চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

উজবেকিস্তানে কাছ থেকে যা যা দেখলাম, জানলাম

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী কালান্তরে দৃষ্টিপাত

১৩ জানুয়ারি, ২০২০ | ২:০৫ পূর্বাহ্ণ

সোভিয়েত রাশিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করা ৬টি মুসলিম দেশের মধ্যে উজবেকিস্তান অন্যতম। হিজরি প্রথম শতকে এখানে ইসলামের আগমন ঘটে। ফলে ইমাম বোখারী (রহ.) ইমাম তিরমিযী (রহ.) নক্শবন্দ বাহাউদ্দিন (রহ.)সহ বিশ^খ্যাত অনেক ওলি দরবেশ ইমাম এ দেশে শায়িত। রাজধানী তাশখন্দে সংরক্ষিত রয়েছে আমিরুল মোমেনীন হযরত ওসমান (র.) শহীদকালীন তেলাওয়াতরত পবিত্র কুরআন মাজীদ।
গত ৩১ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর ৭ রাত ৮ দিনের সফরে উজবেকিস্তান গমন করার সুযোগ হয়। দেশটি আমাদের বাংলাদেশ থেকে তিন গুণ বড়। ৪ লাখ ৪৭ হাজার বর্গ কি.মি। কিন্তু জনসংখ্যা ৩ কোটির কিছু বেশি মাত্র। প্রায় ৮০/৯০ বছর এ ৬টি মুসলিম দেশসহ অঞ্চলটি সোভিয়েত ইউনিয়নের কঠোর কমিউনিস্ট শাসনে ছিল। ফলে ধর্ম প্রচার নয়ই, ধর্ম পালন দুরূহ হয়ে পড়ে। মুসলমানগণের পরবর্তী বংশধর ধর্ম পালন কি তা না জানতে না জানতে নামে মাত্র মুসলমান বলা যাবে।
বাংলাদেশের কয়েকজন ব্যক্তি উজবেকিস্তানে বাংলাদেশীদের সফর করার উদ্যোগ নেন। তৎমধ্যে চট্টগ্রামেও একজন রয়েছেন। তিনি মোবাইলে এসএমএস দিতে থাকেন উজবেকিস্তানে ট্যুর করার ব্যাপারে। খরচ ১৪৫০ মার্কিন ডলার। ৩০ অক্টোবর দিবাগত রাতে দিল্লি থেকে উঠায়ে ৭ নভেম্বর দিবাগত রাতে দিল্লীতে পৌঁছায়ে দিবে। দিল্লি থেকে আকাশপথে রাজধানী তাশখন্দে নিবে-আনবে। তাশখন্দ পৌঁছলে অভ্যন্তরীণ বিমানে বুখারা নিবে। ফোর স্টার হোটেলসহ মান থাকবে। এভাবে তিনি একটি ট্যুর সিডিউল প্রথমে এসএমএস পরে হোয়াটসএ্যাপের মাধ্যমে অবগত করান। অর্থাৎ তথায় সে দেশে খাওয়া যাতায়াত যাবতীয় কিছু চার তারকামানের। অনেকের সাথ আমারও আগ্রহ জাগে যাওয়ার জন্য। বৃদ্ধ বয়স, শরীর দুর্বল। তারপরও মহান ইমাম, অলি দরবেশগণের যেয়ারতে যেতে মন থেকে তাড়িত হই। ফলে চট্টগ্রামের ঐ উদ্যোক্তা ব্যক্তির কাছে ১ম কিস্তি ৫০০ ডলারে বিনিময় পৌঁছায়ে দিই। আমি যাচ্ছি বিধায় এডভোকেট মুহাম্মদ ইলিয়াস, বাকলিয়া সাবেক কমিশনার এমদাদ উল্লাহ, দেশে প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব মরহুম জাকির হোসেন কন্ট্রাকটরের পুত্র আলহাজ¦ নুরুল ইসলামও ৫০০ ডলারের বিনিময় জমা করে দেন।
পরবর্তীতে জানতে পারলাম এখানে নকশবন্দিয়া তরিকার সুফি ফেস্টিবল হচ্ছে সে উপলক্ষে আমরা যাচ্ছি। এতে আমি বিব্রতকর অবস্থায় পড়ি। যেহেতু আমার অনুমান ছিল, কম লোকে সুবিধাজনকভাবে যেয়ারত হবে। কিন্তু যা হবার তাই হল। চট্টগ্রামসহ সারা দেশের প্রায় শতের কাছাকাছি লোকজন যাচ্ছেন। ভারত, পাকিস্তান, তুর্কি, সিরিয়া, ইংল্যান্ড, জার্মানী, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশ মিলে প্রায় ১৮৫ জনের গ্রুপ। জানতে পারলাম তাশখন্দের এক ট্যুর অপারেটর এর আয়োজক। মালয়েশিয়ার একজন বয়স্ক ব্যক্তি এর সমন্বয়ক। তিনি ইংরেজিতে দক্ষ। দেশ থেকে দিল্লি পৌঁছা, দিল্লি থেকে ফিরে আসা আমাদের নিজস্ব খরচ। বর্তমানে ভারতের ভিসা অনেকটা সহজ। ১ বছরের মাল্টিপল ভিসা দিচ্ছে। আমি ৬৫ বছরের উর্ধ্বে বিধায় ৫ বছরের ভিসা রয়েছে।
সপ্তাহখানেক আগে অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার নুরুল ইসলাম, এমদাদ উল্লাহ, এডভোকেট মুহাম্মদ ইলিয়াস ও মুহাম্মদ শরীফসহ আমরা ৫ জন চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা হয়ে দিল্লি পৌঁছি। ৬ দিনব্যাপী দিল্লি, আজমীর, সেরহিন্দ, রুরর্কী, যেয়ারত করে ৩০ অক্টোবর বুধবার দিবাগত রাত দিল্লি এয়ারপোর্ট পৌঁছি। বিমান বন্দরে বাংলাদেশ ভারতসহ শতের কাছাকাছি যেয়ারতকারীর সমাগম হয়। যথাসময়ে রাত সাড়ে বারটায় উজবেকিস্তান এয়ার লাইনে অনেকটা উত্তর দিকে তাশখন্দ রওনা। মাত্র আড়াই ঘণ্টার যাত্রায় বিমানের ভিতরে তাদের আতিথেয়তা সন্তোষজনক স্মরণযোগ্য। শেষ রাতে তাশখন্দ বিমান বন্দর পার হলে ট্যুর অপারেটরের পক্ষে মালয়েশিয়ার ঐ বয়স্ক সমন্বয়ক আমাদের সবাইকে একত্রিত করে ঘোষণা দিলেন যে, অভ্যন্তরীণ বিমানে আমাদের নেয়া যাচ্ছে না। এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমাদেরকে বুখারা ২ ট্রেনে নিয়ে যাওয়া হবে। একটি ৭টার ট্রেন আরেকটি ৯টার ট্রেনে।
ট্যুর অপারেটর ১৮৫ জন যেয়ারতকারীকে বুখরা একটি হোটেলে রাখে। যেয়ারতকারীগণের মধ্যে বাংলাদেশী শতের কম বেশি হবে। বাকীরা ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিরিয়া, জার্মানী ইত্যাদি দেশসমূহের। যেয়ারতকারীগণের মধ্যে অধিকাংশই নকশবন্দিয়া, মেজাদ্দেদীয়া সিলসিলা। ট্যুর অপারেটরের গাইডগণসহ প্রায় ২০০জনের যাতায়াতের জন্য তারা ৪টি বড় বড় বাস, তার চেয়ে ছোট আকৃতির ২টি গাড়ির ব্যবস্থা রেখেছিল। সাথে একটি পুলিশের গাড়ি ও একটি এম্বুলেন্স। তাশখন্দের ট্যুর অপারেটর হয়ত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে ৩ রবিউল আউয়াল তথা ১ নভেম্বর হযরত খাজা নক্শবন্দ বাহাউদ্দিন (রহ.)’র ওফাত বার্ষিকী। এ উপলক্ষে তারা সুফি উৎসব তথা ফেস্টিবলের আয়োজন করছে। বিভিন্ন দেশে থেকে অতিথিরা আসবে। মনে হয় এতে তারা ভিসা দেয়া, পুলিশ ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য পুলিশের গাড়ি ও এম্বুলেন্স পেয়েছে। বুখারার হোটেল তাদের বক্তব্য মতে তিন তারকামানের দাবী করছে। হোটেলটি গ্রহণযোগ্য বলা যাবে। সে মতে সকালের চা নাস্তাও গ্রহণযোগ্য। দুপুর বারটার পর ট্রেনে করে বুখারা হোটেলে এসে পড়লে জানতে পারি দুপুরের, রাতের খাবার ব্যবস্থাপনা অন্যখানে। ক্লান্ত দুর্বলতার কারণে আমি না গেলেও ট্যুর অপারেটরের ব্যবস্থাপনায় দুপুরের দিকে বের হয়ে যাই তাদের দেয়া প্রোগ্রাম মতে। রাত ১০টার পর ফিরে আসি। পরদিন ১ নভেম্বর শুক্রবার সকালে পুনঃ যেয়ারতে গমন। রাত ১০টার পর ফিরে আসি। পরদিন ২ নভেম্বর শনিবারও ৯টার পর পুনঃ রওনা রাতে ফিরে আসা। পরদিন ৩ নভেম্বর রবিবার সকালে হোটেল ছেড়ে দিয়ে যার যার নির্দিষ্ট বাসে বড় ছোট ব্যাগ তুলে নেয়া। প্রায় ৩ শত কি.মিটার দূরত্বে সমরকন্দের উদ্দেশ্য যাত্রা। এখানে শহরের অনতি দূরে হযরত ইমাম বোখারী (রহ.)’র মাজার যেয়ারতে আসা হয় দুপুর ২টার পর। মাজার কমপ্লেক্সের কিছুটা নিকটে একটি হলে খাবারের প্যাকেট সরবরাহ করা হয়। এখান থেকে আছরের নামাজের পর নিয়ে যাওয়া হয় সমরকন্দের শহরে নক্শবন্দিয়া তরিকার ইমামের মাজার কমপ্লেক্সে। অতঃপর নিয়ম মতে নিয়ে যায় একটি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবারের জন্য। রাত ১০টার পর হোটেলে। এখানে যেয়ারতকারীগণকে ২টি হোটেলে রাখা হয়েছে। আমাদের হোটেলটি বুখারা থেকে নি¤œমানের। এখানে ২ রাত ছিলাম। এ ২ দিন সকালের চা নাস্তা খুবই নি¤œমানের। কোন মতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দ্বিতীয় দিনও সমরকন্দে যেয়ারতে। তৃতীয় দিন তথা ৫ নভেম্বর মঙ্গলবার সকালে হোটেল ছেড়ে দিয়ে ছোট বড় ব্যাগ নিয়ে আমাদেরকে বাসে করে যেতে হবে প্রায় ৪ শত কি.মি দূরত্বে তেরমেজ শহরে যেয়ারতের উদ্দেশ্যে। এতে আমি ক্লান্ত দুর্বলতায় নার্ভাস হয়ে যাই। চট্টগ্রাম-ঢাকা মাত্র ২৪০/২৫০ কি.মিটারের দূরত্ব। ৪শত কি.মি দীর্ঘ পথ কিভাবে পাড়ি দিব। আগের দিন আয়োজকের সহায়ক চট্টগ্রামের টাকা সংগ্রহকারী ব্যক্তিকে বলি আমরা কয়জন অতিরিক্ত টাকা দিব। আমাদেরকে যেন বিমানে বা ট্রেনে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। উত্তর দিলেন, তিনি তাদেরকে জানিয়েছেন কিন্তু তারা তার কথাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। আয়োজকের সহায়ক চট্টগ্রামের টাকা কালেকশনকারী ব্যক্তি বারে বারে বলছিলেন কোন অসুবিধা থাকলে তাকে না বলে আয়োজনগণকে বলতে। যেহেতু তার কথা আয়োজক কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না। আয়োজকগণকে বাহিরে রেস্টুরেন্টে রাতের খাবারকালীন অনুরোধ করতে থাকি বয়স্ক দুর্বল শরীর আমার পক্ষে ৪ শত কি.মি বাস জার্নি করা সম্ভব না। আমাদেরকে বিমানে বা ট্রেনে অথবা বিশেষ গাড়ির ব্যবস্থা করুন, আমরা অতিরিক্ত টাকা দিব। কিন্তু তারা অপারগতা প্রকাশ করে। ফলে পরদিন ৭ নভেম্বর মঙ্গলবার সকালের চা নাস্তার পর সমরকেন্দ হোটেল ছেড়ে তেরমেজের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাই। (আগামি সোমবার সমাপ্য)

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট