১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর দুপুর বারটা থেকে একটার মধ্যে গৈড়লার টেকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর দোসরদের সাথে ন্যাপ কমিউন্টি পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর এক সাহসিকতাপূর্ণ সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দক্ষিণ চট্টগ্রামে এত বড় যুদ্ধ আর হয়নি। এই যুদ্ধে গেরিলা বাহিনী নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। রাজাকার, মিলিশিয়া, বিহারি লড়ি ড্রাইভার ও হেলপার এবং পুলিশের লোক মিলে দখলদার বাহিনীর দোসরদের মোট চৌদ্দ জন এই সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হয়। বন্দী হয় প্রায় নব্বই জন। এই যুদ্ধে আমাদের গেরিলা বাহিনীটি সম্পূর্ণ অক্ষত থাকে। প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র ও গোলাবারুদ আমাদের গেরিলা বাহিনীর হাতে আসে।
পুলিশ বাহিনীর আত্মসমর্পনের সংবাদ : ধলঘাট ইউনিয়নের সে সময়কার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ঈশ্বরখাইন নিবাসী মাওলানা ইমাম শরীফ আমাদের কাছে দখলদার বাহিনীর নানা সংবাদ গোপনে সরবরাহ করতেন। তিনি আমাদের জানালেন যে পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী ও সাতকানিয়া থানার সকল পুলিশ অস্ত্র শস্ত্র ও গুলির বাক্সসহ পটিয়া থানায় সমবেত হয়েছে। তারা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের কথা ভাবছে। আমাদের কমান্ডার মোহাম্মদ শাহ আলমের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে তিনি ওদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং সাব্যস্ত হয় যে, ৯ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে ৯টার ভিতর ধলঘাট ডিআইবি ক্যাম্পের নিকটবর্তী কোন স্থানে ঐ পুলিশ বাহিনী আমাদের গেরিলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে।
অ্যামবুশ পরিকল্পনা : প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের কমান্ডার কমরেড মোহাম্মদ শাহ আলম, ডেপুটি কমান্ডারদ্বয়, দলের সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা হীরা ভাই ও ইউসুফ ভাই বসে অ্যাকশন প্ল্যান করলেন। সেই প্ল্যান মোতাবেক স্থির হলো আমরা ধরঘাট ক্যাম্পের প্রবেশ পথে অ্যামবুশ করে অবস্থান করব। তাদের যদি কোন দুরভিসন্ধি থাকে তবে তাদের ওপর অ্যামবুশ (অসনঁংয) করব। আরও নিশ্চিদ্র সতর্কতার কারণে আমাদের দু’জন মুক্তিযোদ্ধা খুব ভোরে চলে গেলেন পটিয়ার ফাইনাল রেকি করে আসার জন্য।
পরিকল্পনা পরিবর্তন : ধলঘাট ক্যাম্পের প্রবেশ পথে আমরা অ্যামবুশ করে আছি সকাল সাতটা থেকে। নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও আত্মসমর্পণকারীরা নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হলো না। একটু পরে পটিয়ার ফাইনাল রেকি করতে যাওয়া দু’জন ফিরে এলো। তাদের কাছ থেকে খবর পাওয়া গেল যে, পুলিশ বাহিনীর সকালে ধলঘাটে আসে আত্মসমর্পণে একমত নয়, তারা শহরে ফিরে যাওয়ার পক্ষপাতি। ফলে ত্বরিৎ পরিকল্পনা পাল্টাতে হলো।
এবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আমরা গৈড়লার টেকে তাদের যানবাহন-এ অ্যামবুশ করব। তাই আমরা দ্রুত গৈড়লার টেকে চলে গেলাম। জায়গাটা কমান্ডার, ডেপুটি কমান্ডারদ্বয় ও হীরা ভাই ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে কিলিং জোন নির্ধারণ করলেন। পাকা সড়ক থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে লম্বা লাইনে ধানক্ষেত ও জমিনের আলকে আড়াল করে আমরা অবস্থান নিলাম ফ্রন্ট কাট অফ (ঋৎড়হঃ ঈঁঃ ড়ভভ) হিসেবে। তাদের উপর অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল আত্মসমর্পণকারী পুলিশের গাড়ি ছাড়া অন্যান্য গাড়িগুলোকে আটকে দেয়া।
তিনজনের একটি দল রিয়ার অফ (জবধৎ ঈঁঃ ড়ভভ) হিসেবে শাহগদী মার্কেটের দিকে অবস্থান নিল। সেই দলের উপর বাড়তি দায়িত্ব ছিল শহর থেকে আসা গাড়িগুলোকে আটকে দেয়া।
মূল অপারেশনের পূর্ববর্তী কিছু ঘটনা
মূল অপারেশনের আগেই প্রথমে রিয়ার কাট অফদের সাথে সশস্ত্র অবস্থায় ধরা পড়লো তিনজন মিলিশিয়া ও চারজন রাজাকার।
এদিকে পুলিশের বাস আসার আগেই কিলিং জোনে এসে ঢুকলো আজিজ নগর থেকে চট্টগ্রাম শহর অভিমুখী রমনা সিগারেট বোঝাই একটা ট্রাক। ঐ ট্রাকের ড্রাইভার ও হেলপার ছিল বিহারী। ফ্রন্ট কাট অফদের সিগন্যাল অগ্রাহ্য করে ট্রাকটি দ্রুত পালাচ্ছিল। পুরো কিলিং জোন নির্বিঘেœ অতিক্রম করে গেল ট্রাকটি। চাকা লক্ষ্য করে দ্রুত ধাবমান ট্রাকটিকে থামানো যায়নি। কিন্তু কিলিং জোন পার হওয়ার মুখে পালবাড়ি ঘাঁটায় (সদর দরজা) রিয়ার কাট অফরা ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে গুলি করে খতম করলো। ট্রাক ছিটকে পড়লো রাস্তার পাশে। ছুটে পালানোর পথে হেলফারও গুলি খেয়ে মারা গেল।
মূল অপারেশন : দুপুর বারটার কিছু পরে পুলিশ বোঝাই বাস কিলিং জোনে ঢুকলো। কমান্ডার কমরেড মোহাম্মদ শাহ আলম আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়লেন তার স্টেনগান থেকে। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা সবাই আকাশের দিকে দু’এক রাউন্ড গুলি করলো। হীরাভাইও তেমনিভাবে এলএমজি থেকে কয়েক দফা ব্রাশ ফায়ার করলেন। এ অবস্থায় পুলিশ বাহিনী তাদের বাস থামিয়ে জানালা দিয়ে অস্ত্র ফেলে দিতে শুরু করলো। কমান্ডার শাহ আলম ভাই তা দেখে উচ্চৈস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, চিস ফায়ার, চিস ফায়ার, আত্মসমর্পণ করো।
কিন্তু আশ^র্যের ব্যাপার হলো এই যে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছোঁড়া বন্ধ করতেই শুনতে পায় ফায়ারিং এর আওয়াজ। বাসগুলো থেকে কয়েকজন নেমে গিয়ে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছিলো। কয়েকজনের পরনে ছিল রাজাকারের পোশাক, আবার কারো পরনে ছিল লুঙ্গি এবং সাধারণ শার্ট। কেউ কেউ গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পালিয়েও যাচ্ছিল। ওদের ছোঁড়া গুলি সোঁ সোঁ শব্দ করে আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় ঐ লোকগুলোকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া ছাড়া আমাদের গত্যন্তর ছিল না। ফলে ওখানে ওদের পাঁচজন বুলেট্ বিদ্ধ হয়ে মারা গেল। এরপর ঐ বাসগুলোর দিকে আসা গুলির আওয়াজ বন্ধ হলো। আমাদের বুঝতে বাকি রইলনা কেন ওরা পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধলঘাটে আত্মসমর্পন করেনি। পুলিশদের মধ্যে একটা অংশ এবং তাদের সাথে থাকা কিছু রাজাকার ও মিলিশিয়া সদস্য এই আত্মসমর্পণের পক্ষে ছিল না। তারা শহরে ফিরে যাওয়ারই পক্ষপাতী ছিল। পুলিশদের বিরাট অংশ আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চলেছে এ তথ্য তাদের কাছে ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। তারা সম্ভবত পাকিস্থানি দখলদার বাহিনীর কাছে সে তথ্য ও প্রেরণ করেছিল। এই অনুমানের কারণ হলো এই যে, গৈড়লার টেকে যখন যুদ্ধ চলছিল তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটা দল দুটো পিক আপ আগে করে শহর থেকে পটিয়ার দিকে আসছিল। এর আগে রাজাকার ও মিলিশিয়াদের একটা দল পটিয়ার দিকে আসতে গিয়ে আমাদের হাতে ধরা পড়ে খতম হলো। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যে দলটি শহর থেকে পটিয়ার দিকে আসছিল তারা মনসা বাদাম তলে এসে এলএমজি ও স্টেনগানের ব্রাশফায়ারসহ ব্যাপক গোলাগুলির আওয়াজ পেয়ে আমরা শহরের দিকে ফিরে যায়। একইভাবে আমাদের অ্যামবুশে পড়া বাহিনীর পেছনেও পাকিস্তানি নিয়মিত বাহিনীর পিক আপ ছিল যেগুলো কাগজীপাড়া মসজিদের ওখান থেকে ফিরে যায়। বস্তুত: রাজাকার, মিলিশিয়া, আলশাম্স ইত্যাদি বাহিনীকে সামনে ঠেলে দিয়ে পাকিস্তানি নিয়মিত বাহিনী নিরাপদ দূরত্বে থাকার কৌশলটি এক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়েছে।
সে যায় হোক, ঐ যুদ্ধে আমাদের গেরিলা বাহিনীর কোন সদস্যই আহত বা নিহত হয়নি। ক্যামুফ্ল্যাক্স করা অবস্থায় তারা আমাদের প্রকৃত অবস্থান বুঝতেই পারেনি। গোলাগুলি সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার পর কমান্ডারের নির্দেশে আমরা বাসের দিকে অগ্রসর হলাম। প্রথমে পুলিশের লোকগুলোকে বন্দী করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হলো। এতগুলো বন্দী পুলিশকে নিয়ে যাওয়া, এত অস্ত্র-শস্ত্র ও গুলির বাক্স বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু সেই অসম্ভব কাজকে সম্ভব করে তুলতে এগিয়ে এল এলাকার মানুষ। কমরেড আবদুস সালাম মাস্টার, কৃষক নেতা সোলায়মান এর নেতৃত্বে তেকোটা, গৈড়লা, নাইখাইন, ঊনাইনপুরা, পাইরোল, করণখাইন ও মুকুটনাইট গ্রামের শত শত মানুষ ও তরুণ যুবক এগিয়ে এল আমাদের সহযোগিতা করে এবং আনন্দ মিছিল করে।
গৈড়লার টেকের সম্মুখ যুদ্ধের প্রভাব : এই সফল সম্মুখ যুদ্ধের ফলে সমগ্র এলাকার ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। সাধারণ মানুষের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া বহু মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র ও গুলির অভাব মিটে। প্রশিক্ষণের সময় চানমা (গুলি ফুটিয়ে চর্চা করা) সমস্যা দূরীভূত হয়। দলে দলে তরুণ ও যুবক প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ছুটে আসে এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতে থাকে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি- ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনী ভারতের আসাম রাজ্যের তেঁজপুরে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে এসেছে গৈড়লার টেকের যুদ্ধসহ গোপাল পাড়া, ধলঘাট স্টেশন ইন্দ্রপুল, পটিয়া থানার পতাকা উত্তোলনসহ ছোট খাট আরো অনেক অপারেশনে বিশেষ গেরিলা বাহিনী অংশ গ্রহণ করে। গৈড়লার টেকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী ভারতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত গেরিলাদের মধ্যে ছিলেন
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শাহ আলম, উদয়ন নাগ-ডেপুটি কমান্ডার, মোহাম্মদ ইউছুফ, বীর মুক্তিযোদ্ধা শামশুজ্জামানা হীরা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা তপন দস্তিদার, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখর দস্তিদার, সুজিত কুমার বড়–য়া, আনোয়ার হোসেন, নজরুল ইসলাম, প্রিয়তোষ বড়–য়া, পুলক দাশ, কামারুজ্জামান, মোয়াজ্জেম হোসেন, সুশীল চক্রবর্তী, ভূপাল দাশগুপ্ত, মোহাম্মদ আলী, মিয়া জফর আহমদ, আবুল কাশেম, অসিত দাশ, শেখ মানিক, পিযুষ রক্ষিত বড়–য়া।
এছাড়া ছালতা ছড়িতে ট্রেনিং প্রাপ্ত বিপুল সংখ্যক গেরিলা যোদ্ধা গৈড়লার টেকের যুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের অমূল্য অবদান রাখেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা : মহান মুক্তিযুদ্ধে কৃষক-শ্রমিক-ভূমিহীন পরিবারের সন্তানেরা বেশী মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে কারণ তাদের কোন পিছু টান ছিল না। এ শ্রেণি মানুষের প্রত্যাশা ছিল বিশাল।
দেশ-অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসার নিশ্চিতা পাবে। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র থেকে দেশ অসাম্প্রদায়িক বিজ্ঞানমনষ্ক রাষ্ট্র হবে। কিন্তু স্বাধীরতার ৪৮ বছর পর দেখা যাচ্ছে দেশী-বিদেশি স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীসমূহ পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যুদ্ধাপরাধী-জঙ্গিবাদী-মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহ এক হয়ে দেশের প্রগতির চাকাকে বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ধর্মান্ধ, জঙ্গীবাদ, সম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিরোধ করতে মুক্তিযুদ্ধে চেতনায় বিশ্বাসী দেশবাসীকে এক হতে হবে।
এখন সময়ের দাবী : এখন সময় এসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল দেশপ্রেমিক নাগরিক এক হতে হবে। যুদ্ধাপরাধী-জঙ্গীবাদী গোষ্ঠীসমূহের অপতৎপরতা সম্পর্কে দেশবাসীকে সচেতন করতে হবে। কারণ এই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ কখনো লিবিয়া, ইরাক, ইয়ামেন, সিরিয়া হোক কেউ চায় না। চাইতে পারে না, ১৬ কোটি মানুষের অতন্দ্র প্রহরী হিসাবে প্রগতিশীল রাজনৈতিক সামাজিক শক্তিকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার বিকল্প পথ নেই।
ফজল আহমদ মুক্তিযোদ্ধা; কমান্ডার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধ সংসদ