ষালাভের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। অনেক শিশুরাই লেখাপড়া করার সুযোগ পায় না। হাজারো পরিবার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে, অনেকেই বাস করে চর এলকায়। এছাড়াও, অনেক শিশুরাই দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, তাই তারা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাছাড়া আদিবাসী গোষ্ঠীর শিশুরা, ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু পরিবারের সন্তানেরা অথবা শারিরীক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী শিশুরাও শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এসব শিশুদের বাবা-মায়েরা দরিদ্র আর বংশানুক্রমে তাদের সন্তানও এই দারিদ্র্যচক্রের মধ্যে আটকে যায়। যেসব শিশুরা পড়ালেখার সুযোগ পেয়ে থাকে তাদেরও অনেক সময় অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। কেননা, এখানে স্কুলগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং সেখানে পৌঁছানোও বেশ কঠিন। প্রত্যেক মানুষের মতো তাদেরও রয়েছে শিক্ষা গ্রহণের অধিকার। আর এই শিক্ষার মূলে রয়েছে ভাষা। মানুষ তার নিজ মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে বা বোঝাতে যতটা সক্ষম, তা অন্য ভাষায় সম্ভব না। অথচ, আদিবাসী শিশুদের প্রতিনিয়তিই শিক্ষা গ্রহণ করতে হচ্ছে বাংলা ভাষায়, যা তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা নয়। একারণে তাদেরকে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাদের বই মাতৃভাষায় বই দেওয়া হয়েছে অনেক জায়গায়। তবে শিক্ষক সংকটসহ নানা কারণে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা।

আদিবাসীদের নিয়ে সমাজের বৃহত্তর অংশে এখনও নানান ভুল ধারণা রয়েছে। তাদের সমাজ, জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই বহু মানুষের। দেশের আদিবাসীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের সুবিধাসহ নানা এবং নানা ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে আছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে সামাজিক নানাখাতে বাংলাদেশে অগ্রগতি হলেও আদিবাসীদের মধ্যে তা খুব একটা দৃশ্যমান নয়।
আদিবাসীদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, কারিগরি প্রশিক্ষণ, আবাসন, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এই অঞ্চলের নারীদের পারিবারিক ও সামাজিক নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতন চোখ বুঝে সহ্য করে জীবনযাপন করতে হয়।
মূল ধারায় নারীরা আজ শিক্ষা অধিকার থেকে বঞ্চিত না হলে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পেশা ও সামাজিক বিষয়ে অগ্রগামী নয় বলে নারীরা আজো তিমিরেই রয়ে গেছে। ঘর সংসার গোছানোর পাশাপাশি বাড়ির বাইরে মাঠে দিন মজুরির কাজ করে পারিবারিক আয়ের তাদের ব্যস্ত থাকতে হলেও খোদ নিজের পরিবারেই তাদের নিপীড়নের শেষ নেই।

তাই আদিবাসী নারীদের সংগঠিত করার জন্য তাদের পল্লীতে নারী দল গঠনের মাধ্যমে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। তবেই আদিবাসী নারীদের অগ্রগতি সাধিত হবে। পরিশেষে, জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রে যেসব অধিকারের কথা উল্লেখ আছে সেসব অধিকার নিয়ে সরকার সচেতন হতে পারলেই এই জাতি সুনাম অর্জন করবে ও উন্নত হবে।
আইন অনুষদ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট