চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বাঙালির অহংকারের বিজয়

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি

১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:৪৫ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাঙালি অর্জন করে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তঝরা স্বাধীনতার বিজয়। বহুমাত্রিকতার এ বিজয় বাঙালি জাতিসত্তার হাজার বছরের সেরা অর্জন। হাজার নদী রক্তগঙ্গা বহমান স্রােত। ত্রিশ লাখ আত্নার মিছিলে যোগ হয়েছিল তিন লাখ মা-বোন, জায়া-জননীর সম্ভ্রমের দাবদাহ। রুখবার, বধিবার শক্তিসাহস ছিলো না কারোর, দৃশ্যমান বর্বর যাযাবরদের।
ডিসেম্বর হাজার বছরের অর্জনের মাস। ডিসেম্বর বিসর্জন ও বেদনার মাস। ডিসেম্বর বহুমাত্রিকতার বৈচিত্রময় মাস। দীর্ঘ সাড়ে আট মাস মুক্তিযোদ্ধাদের ধারাবাহিক ও বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ শেষে আসে এই ডিসেম্বর মাস। পাকিস্তানি বর্বর দখলদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধদের গেরিলা আক্রমনে তখন দিশেহারা।
ক্ষোভ ও হতাশায় আচ্ছন্ন পাকিস্তান ভারসাম্যহীন হয়ে পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ করে বসে ভারতকে। ভারত পাল্টা জবাব দেয়। আক্রমণ করে পাকিস্তানকে। ডিসেম্বরের তিন তারিখ থেকে শুরু হওয়া এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের সাথে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানে পাকিস্তানের বিপর্যয় ও পরাজয়কে দ্রুত তরান্বিত করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের কঠোর একাগ্রতা, মিত্রবাহিনীর নিবিড় সম্পৃক্ততা আমাদের বিজয়কে সহজ করে দেয়। ডিসেম্বরের চার তারিখে রাজতান্ত্রিক দেশ ভূটান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয়।এটি একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। স্বাধীনতার জন্য মুক্তির এ জনযুদ্ধে বাংলাদেশ বিশে^র একটি দেশ থেকে প্রথম স্বীকৃতি অর্জন করে। এ স্বীকৃতিকে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। বিভিন্ন রনাঙ্গনে পলায়নপর পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী একের পর এক পর্যুদস্ত হতে থাকে। সন্মুখযুদ্ধের চতুর্থ দিনে অর্থাৎ ছয় ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী ভারত দ্বিতীয় দেশ হিসাবে যুদ্ধরত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল দারুনভাবে উজ্জীবিত হয়। দেশের সব রনাঙ্গন থেকে বর্বর পাকিস্তানি হানাদারদের ঢাকামুখি পলায়নপর দৌঁড়ঝাপ সৈনিক যোদ্ধা-জনতার মনে ব্যাপক উদ্দীপনার সৃষ্টি করে।পাকিস্তানিদের শেয়াল পলায়নের এ প্রক্রিয়া চলে সাত, আট, নয়, দশ বার ডিসেম্বর পর্যন্ত। ততদিনে বর্বর পাকিস্তানিরা সারাদেশ থেকে পিছু হটে ঢাকায় গিয়ে একত্রিত হয়। তের, চৌদ্দ, পনের ডিসেম্বর শুধু পালানো ও পিছু হটার ইতিহাস। তাদের সাথে যুক্ত হয় রাজাকার, আলবদর,আলশামস বাহিনীর কেউটেরা। ছোট-বড় সব অমানুষরা একত্রে আমাদের জাতিসত্তার জন্য সুদূরপ্রসারী এবং সবচেয়ে নির্মম কাজটি ঘটানো হয় এসময়। আমাদের বুদ্ধিজীবী শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সংস্কৃতিকর্মীসহ বদ্ধিবৃত্তিক সমাজের মূল চালিকাকে তারা নির্মূল করতে নীল-নকসা তৈরী করে। তারা তাঁদের ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এটি ছিলো অত্যন্ত পরিকল্পিত, অত্যন্ত বর্বর। জাতি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে তাঁদের স্মরণ করে এই মাসের বিশেষ দিনে। বিজয়ের মাসে এ বিষাদকে ধারন করার যোগ্যতাও মুক্তিকামী বাঙালির ছিলো। আমরা তা প্রমাণ করেছি যথার্থভাবে। সব মিলিয়েই ডিসেম্বর মাস আমাদের সত্তায়, চেতনায় চির ভাস্বর। চির অম্লান।
আমাদের স্বাধীনতার বিজয় ঊনপঞ্চাশে। দেশ বিজয়ের আটচল্লিশতম বার্ষিকী উদযাপন করছে। সকল বেদনা ও বিসর্জনের বিলাপ আমাদের দৃঢ় হতে শক্তি যুগিয়েছে। আমরা দিনে দিনে তিলে তিলে শক্তিমান হতে পেরেছি।
স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। চেতনা আর স্বপ্নের কোন বয়স নেই। এগুলোর কোন সীমিত আকার বা আকৃতি নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন। আমাদের স্বপ্ন ও চেতনার মশালের জ¦ালানী, লাখো শহীদের রক্তের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ। এ প্রবাহ অনির্বান। সার্বজনীন। অদম্য ও অনিবার্য।
আমরা অনেক পথ পরিক্রমা করেছি। ১৯৭১-৭২ সালে আমাদের দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। আমাদের খাদ্য উৎপাদন ছিল এক কোটি ত্রিশ লাখ টন। খাদ্য উৎপাদন হতো চাহিদার তিন ভাগের এক ভাগ। মানুষের খাবারের চাহিদা মিটাতে বিশে^র দেশে দেশে ধর্না দিতে হতো। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সুযোগ আন্ত ও আন্তর্জাতিকভাবে কাজে লাগিয়ে চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়। অনেক অভাবি মানুষের মৃত্যু হয়। প্রতিবন্ধী বাসন্তিকে ছেড়া জাল পড়িয়ে প্রচার করা হয়, দেশে খাদ্যের পাশাপাশি পড়নের কাপড়ও নেই মানুষের। মধ্যপন্থা অবলম্বি মানুষের চেতনাকে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে সরিয়ে নেবার চেষ্ঠা করা হয়। আটচল্লিশ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যার ধারাবাহিক ও সুযোগ্য নেতৃত্ব সারা দুনিয়ায় আমাদের সম্মান ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে চলেছে।
দেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় সতের কোটি। মানুষ বেড়েছে। চাষের জমি কমেছে। আমরা আকাক্সক্ষার চেয়ে সফলতা অর্জন করেছি খাদ্যোৎপাদনে। খাদ্যরাজনীতি আমাদেরকে আর আক্রান্ত করতে পারে না। আমরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সফলভাবে অর্জন করেছি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা আমরা অর্জন করবো। ইতিমধ্যেই আজকের এই বাংলাদেশ খাদ্যদ্রব্য, মাছ, সবজি, ফল, তৈরি পোষাক উৎপাদনসহ আরও অনেক সূচকে পৃথিবীর দেশগুলোতে এক থেকে দশের ভিতর অবস্থান করছে।
লক্ষ্য এখন টেকসই অবস্থানের দিকে যাওয়া। এটিই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এটিই বিজয়ের চেতনা। এখানেই রক্তে কেনা বাংলাদেশের চেতনাসবাক ও আলোকোজ্জল, দিপ্তীময় দ্বিধাহীন। এখানেই সার্থক সতের কোটি বাঙালি জনমানুষের লক্ষ্য চেতনা ও একাগ্রতা। ১৯৭২ সালে ১৫% কৃষিজ জমিতে জলসেচ দেয়া গেলেও, এখন দেয়া যায় ৬৫% জমিতে। ১৯৭২ সালে আমাদের রপ্তানিপণ্য ছিল পঁচিশটি। রপ্তানি হতো পৃথিবীর পঁয়ষট্টি দেশে। যার ভিতর প্রধান ছিল পাট, চা, চামড়া। ২০১৯ এর বাংলাদেশ পৃথিবীর একশত আটানব্বই দেশে রপ্তানি করে প্রায় আটশত পণ্য। তাহলে ধরে নেয়া যায় আমরা এগিয়েছি। ধারাবাহিকভাবে এগুচ্ছি। নারী-পুরুষ সমতায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমরা সবার চেয়ে এগিয়ে। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ।
সুতরাং চেতনা আমাদের জাগিয়ে রেখেছে বলা যায়। জাগ্রত বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চাষ করে বছরের বারমাস। বিজয়ের প্রেরণা, একুশের চেতনা, মার্চের তাড়ণা, আগস্টের শোকের বেদনা উৎসারিত প্রতিজ্ঞা আমাদের শাণিত করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের সার্বিক চালিকাশক্তি। বিজয়ের মাসের উদিত প্রতিটি সূর্যই সুকান্ত সুর্যের আলোকচ্ছটায় ত্রিশলাখ প্রাণের অহংকারের বার্তা নিয়ে উদভাসিত হয়। প্রতিটি ভোর আলোকোজ্জল, প্রতিটি দুপুর কর্মচঞ্চল, প্রতিটি সন্ধা মায়াময় উদার প্রতিশ্রুতিতে ভরা। এভাবেই বছরের বারমাস।
বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম, ত্যাগ ওসার্বিক জীবনাদর্শ আমাদের প্রেরণার উৎস। স্বাধীনতার আটচল্লিশতম বার্ষিকীতে বাঙালির অহংকারের বিজয়ই হোক বাঙালির স্বরূপের সোপান। অহংবোধের চির অম্লান মশাল।

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট