চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

হজব্যবস্থাপনা : প্রসঙ্গ কথা

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

২৫ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:৫৬ পূর্বাহ্ণ

মহান আল্লাহ পাকের দাওয়াতী মেহমান বাংলাদেশের ১ লাখ ২৭ হাজার মত হাজী হজ করে দেশে ফিরে এসেছেন। হাজীর সংখ্যার দিক দিয়ে আমরা বিশ্বে চার নাম্বারে। এক নাম্বার ইন্দোনেশিয়া। যার সংখ্যা ২ লাখ ২১ হাজার। পাকিস্তান ১ লাখ ৮৫ হাজার। ভারত ১ লাখ ৭৯ হাজার। অতঃপর বাংলাদেশ ১ লাখ ২৭ হাজার। এর পরের দেশগুলি লাখের নিচে। তৎমধ্যে মিশর, ইরান, তুরস্ক অন্যতম। আমাদের বাংলাদেশীর হাজীগণের হজ ব্যবস্থাপনা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে। তবে প্রায় মাত্র ৭ হাজার নর-নারী সরকারী নিয়ন্ত্রণে হজ করেন। বাকী বিশাল অংক তথা ১ লাখ ২০ হাজার নর-নারী সরকারী অনুমোদনপ্রাপ্ত বেসরকারী এজেন্সীগুলোর মাধ্যমে হজ করেন।এ প্রসঙ্গে পবিত্র মক্কায় বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা তথা যুগ্ম সচিব মুহাম্মদ মাকসুদুর রহমান বলেন, বেসরকারী এজেন্সীর মাধ্যমে হজযাত্রীগণের সরকারী তথা হজ মিশনের মাধ্যমে মৌলিক দায়িত্ব থাকে না। হজ মিশন সমন্বয় সহযোগিতা করে থাকে। কোন হাজী আপত্তি করলে হজ মিশন প্রধান হিসেবে তিনি বা তার অধীনস্থ কর্মকর্তারা ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। অপরদিকে, প্রায় ৭ হাজার সরকারী ব্যবস্থাপনার হাজী সরাসরি হজ মিশনের নিয়ন্ত্রণে বলা যাবে। আলাপে হজ কর্মী নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি দুঃখ করে বলেন, সৌদিতে অবস্থানরত প্রবাসীদের মধ্য থেকে হজ কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। বারে বারে চেষ্টা চালিয়েও যোগ্য লোক কম পাওয়া যায়। প্রসঙ্গে আলাপে তিনি আরও জানান গত হজে ১১৩ জন হাজী ইন্তেকাল করেন। যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কম। যেমন- ২০১৮ তে ১৪৫ জন, ২০১৭ তে ১৬২ জন, ২০১৬ তে ১৯০ জন, ২০১৫ তে ২৩৮ জন।

আলাপে তিনি আরও বলেন,৭০ টি হজ এজেন্সীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয় যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। প্রায় ১৬ ‘শ’ মত হজ এজেন্সীর তালিকা থাকলেও গত হজে কার্যক্রম ছিল ৫৯৮ টি এজেন্সীর। অর্থাৎ যে সব এজেন্সী ১ শতের কম হজযাত্রী পেয়েছে তাদের হজযাত্রীগণকে অন্য এজেন্সীর মাধ্যমে হজ করতে আসতে হয়েছে। যেহেতু প্রতি এজেন্সী ন্যূনতম ১ ‘শ’ সর্বোচ্চ ৩ ‘শ’ জন হজ করাতে পারবে।

হজ উপলক্ষে তার অফিস ফজরের নামাজের পর থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত সার্বক্ষণিক খোলা থাকে। তিনি আবেগের সাথে বলেন, ১ লাখ ২৭ হাজার হজযাত্রী তার কাছে অতি সম্মানিত। তিনি হজযাত্রীর খেদমত করতে পেরে গর্ববোধ করেন। ওমরা হাজী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সৌদি সরকার এখনও ওমরা হাজীগণকে হজ মিশনের নিয়ন্ত্রণে দেননি। অপরদিকে, ২০১৪ সালের সৌদি সিদ্ধান্ত মতে, হজের পর বিশ্বের সব দেশের হজ মিশনকে জেদ্দায় চলে যেতে হবে। অর্থাৎ হজ মিশনের অফিসগুলো হজ সিজনের পর জেদ্দায় থাকবে। সৌদি সরকারের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়। সৌদির হজ ও ওমরার পৃথক মন্ত্রণালয় রয়েছে। যার দপ্তর জেদ্দা রোডে পবিত্র মক্কায়। মন্ত্রীও ওখানে বসেন। প্রয়োজনে রিয়াদ যাওয়া আসা করে। বর্তমানে হজের পাশাপাশি ওমরার ক্ষেত্রেও সৌদির এবং স্ব-স্ব দেশের নিয়ম নীতি আরোপিত হচ্ছে। এতে পবিত্র মক্কায় স্ব-স্ব দেশের হজ মিশনকে হজ ও ওমরা মিশন বলা যাবে। যেহেতু হজের পাশাপাশি ওমারর ক্ষেত্রেও বিপদ আপদ মৃত্যু ইত্যাদি বিষয়ে হজ মিশনে মুরব্বিয়ানা করার অধিকার থাকা অত্যাবশ্যক।

আমাদের দেশে ১ লাখ ২৭ হাজার হাজী তথায় চিকিৎসা সেবা দেওয়া বিশাল ব্যাপার। আমাদের সরকার এ বিষয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে দিয়েছে । যা যথাযথ,যথোপযুক্ত। আজও আমাদের দেশের সশস্ত্র বাহিনী যথেষ্ট সুনামের অধিকারী। পবিত্র মক্কায় বাংলাদেশ হজ মেডিকেল মিশনের প্রধান বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাকির হাসান আলাপে বলেন, তারা দেশ থেকে পর্যাপ্ত ঔষধ নিয়ে এসেছেন। তবে যে সমস্ত হাজীর দীর্ঘমেয়াদী রোগ রয়েছে যেমন- ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এ জাতীয় রোগীগণকে দেশের ডাক্তারের পরামর্শে পর্যাপ্ত ঔষধ নিয়ে আসা আবশ্যক। তথায় হজ মেডিকেল মিশনে জরুরী চিকিৎসা দেওয়া হবে মাত্র। এতে ঔষধের মধ্যে তারতম্য হতে পারে। প্রায় ৫০ দিনব্যাপী হজ কার্যক্রম। অতএব দেশ থেকে ডাক্তারগণ দুই গ্রুপে আসেন। প্রথম গ্রুপে ১৪২ জন ডাক্তার হজ ফ্লাইট শুরুর আগে এসে হজ্বের পর পর দেশে ফিরে যান। দ্বিতীয় গ্রুপে ২০৭ জন ডাক্তার হজের আগে এসে হজ ফ্লাইট শেষ করে ২/৩ দিন পর দেশে ফিরেন।

পবিত্র মদিনায় একজন কর্ণেল এর নিয়ন্ত্রণে ৩৫ জন ডাক্তার নার্স রয়েছে। জেদ্দায় হজ টার্মিনালে ডাক্তার ও নার্স মিলে রয়েছে ৬ জন। পবিত্র মক্কায় ৩টি, পবিত্র মদিনায় ১টি নিজস্ব এ্যামবুলেন্স রয়েছে হজ মিশনের। ৬ সেপ্টেম্বর অনেকটা হজযাত্রী ফিরে আসার শেষ পর্যায়ের দিনে আলাপে বলেন, সৌদি হাসপাতালে ৪ জন হজযাত্রী রয়েছে যাদের অবস্থা নাজুক। তার দেয়া তথ্য মতে হজযাত্রী ফিরে আসার একদম শেষ পর্যায়ে ৪ সেপ্টেম্বর পবিত্র মক্কা, পবিত্র মদিনা এবং জেদ্দা হজ টার্মিনাল মিলে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯ শত ৫৩ জন কে ঔষধসহ চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, হজের সময় উভয় গ্রুপের ডাক্তার নার্স মিলে এ বিশাল অংকের বাংলাদেশী হজযাত্রীগণকে রাত দিন বিরাম বিশ্রামহীনভাবে চিকিৎসা সেবা দিতে হয়েছিল। ঐ সময় দৈনিক প্রায় ৩-৪ হাজার হজযাত্রী চিকিৎসা সেবা নিতেন।

হজ মিশন ও হজ মেডিকেল মিশন পবিত্র মক্কার মিসফালাহ ব্রিজের পরবর্তী স্থানে অবস্থিত। পবিত্র মসজিদুল হারমের চারপাশে ছোট ছোট উপকেন্দ্র নাই কেন জানতে চাওয়া হলে উভয় প্রধান একই উত্তর দেন যে, বাংলাদেশী হজযাত্রীরা মিসফালায় অবস্থান করে থাকে। জিয়াদ, গজ্জা,সামিয়া ঐ তিন কোণার দিকে বাংলাদেশী হজযাত্রী খুব সংখ্যায় থাকেন বিধায় ঐ তিন দিকে উপকেন্দ্র খোলার গুরুত্ব আসতেছে না। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় বিশ্বে যে কোন শহরে উত্তর দক্ষিণ,পূর্ব-পশ্চিম নির্ণয় করে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু পবিত্র মক্কায় ব্যতিক্রম তথা চার দিকের চার কোণ নিয়ে পরিচিত।

হজ ব্যবস্থাপনায় ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ বিমান তুলনামূলকভাবে ধন্যবাদ পাওয়ার অধিকারী বলা যাবে। তবে বাংলাদেশ বিমানের হজের ফিরতি ফ্লাইটে একটি এয়ারক্রাফ্ট জরুরী মেরামতে নিতে হওয়ায় কয়েক দিন ফ্লাইটের সিডিউল এলোমেলো হয়। গরীব দেশের সীমিত এয়ারক্রাফ্ট। অতএব তা মেনে নিতে হবে। তবে হজযাত্রীর বিমান ভাড়া চড়া। ভাড়া আরও কমানো দরকার। আতিথেয়তা অর্থাৎ খাবারের মান দুর্বল। বিজনেস ক্লাসের জন্য গত হজ থেকে প্রতি জন থেকে ১০০ ডলার করে নেয়া যথাযথ। বিমান ভাল মনে করলে ১০০ ডলারের স্থলে ৫০ ডলার করা যেতে পারে। যেহেতু ১০০ ডলার বেশি দিচ্ছে অতএব আসন গ্রহণ করার সাথে বিজনেস ক্লাসে হজযাত্রীকে হালকা নাস্তা পানি দেয়া আবশ্যক। অধিকারী বলা যাবে।

অপরদিকে সৌদি সরকার হজযাত্রীগণের কল্যাণে আন্তরিক তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু মসজিদুল হারম যথাযথ সম্প্রসারিত না হওয়ায় পবিত্র মক্কায় হজযাত্রীরা কষ্ট পাচ্ছেন,রাস্তায় রৌদ্রে নামাজ পড়তে হচ্ছে। যা গ্রহণযোগ্য নয়। উত্তর পশ্চিম দিকে সামিয়া এরিয়ায় গত ১০/২০ বছর আগে আবদুল্লাহ হেরেমে অন্য ৩ দিকের হাজীরা যেতে চায় না। গরম আবহাওয়া ওয়াক্তের নামাজ পড়তে কত হাঁটা যায় তা সৌদি সরকারের বুঝা উচিত। জুমা হয়ত মেনে নিলাম।কিন্তু ওয়াক্তের নামাজ রাস্তায় রৌদ্রে পড়বে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আবদুল্লাহ হেরেম বাদ দিয়ে বর্তমানে মসজিদুল হারমে ধারণ ক্ষমতা ৮/১০ লাখ জন তথা প্রায় ১ মিলিয়ন মাত্র। মসজিদুল হারমে ৩০/৪০ লাখ জন তথা ৩/৪ মিলিয়ন নামাজীর ধারণ ক্ষমতার জন্য কাজ শুরু খুবই জরুরী মনে করি। সে লক্ষ্যে দার-আল-তাওহীদ ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেল,হিলটন (পবিত্র) মক্কা হোটেল, ক্লক টাওয়ার তথা ৭টি হোটেলের সমন্বয়ে জমজম টাওয়ার ভেঙ্গে ফেলা অত্যাবশ্যক। জিয়াদের দিকে ৫/৭ টি রাজকীয় প্যালেস আরও দূরে সরিয়ে নেয়া খুবই জরুরী। মাত্র ৫/৭ হাজার ধনী হজ ও ওমরাকারী এবং রাজকীয় মেহমানের সম্মানের আয়েশের জন্য মসজিদুল হারমের গায়ের উপর এ তিনটি বিলাসবহুল হোটেল,কয়েকটি প্রাসাদ থাকা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দক্ষিণ ও পশ্চিম তথা জিয়াদ ও মিসফলার দিকে মসজিদুল হারম সম্প্রসারণ করা অতীব জরুরী।
এ ও বি ক্যাটাগরির উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রের ধনী হাজীগণের আয়েশের জন্য মিনায় বড় বড় এরিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখা গ্রহণযোগ্য নয়। হজ কষ্টের এবাদত, আয়েশের নয়।

জেদ্দা হজ টার্মিনালের বহিরাঙ্গন অপরিকল্পিত। বহিরাঙ্গনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ নাই, গরমের দেশ। অনভ্যস্ত হাজার হাজার হজযাত্রীগণকে ৪০/৪৫ ডিগ্রী তাপমাত্রায় ঘন্টার পর ঘন্টা ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। যা অমানবিক।

বর্তমানে ২৪ লাখ নর-নারী হজ করতেছেন। তৎমধ্যে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ ৬ লাখ নর-নারী বাদ দিলে বিদেশী হজযাত্রী ১৮ লাখ দাঁড়ায়। তারপরেও ১৭ লাখ ১ মিলিয়ন ৭০০ হাজার বিদেশী নর-নারী হজ করতেছে। হজ এজেন্সীর মাধ্যমে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ বিভিন্নখাতে এবং প্রতি হজযাত্রী নগদে ২ হাজার মার্কিন ডলার তথা বৈদেশিক মুদ্রা সৌদি সরকার পাচ্ছে। এতে ১৭ লাখ তথা ১ মিলিয়ন ৭০০ হাজার হজযাত্রীর মাধ্যমে প্রতি বছর হজ উপলক্ষে সৌদি সরকার বৈদেশিক মুদ্রা ৩৪০ কোটি ডলার অর্থাৎ ৩ হাজার ৪ শত মিলিয়ন ডলার পাচ্ছে।

তারপরেও হজ এজেন্সীগুলো ঘর ঠিক করতে, মোয়াল্লেম নির্ণয় করতে,বাস ঠিক করতে সৌদি সরকার বিভিন্ন খাতে মোট প্রদেয় টাকার উপর ২৫%-৩৫% ট্যাক্স নিচ্ছে। তার উপর দুই পবিত্র নগরীতে হজযাত্রীগণের জরুরী কেনা কাটা,দুধ,পানি,দধি তথা জরুরী সামগ্রি কিনতে গিয়ে ৫% ট্যাক্স নিচ্ছে। সৌদি আরবেব অন্যান্য অঞ্চলের এবং পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনার আইন এক হতে পারে না। ইহা হজ ও ওমরাকারীদের শহর।

সৌদি সরকার শুধু মাত্র প্রতি বছর হজ উপলক্ষে যেখানে ৩ হাজার ৪ শত বৈদেশিক মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচ্ছে সেখানে সৌদি সরকারের উচিত হবে হজযাত্রীগণের যাবতীয় ট্যাক্স,ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেয়া।
সৌদি সরকার হজ ও ওমরাকারীর কল্যাণে উপরোক্ত সুপারিশ বিবেচনায় আনবে, সাথে সাথে আমাদের ধর্ম মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বিমান আরও সজাগ হবে আশা করি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট