চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রোহিঙ্গা সংকট : অপপ্রচারের দাঁতভাঙা জবাব দিতে হবে

২৭ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:৩৪ পূর্বাহ্ণ

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গণহত্যা মামলার শুনানিকে সামনে রেখে মিয়ানমার আবারও মিথ্যাচারসহ বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। রাখাইনে গণহত্যার শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বদলে দেশটি এখন অপকৌশল ও অপপ্রচারেই মেতে উঠেছে। দেশটির প্রধান লক্ষ হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করা এবং রোহিঙ্গাদের চিরদিনের জন্যে দেশছাড়া করা। দুঃখজনকভাবে কয়েকটি প্রভাবশালী দেশও মিয়ানমারকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এমন তৎপরতা এ অঞ্চলতো বটেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ পুরোবিশে^র স্থিতিশীলতার জন্যেও হুমকিপূর্ণ। এখনই মিয়ানমারের অপপ্রচারের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে যুক্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে দেশটিকে বাধ্য করতে ব্যর্থ হলে এর চরম মাসুল দিতে হবে এক সময়।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত ১৫ নভেম্বর মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির কার্যালয়ের একজন মুখপাত্র সংবাদ সম্মেলনে দবি করেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সহযোগিতা করেনি এবং দু’দেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেনি। ওই মুখপাত্র আন্তর্জাতিক আদালতে রাখাইনে গণহত্যা বিচারের মামলার জন্যও কঠোর সমালোচনা করেন। রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নানামুখী রাজনীতির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও দায়ী করেন তিনি। ওই সংবাদ সম্মেলনের পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এবং পশ্চিমা বেশ কয়েকটি দেশের দূতাবাসে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ অসহযোগিতা করছে, চুক্তির শর্ত মানছে না- এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে নেপিদোতে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের মাধ্যমেও বাংলাদেশ-বিরোধী অপপ্রচার চালানো হয়েছে। প্রসঙ্গত, আইসিজেতে গাম্বিয়ার মামলার পর মিয়ানমার রোহিঙ্গা ইস্যুতে বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছে। কারণ হেগের এই আদালত থেকে গণহত্যার জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে রায় দিলে তা সব সদস্য রাষ্ট্রকে মানতে হবে। এর ফলে আদালতের রায়ে গণহত্যার জন্য কেউ চিহ্নিত হলে এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের রায় হলে, ওই ব্যক্তিরা সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে ভ্রমণ করতে পারবেন না। আইসিজের সদস্য কোনো রাষ্ট্রে ভ্রমণে গেলেই তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটির প্রতিবেদনও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। ফলে বিচারের রায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ফলে এ মামলা মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে নতুন করে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। আইসিজেতে মামলার জন্য মিয়ানমার বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতাকেই দায়ী করছে। এ অবস্থায় সংকট সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করতেই মিয়ানমার পুরোদমে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারে মেতে উঠেছে। তবে এ ধরনের অপপ্রচার মিয়ানমারের জন্য খুব বেশি লাভজনক হবে না। কারণ রাখাইনে মিয়ানমার বাহিনী কী ধরনের গণহত্যা চালিয়েছে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করতে কী ধরনের অপকৌশল নিয়েছে, সেটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে স্পষ্ট। তারপরও মিয়ানমারের এ ধরনের অপপ্রচার বাংলাদেশকে কিছুটা হলেও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে। এ অবস্থায় যথাযথ তথ্যপ্রমাণ দিয়ে মিয়ানমারের অপপ্রচারের দাঁতভাঙ্গা জবাব দান এবং দেশটির রোহিঙ্গাবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে আরো শক্ত অবস্থান নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারের বিকল্প নেই।

একথা অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, রাখাইনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ধারাবাহিক জাতিগত নিষ্ঠুর নির্মূল প্রক্রিয়া চলেছে। মিয়ানমারের বর্তমান সরকারও তারই ধারাবাহিকতায় সংকটকে আরও চরম মাত্রায় নিয়ে গেছে। মূলত রোহিঙ্গা সংকটের উৎস মিয়ানমার এবং সমাধানও মিয়ানমারকেই করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার জন্য মিয়ানমারই একমাত্র দায়ী। মিয়ানমারের অপপ্রচারের কারণেই বরং রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল হচ্ছে এবং প্রত্যাবাসনও বিলম্বিত হচ্ছে। বাংলাদেশের ওপর দোষ চাপিয়ে পার পাবে না মিয়ানমার। বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির শর্ত অনুযায়ী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সব সময়ই পূর্ণ সহযোগিতা দিয়ে আসছে। কিন্তু নিরাপত্তা ও সম্মানজনক নাগরিক মর্যাদার নিশ্চয়তা না পাওয়ায় রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। গত আগস্ট মাসে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই রোহিঙ্গারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, রাখাইনে তাদের স্থায়ী বসবাসের নিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা ফিরে যাবে না। রাখাইনে নিরাপত্তা এবং নিশ্চয়তা সৃস্টির দায়িত্ব মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। সংগতকারণে আগস্ট মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করার কোনো সুযোগ নেই।

মিয়ানমার যে পথে হাঁঁটছে তাতে তারা নানাভাবে বিশ্বসম্প্রদায়কে বিভ্রান্তিতে রেখে ফায়দা লুঠতে চায়। এ অবস্থায় সংকট সমাধানে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির বিকল্প নেই। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত রোহিঙ্গাদের সমনাগরিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলোর দ্রুত সুনিষ্পত্তি করে কোনো ধরনের কালক্ষেপণ ছাড়াই সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখা। আমাদের বিশ^াস, পুরোবিশ্ব মানবিকবোধে উজ্জীবিত হয়ে নির্যাতিত ও বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের টেকসই পুনর্বাসনে সোচ্চারকণ্ঠ হলে সংকটের সম্মানজনক সমাধানে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট