চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

একজন প্রতিভাদীপ্ত কীর্তিমান স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরী (১৯৫৪-২০১৭)

এজাজ ইউসুফী

১৫ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:২৯ পূর্বাহ্ণ

একজন প্রতিভাদীপ্ত সাহসী মানুষের প্রতিভূ ছিলেন আমার প্রিয় সম্পাদক স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরী। পশ্চিমা কবি বেকি’র একটি কবিতার চরণ তুলে ধরতে চাই সাহসী এই মানুষটিকে চিত্রিত করবার জন্য- “ঘবাবৎ মরাব ঁঢ়/ঘবাবৎ মরাব রহ/গড়াব ড়হধিৎফ ধহফ ঁঢ়ধিৎফ রিঃয ংঃৎবহমঃয/ভৎড়স রিঃযরহ/অষধিুং নবষরবাব/অষধিুং ষড়ড়শ ভড়ৎধিৎফ/ঘবাবৎ নব ঃযব ড়হব যিড় রং ংববহ ধং ধ পড়ধিৎফ.” প্রায় দুই দশক ধরে দুরারোগ্য ও ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক ক্যান্সারের বিরুদ্ধে অকুতোভয় এই যোদ্ধাকে ভীত হতে দেখিনি। নিজের ভেতরের প্রাণশক্তিকে নিজেই জাগিয়ে তুলে শুধু সামনের দিকেই এগিয়ে গেছেন। জীবন-যুদ্ধে পরাজিত হননি। মৃত্যু সকলকেই বরণ করতে হয়। তিনিও তাই করেছেন। কিন্তু মরবার আগে মরে যান নি। হেরে যান নি!

বুয়েট থেকে আর্কিটেকচারের উপর ডিগ্রি অর্জন করে কিছুদিন চাকরি করেছেন। পিতার অনুরোধে পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনায় যুক্ত করেন নিজেকে। এখানেও সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছেন। দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক প্রবাদপ্রতীম সাংবাদিক কে জি মোস্তফা পত্রিকা প্রকাশের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকায় চলে গেলে তসলিমউদ্দিন চৌধুরী সম্পাদকের হাল ধরেন। কিছু অভিজ্ঞ ও একদল তরুণ সাংবাদিককে নিয়ে তিনি পূর্বকোণকে চট্টগ্রামের সেরা আঞ্চলিক দৈনিকে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন। কারণ, তিনি বাবার ব্যবসায়িক দূরদর্শিতা আর নিজের শিল্পিত সৃজনশীলতার মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করতে পেরেছিলেন। ফলে, কাঠখোট্ট কোন সম্পাদক না হয়ে তিনি সবার প্রিয় হতে পেরেছিলেন তাঁর শৈল্পিক মনের মাধুর্যে।

পঠন-পাঠনের বিষয়ে তাঁর বাবা ইউসুফ চৌধুরীর মতো অনুসন্ধিৎসু ছিলেন। দুর্লভ সব বই তিনি জোগাড় করে পাঠ করতেন। বিচিত্র বিষয়ে তাঁর আগ্রহ বিশেষ করে আমাকে চমৎকৃত করতো। যখন তিনি খুবই অসুস্থ। হাঁটতে পর্যন্ত কষ্ট হতো। দেহের মধ্যে নানান ধরনের যন্ত্রপাতি বহন করতেন। তখনও বিচিত্র বই সন্ধানের নেশা ছাড়তে পারেন নি। ভরদুপুরে তাঁকে দেখা যেতো বাতিঘরের এককোণায় বসে বই এর পাতা উল্টাচ্ছেন। মৃত্যুর অল্প ক’দিন আগেও তিনি বাতিঘরে গেছেন। একদিন আমাকে তাঁর টেবিলে ডেকে পাঠিয়ে একটি অ্যালবাম দেখতে দেন, বইটি দেখে আমি চমকে যাই। বঙ্গবন্ধুকন্যা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাড়ির ছবি ও তথ্য সম্বলিত ভীষণ আকর্ষণীয় একটি ফটো অ্যালবাম। শেখ হাসিনার বিভিন্ন ধরনের শাড়ি পরা ছবি। শাড়ির মূল্যসহ নানা তথ্য এতে সন্নিবেশিত। চিত্রকলা, গান, রন্ধনশিল্প, চলচ্চিত্র ও ফটোগ্রাফি বিষয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল।
ফটোগ্রাফির প্রতি ভীষণ দুর্বল ছিলেন। তিনি মিতব্যয়ী ব্যক্তি হলেও ক্যামেরা ও সেরা লেন্স ক্রয়ে কার্পণ্য করতেন না। একবার আমি ও আমাদের চিফ রিপোর্টার নওশের আলী খানকে নিয়ে বসন্ধুরা মলে যাচ্ছেন। ভাবলাম বাসার জন্য কেনাকাটা করবেন। গিয়ে দেখলাম তিনি সোজা উঠে গেলেন ক্যামেরা স্টলে। অনেক দামি লেন্স ও ট্রাইপট কিনে নিলেন। আমরা প্রতিবছর পূর্বকোণ পরিবার পিকনিকে গিয়ে থাকি। তিনি সব পিকনিকে গিয়ে আমাদের ছবি তুলে দিতেন। সেবার বান্দরবান গিয়েছিলাম। সেদিন মিলাদুন্নবীর দিন। রাস্তায় জ্যামে আটকে তিনি যখন বান্দরবান পৌঁছালেন বিকেল গড়িয়ে গেছে। গাড়ির মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু ফিরে না গিয়ে- আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কোনোভাবে কিছু ছবি তুলেছিলেন। এরকম সিংহ-হৃদয় পুরুষ আমার জীবনে দেখা হয় নি।

অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই তিনি পত্রিকার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। রন্ধনশিল্প নিয়ে তিনি রীতিমতো গবেষণা শুরু করে দেন। একবার আমি ও সেই সময়ের সহকর্মী আলোকচিত্রী রূপম চক্রবর্তীকে দায়িত্ব দেন চট্টগ্রামের রন্ধনশিল্পীদের সঙ্গে দেখা করে তাদের রেসিপি এবং তাদের পরিচিতি তুলে ধরতে। তাঁর অনুপ্রেরণায় আমরা একটি রন্ধন-বিষয়ক বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিলাম। রন্ধন-বিষয়ক অসংখ্য বই-পত্র-পত্রিকা তাঁর সংগ্রহে ছিল। সে সব স্মৃতি এখন মনে পড়ছে।

প্রখর যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন তিনি। ’৯৭ সালে পূর্বকোণ পত্রিকায় যোগ দেওয়ার সম্ভবত একবছর পর আমি চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নির্বাচিত হই। আমাদের সভাপতি ছিলেন শ্রী অঞ্জন কুমার সেন। ‘বার্তাজীব’র দায়িত্ব পাওয়ার পর আমার সম্পাদনায় যে বার্তাজীবী বের হয় তাতে অঞ্জন সেনের একটি কড়া লেখা ছাপা হয় বিভিন্ন পত্রিকার সমস্যা নিয়ে। বিশেষ করে পূর্বকোণ প্রসঙ্গই ছিল মূল প্রতিপাদ্য। ওটি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কপি তাঁর হাতে চলে যায়। অঞ্জন বাবুর লেখাটি পড়ে তিনি অগ্নিশর্মা। আমাকে ডেকে পাঠলেন রুমে। প্রথমে একচোট নিলেন। আমি চুপ করে থাকি। তিনি জানতে চাইলেন- এরকম একটি লেখা ছাপা হচ্ছে তা আমি আগেভাগে তাঁকে জানালাম না কেন? আমিও রগচটা মানুষ। বললাম, ‘এটি আমাদের কমিটির সিদ্ধান্ত। আপনাকে আগে কেন জানাব!’ তিনি গর্জে ওঠেন- ‘তুমি বার্তাজীবী’র সম্পাদক। আমি তোমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করব।’ আমি উত্তরে বললাম- ‘সেটি আপনার অধিকার। আমার বিরুদ্ধে মামলা করেন।’ এই বলে আমি রুম থেকে বেরিয়ে আসি। মাথা একটু ঠা-া হওয়ার পর ভাবতে থাকি- অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, নানাজনের বিরুদ্ধতার মুখে চাকুরিটি হলো। এবার তা গেল বোধহয়। নাহ্, আমার বিরুদ্ধে মামলা তো দূরে থাক- চাকুরিও গেল না। স্পষ্টভাষী মানুষকে তিনি পছন্দ করতেন। যুক্তি মানতেন। অষ্টম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের সময় আমি সিইউজে’র সভাপতির দায়িত্বে তাঁর সঙ্গে বহুবার ‘হট টক’ হয়েছে। তর্ক করেছি। কিন্তু তিনি কখনো তা ব্যক্তিগতভাবে নেন নি। বাইরে যখনই দেখা হতো হাসিমুখে ঠাট্টা-মসকরা করতেন। যে কথা দিতেন তা অবশ্যই পালন করতেন একটু ধীরে হলেও। কিন্তু একচুলও নড়তেন না। এরকম যুক্তিবাদী ও মানবিক মানুষ আজকের সময়ে দুর্লভ।

অত্যন্ত আধুনিকতা মনস্ক মানুষ ছিলেন। আমি যখন পূর্বকোণ যোগ দিই। আমার ছিল কাঁধ উপচানো লম্বা চুল। পরতাম জিন্স, কেডস্, আর টি-শার্ট। আমার এই পোশাক-আশাক আমাদের চেয়ারম্যানও খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন না। সে সময় পূর্বকোণের প্রায় সব সাংবাদিকই কেতাদুরস্ত পোশাক পরে অফিসে আসতেন। আতাউল হাকিম ভাই ছিলেন সবার রোল মডেল। আমিই ব্যতিক্রম। তখন শ্রদ্ধেয় তসলিমউদ্দিন সম্পূর্ণ সুস্থ। দশাসই শরীর। আমাকে দেখলেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন। আমার পোশাক-আশাকের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিতেন বলে মনে হতো। তাই যখনই দেখা হতো পেটে আলতো ঘুষি মেরে বলতেন- ‘হাই ইয়ংম্যান।’

সব ভালো কিছুর প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। আমরা ভালো কোথাও গিয়ে বক্তৃতা করলে তিনি খুশি হতেন। প্রযুক্তির প্রতি ছিল তার দুর্মর টান। আজকের পূর্বকোণকে সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড্ করবার জন্য তাঁর ভিশন ছিল অকল্পনীয়। তাঁর কঠোর নির্দেশেই সবাইকে রাতারাতি কম্পিউটার-জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছে। জ্ঞানী-ব্যক্তিদের তিনি পছন্দ করতেন- কদর দিতেন। তোষামোদকারীকে তিনি সামনে কিছু বলতেন না। কিন্তু পরে বুঝিয়ে দিতেন ঐ ব্যক্তির চরিত্র কিরকম। ভালো কাজের স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করতেন না। নিজেকে প্রচারের চেয়ে বেশি আড়াল করে রাখতে পছন্দ করতেন। বুদ্ধিজীবী কেউ এলে আমাদের এগিয়ে দিতেন। তিনি বলতেন- সবসময় আপার ক্লাসের লোকের সঙ্গে চলবে। কিন্তু নিজে অতিথি হয়ে গিয়ে পেছনের চেয়ারে চুপিসারে বসে থাকতেন। এরকম বিনয় প্রায়শ দেখা যায় না। যেখানে দেখানেওয়ালার সংখ্যাই আজ বেশি।

অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন। ছককাটা জীবনে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না। ধার্মিক মানুষকে শ্রদ্ধা করতেন কিন্তু নিজে গোঁড়া ধার্মিক হয়ে যান নি কখনো। বকধার্মিকদের তিনি ভীষণ অপছন্দ করতেন। শ্রদ্ধেয় ইউসুফ চৌধুরীর মৃত্যুর পর তিনি তাঁর বাবার প্রিয়ভাজন কয়েকজন পীর-টাইপের মানুষকে এড়িয়ে চলতেন। কোনো ধরনের কুসংস্কারে তিনি বিশ^াসী ছিলেন না। তাঁকে আমি বাস্তুবাদী মানুষ বলবো না- বাস্তববাদী ছিলেন এটাই বলব। উচ্চাভিলাষী না হয়ে পরিশ্রমী ও বলিষ্ঠ মানসিকতা ধারণ করতেন। চরম অসুস্থতা নিয়েই নিয়মিত অফিস করতেন। অন্তত আমার আগে অফিসে ঢুকতেন এবং পরে বের হতেন। মনে হতো সুস্থ মানুষদের তিনি লবডংকা দেখাচ্ছেন। এরকম অসাধারণ এক শৌর্যশালী মানুষ না হলে দু’দুবার ক্যান্সারের সঙ্গে সমানে টক্কর দিতে পারতেন না। মৃত্যুর আগে ধার্মিক ছেলের ইচ্ছে মতো তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করার অছিয়ত করে যান। দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।

এজাজ ইউসুফী ফিচার সম্পাদক, দৈনিক পূর্বকোণ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট