চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মরণ : শিক্ষানুরাগী এম খায়রুল আমীন

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

৯ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:৩৭ পূর্বাহ্ণ

বোয়ালখালী উপজেলার উত্তর পূর্বাঞ্চল। একপাশে ছলছল প্রবাহমান কর্ণফুলী নদী, পূর্বে সবুজে ঘেরা পাহাড়ি এলাকা – যার বুক ছিঁড়ে নেমে এসেছে প্রমত্তা ভান্ডালজুরি খাল। পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে নবনির্মিত পদুয়া- ভান্ডালজুরি সড়ক হালে এলাকায় এনে দিয়েছে নয়নাভিরাম প্রাণচাঞ্চল্য। পাহাড়ের থলিতে কর্ণফুলী অববাহিকায় স্থাপিত হচ্ছে অত্যাধুনিক ও ব্যয়বহুল কর্মযজ্ঞ পানি শোধনাগার। সত্তর দশকের পরেও এখানে জীবনমান ও শিক্ষা দীক্ষায় ছিল অনগ্রসরতা। বর্তমানে একটি আলোিকত অঞ্চল। এখানে অবস্থিত জ্যৈষ্ঠপুরা গ্রাম। ’বড়বিল’র পূর্ব পশ্চিমে মুসলমানদের বসবাস, উত্তরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং দক্ষিণে হিন্দুদের প্রধান্য। আবহমানকাল থেকে সকল ধর্মাবলম্বীদের প্রীতিময় সহাবস্থান। মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন! স্কুল, মাদরাসা, মসজিদ, প্যাগোডা প্রভৃতি সভ্যতা ও সহমর্মিতা গড়ার ক্ষেত্রে ভাল অবদান রেখে চলেছে এখানে।

এক সময় কৃষিনির্ভর ও পাহাড় কাটা পেশায় এখানকার অধিবাসিদের সকাল শুরু হতো আর সন্ধ্যা নামত। বর্তমানে ঘরে ঘরে শিক্ষিত সচেতন নারী-পুরুষ। ছোট্ট একটা পল্লির নাম মাস্টার পাড়া। প্রায় তিন জেনারেশনে অনেকে মাস্টারি বা শিক্ষকতা পেশায় জড়িত। অনগ্রসর জ্যৈষ্ঠপুরা মাস্টার পাড়া কমিউনিটিতে স্বাধীনতা-উত্তর গারাঙ্গীয়া দরবারের পীর সাহেবদের আনাগোনা এখানকার শিক্ষা নৈতিকতা ও জীবনবোধ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এ সময় স্থানীয়ভাবে অনেকের সাথে শিক্ষাদীক্ষা প্রসারে, দানে ও সেবায় এগিয়ে আসেন মাওলানা ফয়েজ আহমদ, হামিদুল হক ক্যাশিয়ার ও এম খায়রুল আমীন ভ্রাতৃদ্বয়, বদন খলী সওদাগর, মজু সওদাগর, হাজী দুদু মিয়া ও কক্সবাজারের মাওলানা সৈয়দুল আলম প্রমুখ। এদের অনেকেই এখন পরপারে। শেষের দিকে কালের সাক্ষী ছিলেন অশীতিপর এম খায়রুল আমীন। সরকারি চাকরির পাশাপাশি বাকি সময়টুকু দান করেছেন তিনি এখানকার মাদরাসা, মসজিদ, স্কুল, সমাজ সমিতি ও অভাবী লোকজনের পাশে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে। তাই তার ইন্তেকালে নেমে এসেছে শোকাবহ পরিবেশ। গেল ২৭ নভেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। তার জানাজার নামাজ ও শোকসভায় অগুনতি ভক্ত ও সুধিজনদের উপস্থিতি সাদা মনের মানুষটির প্রতি সকলের অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালবাসার জানান দেয়। এতে বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ সোলায়মান, সমাজসেবী ইউপি চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মোকারম, মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব নুরুল আজিম, ড. শাহ মাওলানা এনামুল হক মোজাদ্দেদী, মাওলানা জাফর আহমদ জাহানাবাদী, মাওলানা আব্দুস সবুর আনসারি, অধ্যক্ষ মাওলানা মহসিন আল হুসাইনী, আলহাজ্ব আলী আকবর মেম্বার, আলহাজ্ব মাস্টার গোলাম মোস্তফা, সমাজসেবী আলহাজ্ব ইউসুফ জামাল, মাস্টার খায়রুল হক, আলহাজ্ব মাস্টার ফজলুল কাদের,তফাজ্জল হোসেন, সেকান্দর হায়াত কাউসার, মাওলানা আলী হোসেন, মাওলানা মুহাম্মদ ইদরিস ও ডা. এহসানুল হক সুজনসহ শিক্ষাবিদ সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বক্তাগণ মরহুম খায়রুল আমীন সাহেবের সামাজিক ও ধর্মীয় সেবাসমূহ উল্লেখ করে বলেন, এভাবে সমাজের প্রতি নিস্বার্থ নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি খুবই দুর্লভ।

তিনি জ্যৈষ্ঠপুরা ইসলামিয়া হামেদিয়া মাদরাসা, হামেদিয়া এতিমখানা,রশিদিয়া মাদরাসা, মাস্টার পাড়া জামে মসজিদ, ঐতিহ্যবাহী জ্যৈষ্ঠপুরা যুব সংঘ প্রভৃতির কখনো সভাপতি, সেক্রেটারি কিংবা কখনো উদ্যোক্তা/ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে অবদান রাখেন। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি তার এলাকা ও সমাজের খোঁজখবর নিতে ভোলেননি। এম খায়রুল আমীন (৮৫) ছিলেন বোয়ালখালী জ্যৈষ্ঠপুরা গ্রামের মরহুম আলী আহমদের ৩য় সন্তান।

উপরোল্লিখিত অপর ব্যক্তিত্ব মরহুম মাওলানা ফয়েজ আহমদও (মৃত্যু ৬ নভেম্বর ১৯৯৩) এলাকায় ব্যাপকভাবে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন শিক্ষা সভ্যতা ও ধর্মীয় মুল্যবোধ প্রতিষ্ঠার কারণে। মাওলানা ফয়েজ আহমদ ছিলেন স্থানীয় আনসার আলি মাতব্বর গোত্রের উত্তরসুরী।

এ জন্য তার বেশ প্রভাব ও কদর ছিল। হিন্দু, মুসলিম বৌদ্ধ- সবার শ্রদ্ধার পাত্র ও মুরুব্বী হিসেবে তিনি গণ্য হতেন। তিনি পাকিস্তান আমলে ইউ.পি সদস্যও নির্বাচিত হন। লেখাপড়া করেন চট্টগ্রামের বিখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ‘দারুল উলুম আলীয়া’ মাদ্রাসায়। পরবর্তীতে ঐতিহ্যবাহী খরণদ্বীপ স্কুল, জ্যৈষ্ঠপুরা সিনিয়র মাদ্রাসাসহ বোয়ালখালী ও রাঙ্গুনীয়ার বেশ কিছু মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জীবনের প্রায় সব ক’টি বসন্তই পার করে দেন। তার বহু ছাত্র-ছাত্রী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রয়েছেন। একজন শিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছাত্রছাত্রীরা তার কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। মাদরাসার শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম হিসেবে প্রচুর শ্রদ্ধা পেয়েছেন মুসল্লিদের কাছ থেকে। সমাজের শিরক, বিদআত ও কুসংস্কার দূরীকরণের প্রবল ভূমিকা ছিল তাঁর। তিনি ছিলেন গারাঙ্গিয়া দরবার শরীফের বড় হুজুর হযরত শাহ আবদুল মজীদ (রাহ.) এর সাগরিদ। অশ্লীল গান-বাজনাসহ অযাচিত আড্ডায় তিনি প্রতিবাদী ছিলেন। তাদের আদর্শ ও শিক্ষার ধারাবাহিকতায় আজও জ্যৈষ্ঠপুরা ও এর পার্শ্বস্থিত এলাকার লোকজন শান্তিপ্রিয়, ধর্মপরায়ণ ও পরস্পর সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ।

মরহুম এম খায়রুল আমিন সাহেবের বড় ভাই মরহুম আলহাজ্ব হামিদুল হক ক্যাশিয়ারও অনুরূপ সমাজের শিক্ষা ও সেবায় ব্যাপক অবদান রাখেন। গুণীজনদের স্মরণ ও বরণ করলে গুণধর লোকের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ধর্মীয় মনীষীদের শিক্ষা-দীক্ষা আদব আখলাক সহজ-সরল জীবনচরিত সমাজে চর্চা হলে সে সমাজ অনৈতিকতা ও অবক্ষয়ে ধ্বংস হয়না। আজ আমাদের সমাজে পূর্বপুরুষদের কীর্তিগাথা উপেক্ষিত বলে পারিবারিক কলহ, অশান্ত দাম্পত্য জীবন, সামাজিক অবক্ষয় সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
এলাকার শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষক এম খায়রুল আমীন আজ মৃত্যুর ওপারে, যেখানে সবার ঠিকানা সেখানকার বাসিন্দা। আছে শুধু তাঁর কিছু স্মৃতি কিছু চিহ্ন। আমরা তাঁর মাগফিরাত কামনা করি।

মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট