চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

খাদ্য ও বিচরণক্ষেত্র নিরুপদ্রব রাখতে হবে বন ছেড়ে হাতি লোকালয়ে

২৬ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:৫৮ পূর্বাহ্ণ

সাম্প্রতিক সময়ে লোকালয়ে হাতির পালের হানা দেয়ার খবর প্রায়ই গণমাধ্যমের আসছে। বিশেষ করে পাহাড়-অরণ্যের কাছাকাছি জনপদগুলোতে হাতির পদচারণা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। এতে ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। সর্বশেষ গত রবিবার বোয়ালখালী উপজেলায় ৯টি হাতির একটি পাল লোকালয়ে প্রবেশ করে তিন জন সাধারণ মানুষ ও একটি গরুকে হত্যা করার খবর প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক পূর্বকোণে। এভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে বার বার লোকালয়ে হাতির পালের অনুপ্রবেশ এবং ফসলহানিসহ হতাহতের ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত, খুবই দুঃখজনক ও উদ্বেগকর। তবে এসব ঘটনা যে বন-প্রকৃতির প্রতি মানুষের আগ্রাসী তৎপরতার পরিণাম তাতে দ্বিমতেরও সুযোগ নেই।

দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, হাতির পালটি গত ২৩ নভেম্বর ভোরে পাহাড় থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব কধুরখীল দারোগার বাড়ি বায়তুল ফালাহ জামে মসজিদের সুপারি বাগানে অবস্থান নিয়েছিল। খবর ছড়িয়ে পড়লে হাতির আশেপাশে উৎসুক জনতার ভিড়ও বেড়ে যায়। একইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে জনতার উপর হাতির পালের ক্ষোভও। এক পর্যায়ে হাতির পালটি বনের দিকে চলে যাওয়ার পথে কয়েকজনকে আঘাত করলে তিনজন মারা যায়। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, হাতির পালে ৩টি বাচ্চা ছিল। বাচ্চা থাকলে হাতি বেপরোয়া আচরণ করে। বনবিভাগের কর্মকর্তাদের অন্তত তা জানা থাকার কথা। কিন্তু তারা উৎসক জনতাকে নিবৃত করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি হাতির পালকে তারা নির্বিঘেœ পাহাড়ে চলে যেতেও সাহায্য করেনি বলে অভিযোগ আছে। যদি বনবিভাগ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতো তাহলে হয়তো প্রাণহানির মতো দুঃখজনক ঘটনার জন্ম হতো না। আগামিতে এমন ঘটনার পথ বন্ধ করতে অন্তত বিষয়টি খতিয়ে দেখে দায়ীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম অঞ্চলে গত দুই বছর ধরে বারবার পাহাড় ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসছে হাতি। সেসব এলাকাগুলোতে আসছে, যেখানে আগে কখনো হাতির এমন বিচরণ দেখা যায়নি। হাতির আক্রমণে প্রায়ই প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বিচারে পাহাড়-বন উজাড়, দখল আর অপরিকল্পিত উন্নয়নে হারিয়ে যাচ্ছে বিচরণ ক্ষেত্র। দেখা দিয়েছে খাদ্য সঙ্কট। আর এই কারণে লোকালয়ে চলে আসছে হাতির পাল। ফলে হাতি পাল বেঁেধ খাদ্যের খোঁজে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। এতে বিশালকায় অথচ শান্ত এই পশুর আক্রমণে ঘটছে প্রাণহানি। প্রসঙ্গত, একটি হাতি প্রতিদিন প্রায় ১৩০ কেজি খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু বনে-জঙ্গলে মানুষের লোলুপ দৃষ্টি পড়ার ফলে হাতির খাদ্য ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। আর এই খাদ্যঘাটতি মিটাতেই হাতি ঝুঁকি নিয়ে প্রবেশ করছে লোকালয়ে। আবার আবাসস্থল ধ্বংস, চলাচল পথ বা করিডোর বাধাগ্রস্ত হওয়া ও হাতির চলাচলপথে মানববসতি স্থাপনের কারণে লোকালয়ে বুনো হাতির তা-বও বেড়ে গেছে। গেল নয় বছরে হাতির পায়ে পিষ্ঠ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে ৪৮ জন। চরম খাদ্যাভাব, দুর্ঘটনা আর মানুষের হামলাসহ নানা কারণে হাতিও মারা যাচ্ছে সমান তালে। পরিসংখ্যান বলছে, গত ১৮ বছরে মারা গেছে ৮৮টি হাতি। খোদ সরকারের বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে মহাবিপদে আছে হাতি। বিচরণ ক্ষেত্রসহ নিরাপদ আশ্রয় ও খাবার নিশ্চিত করা না গেলে বিপন্ন হতে পারে বন, বন্যপ্রাণি ও পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু ঐরাবত। একইসঙ্গে বিভিন্ন জনপদেও পাগলা হাতির তা-বে ফসল ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটবে।

আমরা মনে করি, এই চিত্রের অবসান করতে চাইলে বন্ধ করতে হবে নির্বিচারে বন-জঙ্গল উজাড়করণ ও পাহাড় দখল তৎপরতা। প্রশস্ত করতে হবে হাতির নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র। পর্যাপ্ত খাদ্যেরও ব্যবস্থা করতে হবে। পাহাড়ে বনায়নের সময় হাতির খাদ্যের উপযোগী গাছপালা লাগাতে হবে। বন-জঙ্গলে শিকারিদের অপতৎপরতাও বন্ধ করতে হবে। তারা খাবার ও পানির সন্ধানে যেসব পথ দিয়ে নিয়মিতভাবে চলাচল করে, সেগুলোকে মানুষের উপদ্রব থেকে মুক্ত করার উদ্যোগও নিতে হবে। হাতি অধ্যুষিত সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমানা হতে বাইরের দিকে কমপক্ষে দুই কিলোমিটারের মধ্যে বন্ধ করতে হবে যে-কোনো ধরনের চাষাবাদ, ইটের ভাটা ও বসতি স্থাপন। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার বলিষ্ঠ উদ্যোগও থাকতে হবে। যদি হাতিকে পর্যাপ্ত খাদ্য ও পরিবেশ দিয়ে নির্বিঘœ রাখা যায়, তাহলে লোকালয়ে তারা হানা দেবে না। এতে ফসল ও জনহতাহতের ঘটনাও ঘটবে না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট