চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় চার দফা নির্দেশ আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়

২৫ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:১৬ পূর্বাহ্ণ

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যায় গাম্বিয়ার করা মামলায় জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) ঐতিহাসিক রায়ে মানবতার জয় হয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে আদালত সর্বসম্মতভাবে মিয়ানমারের প্রতি চার দফা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। অন্তর্বর্তী ৪ নির্দেশ হচ্ছে- এক. মিয়ানমারকে অবশ্যই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সব ধরনের হত্যা, হত্যাপ্রচেষ্টা নিরসন করতে হবে। সেই সঙ্গে দূর করতে হবে তাদের যে কোনো রকমের শারীরিক বা মানসিক ক্ষতির আশঙ্কা। নিশ্চিত করতে হবে তাদের অধিকার। দুই. দেশটির সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী বা যে কেউ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর ব্যাপারে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র, উসকানি বা কুকর্মে সহযোগিতার সুযোগ পাবে না, তা নিশ্চিত করতে হবে। তিন. রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ধরনের প্রমাণ ধ্বংস করা যাবে না। সব প্রমাণ অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। চার. নির্দেশগুলো যথাযথভাবে যে পালিত হচ্ছে- ৪ মাস পর মিয়ানমার সে বিষয়টি নিশ্চিত করে আইসিজেকে প্রতিবেদন দাখিল করবে। এরপর থেকে চূড়ান্ত রায় দেওয়ার আগ পর্যন্ত প্রত্যেক ৬ মাস অন্তর অন্তর মিয়ানমারকে এ বিষয়ক প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। সেসব প্রতিবেদন গাম্বিয়াকে দেওয়া হবে। গাম্বিয়া সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে নিজেদের মতামত জানাবে। বিশ্বে আইনের শাসন ও মানবতার মর্যাদা রক্ষায় আইসিজে’র এ রায় ঐতিহাসিক এবং সারাবিশে^ মানবাধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে এ রায় নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে ফল নির্ভর করবে মিয়ানমারকে রায় মানতে বাধ্য করার উপর।

উল্লেখ্য, গত বছরের নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের ওপর ‘গণহত্যা’ চালানোর অভিযোগ তুলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এ মামলা করে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। এরপর গত ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের হেগে তিন দিনব্যাপী ওই মামলার শুনানি হয়। এতে মিয়ানমারের পক্ষে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি অংশ নেন। সে সময় তিনি রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে রাখাইনে সেনা অভিযানকালে কিছু সেনা আইন লঙ্ঘন করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন। অন্যদিকে মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখা যায় না বলে জানায় গাম্বিয়া। তারা রোহিঙ্গা গণহত্যা ও সহিংসতা বন্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে অন্তর্বর্তী নির্দেশ দেওয়ার অনুরোধ করে। অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাইসহ সবকিছুর বিচার-বিশ্লেষণ করে বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা সর্বসম্মতভাবে ঐতিহাসিক এ আদেশ দেন। কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চললেও এই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক আদালত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আদেশ দিলেন। রাখাইনে বসবাসরত সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গাকে সুরক্ষায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার যেসব আবেদন গাম্বিয়া করেছে, তার মধ্যে তিনটি যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছে আইসিজে। পাশাপাশি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আরেকটি আদেশও দিয়েছেন। নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী গাম্বিয়া, বাংলাদেশ সরকার, মানবাধিকার সংগঠন, মানবাধিকার কর্মী ও সুশীল সমাজ এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। আইসিজের প্রেসিডেন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতের আদেশ ঘোষণাকালে বলেছেন, ‘আদালত এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে চরম বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।’ অন্য ১৪ জন স্থায়ী বিচারপতি ও দু’জন অ্যাডহক বিচারপতির প্যানেল বলেছে, ‘১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জাতিসংঘ গণহত্যা কনভেনশনে বর্ণিত সব অপরাধ রোধে মিয়ানমারকে তার ক্ষমতার মধ্যে থাকা সবকিছু করতে হবে।’ ওই কনভেনশনে কোনো জনগোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাদের আংশিক ও পুরোপুরি নিঃশেষ করাকে গণহত্যা বোঝানো হয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার অভিযোগ ছিল, দুই বছর আগে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে সেনাবাহিনীর অভিযানে যে বর্বরতা চালানো হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশন ভঙ্গ করেছে মিয়ানমার। উল্লেখ্য, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু স্থাপনায় ‘বিদ্রোহীদের’ হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় দেশটির সেনাবাহিনীর পৈশাচিক অভিযান। সেইসঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গাদের ঢল। এর কয়েক মাসের মধ্যে বারো লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। তাদের কথায় উঠে আসে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারের বাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে। জাতিসংঘ গঠিত স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন বলেছে, রাখাইনে যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, আর যেভাবে তা ঘটানো হয়েছে, মাত্রা, ধরন ও বিস্তৃৃতির দিক দিয়ে তা ‘গণহত্যার অভিপ্রায়কে’ অন্য কিছু হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টার সমতুল্য।

আমরা আইসিজে’র রায়কে স্বাগত জানাই। আমরা মনে করি এ রায় রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে গুরুত্ববহ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে রায় বাস্তবায়নের উপর। মিয়ানমার ইতোমধ্যেই রায় প্রত্যাখ্যান করেছে। জাতিসংঘসহ বড় ধরনের আন্তর্জাতিক চাপ না থাকলে মিয়ানমার এই রায় বাস্তবায়ন করবে বলে মনে হয় না। পুরোবিশ্ব মানবিকবোধে উজ্জীবিত হয়ে নির্যাতিত ও বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের টেকসই পুনর্বাসনে সোচ্চারকণ্ঠ হলে সংকটের সম্মানজনক সমাধানে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। এখন জাতিসংঘসহ বিশ^সম্প্রদায় কি করে তা দেখার বিষয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট