চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

জশনে জুলুসের বৈশ্বিক স্বীকৃতি প্রসঙ্গে

মুহাম্মদ মিজানুর রহমান

১৩ নভেম্বর, ২০১৯ | ৫:২০ পূর্বাহ্ণ

নানা ধর্ম বর্ণের মানুষের আবাসস্থল, পীর-আউলিয়াদের সাধনার পীঠস্থান, প্রকৃতির মোহনীয় রূপ নিয়ে চট্টগ্রাম স্বকীয়তায় সমৃদ্ধ, ঐতিহ্যে মহীয়ান। চট্টগ্রাম থেকেই সূচিত হয়ে অনেক কর্মযজ্ঞ ইতিহাসের সুখপাঠ্যে পরিণত হয়েছে। জশনে জুলুস তন্মধ্যে অন্যতম। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহি আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিবসকে কেন্দ্র করে আনন্দ উদযাপন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে যেমন প্রমাণিত, তেমনি ঐতিহাসিক ভাবেও স্বীকৃত। যুগ-যুগ ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে দিবসটি নানা বর্ণিল আয়োজনে পালিত হয়ে আসছে। প্রিয় নবীর জন্মদিবস তথা মওলুদকে উদযাপনে বাংলাদেশে জশনে জুলুস বা আনন্দ শোভাযাত্রার প্রচলন করেন নবীবংশেরই উজ্জ্বলতম প্রদীপ পাকিস্তানের খায়বার পাখতুন প্রদেশে অবস্থিত আধ্যাত্মিক আঙ্গিনা সিরিকোট দরবার শরীফের তদানীন্তন পীরে মোকাম্মেল মহান সংস্কারক হাফিজ ক্বারী আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.)। ১৯৭৪ সালে জশনে জুলুস সংস্কৃতির গোড়াপত্তন আবহমান কাল ধরে নবীপ্রেমে উজ্জ্বীবিত চট্টলাসহ বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে মিলাদুন্নবী উদযাপনে নতুন প্রেরণা যুক্ত করে। হামদ, না’তসহ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার উপর দরুদ-সালাম গাইতে গাইতে রাজপথে শোভাযাত্রা করা তথা জশনে জুলুসের সংস্কৃতি দ্রুতই প্রসারিত হতে থাকে দেশজুড়ে। দীর্ঘ ৪৩ বছরে এ নির্মল সংস্কৃতির প্রসারতা, পালনে মানুষের অভূতপূর্ব নিষ্ঠা-আন্তরিকতার কারণে যা আজ বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। এ মহান সংস্কৃতির সূচনাস্থল হিসেবেও চট্টগ্রাম আজ দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে সম্মানিত ও পবিত্র নগরী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের এ আবেগ অনুভূতিকে সম্মান জানাতে ও চট্টগ্রামকে আবার বিশ্বদরবারে উঁচু করে ধরতে এ জুলুসের আয়োজক ও চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠকরা মনে করছেন জশনে জুলুসটি জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি যোগ্য। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক বিশেষ সংস্থা ইউনেস্কোর আন্তঃরাষ্ট্রীয় কমিটি তাদের প্রতিবারের সম্মেলনে বিশ্ব নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের (ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ) পৃথক দুটি দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রণয়ন করে। ২০০৮ সাল হতে প্রতি সম্মেলনে এ তালিকায় ভিন্ন কিছু নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংযোজন হয়ে আসছে। ২০১০ সালের হিসেব মতে ‘মানবতার স্বপক্ষে অদম্য’ যে-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহের দীর্ঘ যে-তালিকাটি প্রণয়ন করা হয়ে থাকে, তার ক্ষেত্রে মূলত এমন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলোকে বেছে নেওয়া হয়, যেগুলো ‘অনুশীলন এবং অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে ঐতিহ্যের বৈচিত্র্য প্রদর্শন করে এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে’।
১৯৭৪ সালে হাফেজ কারি সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহ.), যিনি পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনে জন্মগ্রহণ করা একজন সুফিধারার পীর, তাঁর প্রবর্তিত চট্টগ্রামে আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট আয়োজিত ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) জুলুসটিই বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় জশনে জুলুস অনুষ্ঠানগুলোর একটি। এ জুলুসে অন্তত অর্ধ কোটি মানুষের সমাগম হয়। এমন একটি উৎসবের যতটুকু গুণ রয়েছে, তা ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতির জন্য উপরে উল্লিখিত মানদ- সমর্থন করে। শান্তি বা মানবতার স্বপক্ষে এ উৎসব, যেখানে অর্ধকোটি লোক-সমাগমের পরেও এখন পর্যন্ত কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনার অভিযোগ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কাজেই, এ দাবিটা মোটেও অযৌক্তিক নয় যে, প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে চট্টগ্রামে আয়োজিত অর্ধকোটি মানুষের এ মহাসমারোহপূর্ণ শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর স্বীকৃতির দাবিদার। অনেকে হয়তো ভেবে থাকতে পারেন, ইউনেস্কো সাম্প্রদায়িক উৎসবসমূহ স্বীকৃতির জন্য বিবেচনা করে থাকে না। আদতে ধারণাটি ভুল। ভারতে হিন্দুধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা ও কুম্ভমেলার স্বীকৃতি পাওয়াটা এখানে সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। মূলত ইউনেস্কো স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সম্প্রদায় বিবেচনা করে না; দেখে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। এ উৎসবটি ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি পেলে নিঃসন্দেহে চট্টগ্রাম বিশ্বদরবারে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে। সেইসাথে সমগ্র বাংলাদেশও আরেকবার গর্বে বুক উচুঁ করার সুযোগ পাবে। একইভাবে বাঙালি মুসলমানদের জন্য এ অর্জনটি হবে অনন্য। সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে, চট্টগ্রামের এ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিটা হতে পারে একটি মহৎ সর্বজনীন অর্জন। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি এনে দিতে চট্টগ্রামসহ দেশের সচেতন বোদ্ধামহল সরব ও সক্রিয় প্রচেষ্টা চালাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট