চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত

প্রফেসর ড. মোঃ আবু তাহের

২৬ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:৫৮ পূর্বাহ্ণ

ওর্য়াল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অধ্যাপক ক্লাউস শোয়াইব (কষধঁং ঝপযধিন) ২০১৬ সালের প্রথম থেকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (ও৪) নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। মূলত ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল প্রথম শিল্পবিপ্লব যা মানুষকে আধুনিক শিল্পায়নের দিকে ধাবিত করে। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব অর্থাৎ ১৮৭০ সালের শুরু হয় বিদ্যুৎ ব্যবহার করে গণ-উৎপাদন। উদ্ভব ঘটে প্রোডাকশন লাইন ধারণার। এতে উৎপাদন বাড়ে বহুগুণ। ইলেকট্রনিকস্ আর তথ্যপ্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ট্রানজিস্টর অবিষ্কারের পর শুরু হয় তৃতীয় শিল্পবিপ্লব।

কম্পিউটারের ব্যবহার ও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিসহ আবিস্কৃত ইন্টারনেট বিশ^কে এনে দেয় মানুষের হাতের মুঠোয়। উদ্ভব ঘটে প্রোগ্রামেবল লজিক কন্ট্রোলার (পিএসসি) ব্যবস্থার। আর তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের উপর ভর করেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। এ হচ্ছে প্রযুক্তির এক ধরনের মিথস্ক্রিয়া। যার ফলে ভৌত জগত, ডিজিটাল জগত, আর জীবজগতের মধ্যে পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে বায়বীয়। একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে এসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস্, মেশিন লার্নিং ইন্টারনেট অব থিংস, (আইওটি), নিজে চলা গাড়ী, ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং, ন্যানো টেকনোলজি, জেনেটিং ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, শক্তি সঞ্চয় কিংবা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়োটেকনোলজির সাথে অটোমেশন প্রযুক্তির মিশ্রণে শুরু হয়েছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এ বিপ্লব মোকাবিলায় বাংলাদেশের সামগ্রিক ব্যবস্থা কতটা প্রস্তুত? যে ধরনের জ্ঞান ও দক্ষতাসমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন তা আমাদের আছে কিনা?

উল্লেখ্য, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা একটি তালিকা প্রণয়ন করেছে। গুরুত্ব অনুসারে এ ১০টি দক্ষতা হলো জটিল সমস্যার সমাধান, ত্বড়িৎ চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, সৃজনশীলতা, জনব্যবস্থাপনা, অন্যদের সঙ্গে কাজের সমন্বয়, আবেগজনিত বুদ্ধিমত্তা, বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সেবা প্রদানের মানসিকতা, দরকষাকষি ও চিন্তার স্বচ্ছতা। মোদ্দা কথায়, আগামী দিনে প্রত্যেক পেশাজীবীকে নিজ পেশায় দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সামাজিক সমস্যার সমাধানসহ সার্বজনীন মহলের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক সম্প্রাসারণ, ইন্টারনেটের বিকাশ ও প্রযুক্তিগত দ্রুত পরিবর্তনের কারণে আগামী ১০ বছরে অনেক পেশা হারিয়ে যেতে পারে। সঙ্গে অবশ্য যোগ হবে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র। ইতোমধ্যে ‘পি ডব্লিউসি’ নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করেছেন, স্বয়ংক্রিয়করণ ও রোবটিকসের কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশে^র ৮০ কোটি মানুষ তাদের বর্তমান চাকুরী হারাবে। এ ঝড় মূলত বয়ে যাবে শ্রমনির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠানের উপর; স্বভাবতই আমাদের মতোই শ্রমনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো বেশী বিপদে পড়বে। অন্যদিকে ১০০ কোটি মানুষের জন্য সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। তবে সেগুলো কেমন, তার বেশীরভাগই আমরা এখনো কল্পনা করতে পারছি না। অধ্যাপক ক্লাউস শোয়াইব চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য দু’টো সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমত: প্রযুক্তি শ্রমের জায়গা দখল করে নিলে কর্মীবাহিনী অস্তিত্বের লড়াইয়ে নিজের জ্ঞান ও দক্ষতাকে আরো বিকশিত করে বিকল্প পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করবে। দ্বিতীয়ত: নিত্য নতুন পণ্যও সেবা উদ্ভাবনের ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থান, উৎপাদনশীলতা ও সম্পদ বৃদ্ধি করবে। ফলে একদিকে দক্ষ মানুষের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। শোয়াইব তাঁর ‘ঞযব ঋড়ঁৎঃয ওহফঁংঃৎরধষ জবাড়ষঁঃরড়হ’ শীর্ষক গ্রন্থে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন যে, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আগাম ফসল হিসেবে ২০২৫ মালের মধ্যে বিশে^র প্রায় ২০% মানুষের পরিধেয় বস্ত্র কিংবা বস্ত্রের সাথে ইন্টারনেট সংযুক্ত থাকবে, পাওয়া যাবে মানুষের শরীরে স্থাপনযোগ্য মোবাইল ফোন, ৯০% মানুষ ষ্মার্ট ফোন ব্যবহার করবে, আমেরিকায় ১০% গাড়ী চলবে চালকবিহীন, ৩০% কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের অডিট হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট দিয়ে, এমনকি কোম্পানীর বোর্ডেও একজন পরিচালক হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট” এ ধরনের আরো বহু অবিশ^াস্য উদ্ভাবন পুরো বিশ^কে তাক লাগিয়ে দিবে। প্রযুক্তির এ অভাবনীয় অগ্রগতি,সাফল্য, বিস্তার ও কর্মসংস্থানের উপর এর প্রভাব মানুষে মানুষে, দেশের সাথে দেশের বৈষম্যের মাত্রা অনেকাংশে বৃদ্ধি করবে। কেননা, ইতিমধ্যে শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রযুক্তির উৎকর্ষে উন্নয়নশীল দেশ থেকে অর্থনৈতিকভাবে অনেকখানি এগিয়ে রয়েছে। এমতাবস্থায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলায় আমাদের কালক্ষেপন করার কোন সুযোগ নেই। আগামীতে সৃজনশীল, দ্রুত চিন্তার অধিকারী, ত্বড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম ও সমস্যা সমাধানে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে এ দক্ষতাগুলো শিক্ষার্থীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়। তাই বিশ^ব্যাপী এখন যে কোন স্তরের শিক্ষা হয়ে উঠছে অ্যাকটিভিটি নির্ভর। মুখস্তের পরিবর্তে বিশ্লেষণ, সূত্রের চেয়ে প্রথমে নীতির প্রয়োগ এবং সর্বোপরি শ্রেণিকক্ষে দলীয় উপস্থাপনা ও শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তিকরণ কাজের পরিমাণ অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের ফ্যাসিলিটেটর ভূমিকায় অবর্তীণ হতে হয়। ছোটবেলা থেকে শিক্ষার্থীরা যেন তথ্য উপাত্তের ভিজুয়ালাইজেশনে আগ্রহী হয় সেজন্য বিভিন্ন কৌশলের সহায়তায় পাঠদান কার্যক্রমকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রচলিত শ্রেণিকক্ষভিত্তিক পড়ালেখা ও প্রশ্নোত্তর বের করে এনে কেস স্টাডি, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট তৈরী ও উপস্থাপনার সহায়তায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা বাধ্যতামূলক করতে হবে। উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধিকল্পে শিল্পের সমস্যা নিয়ে গবেষণা, ইন্টার্নশীপ, শিল্প সফর ও শিল্প প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে জোরদারকরণের নিমিত্তে শিল্পের সাথে বিশ^বিদ্যালয়ের সংযোগ বাড়াতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা তাদের ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি শিল্প ও ব্যবসার বাস্তব পরিস্থিতি ও সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকবে। অন্যদিকে বিশ^বিদ্যালয়ের ক্যারিকুলামকে যতটুকু সম্ভব প্রযুক্তিনির্ভর করে ঢেলে সাজাতে হবে। একইসাথে পলিটেশনিক ও ভোকেশনাল শিক্ষা ব্যবস্থার উপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করে আমাদের বিশাল অদক্ষ ও স্বল্প দক্ষ কর্মীবাহিনীর জ্ঞান ও দক্ষতার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। অন্যতায় প্রযুক্তিনির্ভর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল আমরা ঘরে তুলতে পারব না।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং এর প্রভাব নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিল বৈঠক হচ্ছে। সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আইওটি, বিগ ডেটা, ব্লক চেইন এর মতো জনপ্রিয় শব্দগুলো উচ্চারিত হচ্ছে সত্য, কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি ‘ন্যাশনাল আটিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স স্ট্রাটোজি’ নামক একটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তবে এটাও সত্য যে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আইওটি, বিগ ডেটা, ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ এখনো শিশু পর্যায়ে।

আগামীতে এসব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পণ্য সরবরাহ, চিকিৎসা, শিল্পকারখানা, ব্যাংকিং, কৃষি, শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক কাজ করার সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। এমতাবস্থায়, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে সরকারকে একটি সমন্বিত নীতিমালা ও কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ চাহিদাভিত্তিক মানবসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রমের উপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপপূর্বক সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। অন্যতায় ২০৩০ সাল নাগাদ আমরা এমন সব গ্র্যাজুয়েট তৈরী করব, যাঁরা তৎসমাজের কোন চাহিদাই মেটাতে পারবে না।

প্রফেসর ড. মোঃ আবু তাহের শিক্ষক ম্যানেজমেন্ট বিভাগ; সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট