চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সমাজ, ন্যায়বিচার এবং অর্থনীতি

প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য

১২ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:০৩ পূর্বাহ্ণ

সমাজের উৎপত্তি সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায়, পৃথিবীতে মানবজাতি সৃষ্টির সাথে সাথে সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। প্রাচীন কাল থেকে মানুষ প্রকৃতিকে ভয় করতো। প্রকৃতির রূঢ় আচরণে মানবজাতি ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার কারণে প্রকৃতির মধ্যে এক অদৃশ্য শক্তি খোঁজ পায়। এ অদৃশ্য শক্তি থেকে বাঁচার জন্য এবং নিজের ও বংশধরদের রক্ষার জন্য মানুষ পরস্পরের সাথে মেলামেশা করে বসবাস করতে শুরু করে।

এরূপ বসবাস থেকে মানবজাতির সমাজব্যবস্থার উৎপত্তি। সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার পিছনে প্রধানতম উদ্দেশ্য হলো একটি নির্দিষ্ট নিয়মের ভিত্তিতে জীবনচক্রকে পরিচালনা করা। কিন্তু নির্দিষ্ট নিয়মের ভিত্তিতে সমাজব্যবস্থা পরিচালনা করতে গিয়ে নিজদের মধ্যে কতগুলো অলিখিত নিয়ম চলে আসে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে এরূপ প্রথা যখন চলে আসে তখন এক মানবগোষ্ঠীর সাথে আর এক মানবগোষ্ঠীর প্রথাগত নিয়মের বিভিন্নতা দেখা দেয়। একই সাথে এক গোষ্ঠীর চলাফেরা, কথাবার্তা, খাদ্যাভাস ও বিভিন্ন বিধি ব্যবস্থা অন্য গোষ্ঠীর সাথে পার্থক্য হয়ে যায়। ফলে প্রতিটি গোষ্ঠীর মধ্যে স্বাতন্ত্রবোধ গড়ে উঠে। এ কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সমাজব্যবস্থা তথা সমাজের নিয়মনীতির পার্থক্য হয়ে যায়। এরূপ নিয়মনীতির পার্থক্য যখন প্রকট হয়ে উঠে তখন এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠী থেকে নিজদের আলাদা মনে করে। ফলে গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এমন কি একাধিক গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। যুদ্ধে পরাজিত গোষ্ঠী কোন কোন সময় ধ্বংস হয়ে যায়। অথবা পরাজিত গোষ্ঠীর লোকজনকে নিজদের অধীনে নিয়ে আসে। গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে একাধিক লোকের মৃত্যু কোন কোন সময় মানুষের মনকে আন্দোলিত করে তোলে। মানুষ চিন্তা করতে শিখে যে, মৃত ব্যক্তিটিও মানুষ। তাঁকে মানুষের মর্যাদা দেয়া উচিত। এখান থেকে শুরু হয় মানবতা। অবশ্য মানবজাতির মধ্যে এরূপ মানবতা বোধের উন্মেষ হতে সময় লেগেছে কয়েক হাজার বছর।

আজকের দুনিয়ায় এ পৃথিবী নামক গ্রহটিতে যে পরিমাণ দেশ তথা জাতি রয়েছে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক সমাজব্যবস্থার সাথে অন্য সমাজব্যবস্থার এতই পার্থক্য রয়েছে যে, কোন কোন সময় এক জাতি বা সমাজ অন্য জাতি বা সমাজকে আপন করে নিতে পারে না। এরও অনেকগুলো কারণ আছে। প্রধানত সমাজব্যবস্থা প্রভাবিত হয় ধর্ম, খাদ্যাভাস, নিয়মনীতি এবং পরিবেশ দ্বারা। থাইল্যান্ড, কোরিয়া (উত্তর ও দক্ষিণ) এসব দেশের খাদ্যতালিকায় ব্যাঙ, কেঁচো, কুকুর, শামুক, সাপ ইত্যাদি রয়েছে। অথচ ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল এসব দেশের লোকদের খাদ্যতালিকায় কখনো এ বস্তুগুলো থাকে না। তাছাড়া ব্যবহৃত পোশাকের মধ্যেও রয়েছে পার্থক্য। যেমন- থাইল্যান্ড, কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশের লোকদের পোশাক বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশের লোকদের মত নয়। যদিও সর্বজনীন পোশাক হিসেবে প্রতিটি দেশের লোকেরা পেন্ট, শার্ট পরিধান করে থাকে। আর আচার-আচরণের দিক থেকে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন জাপানের লোকেরা অন্য কোন ব্যক্তির সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য সম্বোধন করে মাথা নিচু করে। আর বাংলাদেশ, ভারত ইত্যাদি দেশের লোকেরা পরিচিত হওয়ার জন্য সম্বোধন করে হাত তোলে। এ সব কারণে সমাজব্যবস্থাও ভিন্ন হয়। আর ধর্মীয় আচার-আচরণ, রীতি-নীতির মধ্যে ভিন্নতা তো রয়েছে। অতএব এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, আদিম কাল থেকে সমাজের ক্রমবিকাশ হলেও স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বিভিন্ন অবস্থার কারণে সমাজব্যবস্থা ভিন্ন হয়।

পৃথিবীর সকল সমাজব্যবস্থার মধ্যে (আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে বসবাসরত মানব জাতি ছাড়া) কিছু না কিছু শিক্ষার আলো প্রবেশ করেছে। শিক্ষা মানুষের অন্তরনেত্রকে খুলে দেয়। জাতীয়তাবোধের কারণে সমাজ ব্যবস্থার নিয়মনীতি ভিন্ন হলেও মানুষের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে মানবতাবোধ। আর এ মানবতাবোধ থেকে সৃষ্টি হয়েছে ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচার কি? রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত আইন পর্যালোচনা করার ভেতর দিয়ে একজন লোককে (দুর্বল লোকও হতে পারে) সংবিধানিক অধিকার লাভ করার সুযোগ করে দেয়াটাই হলো ন্যায়বিচার। এ ন্যায়বিচার দুইভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সমাজব্যবস্থায় নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরা নিরপেক্ষভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে একজন অধিকারবঞ্চিত ব্যক্তিকে তাঁর অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এরূপ ন্যায়বিচার দেখা যায়।

বিশেষ করে সৎ এবং পরিচ্ছন্ন সমাজে এরূপ ন্যায়বিচার দেখা যায়। কিন্তু সমাজব্যবস্থা যখন অপরিচ্ছন্ন হয়ে যায়, সমাজের গণতান্ত্রিক কাঠামো যখন দুর্বল হয়ে যায়, একশ্রেণির ব্যক্তিরা যখন একচ্ছত্র ক্ষমতা লাভ করে, রাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থা যখন অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায় তখন ন্যায়বিচার প্রাপ্তি জনগণের পক্ষে সম্ভব নয়। এ অবস্থায় ন্যায়বিচার সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে বিচার বিভাগের ওপর। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, যে দেশের জনগণ খুবই দরিদ্র, যাদের নূন আনতে পান্তা ফুরায়, তাদের ক্ষেত্রে বিচারবিভাগের নিকট ন্যায়বিচার চাওয়াটা কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ বিচারবিভাগের নিকট ন্যায়বিচার চাইতে গেলে উক্ত ব্যক্তিকে বেশ কিছু টাকা খরচ করতে হয়। কিন্তু এত টাকা খরচ করার মত সামর্থ্য এই দরিদ্র জনসাধারণের নেই। অতএব এ দরিদ্র ব্যক্তিরা নীরবে অন্যায়কে সহ্য করে আর ন্যায়বিচার হারানোর বেদনায় কাতর থাকে। তাঁদের নিশ্চুপ গভীর হৃদয়ের কান্না হয়তো রাষ্ট্রের উচ্চমহলের কানে পর্যন্ত পৌঁছেনা। কাজেই তাদের নিশ্চুপ কান্নার মধ্যে থাকে এক দীর্ঘশ^াস। যেখানে থাকে হৃদয়ের গভীর ক্রন্দন। এ দুঃখ নিয়ে তারা সমাজব্যবস্থায় বেঁচে থাকে। এজন্য বলা হয়ে থাকে, যে সমাজে ন্যায়বিচার নেই সে সমাজে দুঃখ কখনো যাবে না।

ন্যায়বিচারবিহীন অর্থনীতি কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না। ন্যায়বিচারবিহীন সমাজব্যবস্থায় অর্থনীতিতে যে ক্রমপ্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়, এ ক্রমপ্রবৃদ্ধি খেয়ে ফেলে এই ন্যায়বিচার হরণকারীরা। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৩৭ লাখ (মার্চ’১৯ এর হিসাব অনুসারে)। এ দেশে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৮.১৩ শতাংশ। মাথাপিছু জাতীয় আয়ের পরিমাণ হয় ১৯০৯ মার্কিন ডলার বা ১ ডলার = ৮০ টাকা হিসেবে ১ লক্ষ ৫২ হাজার ৭২০ টাকা যা অবিশ^াস্য (অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯)। আর মাথাপিছু জিডিপি হয় ১৮২৭ মার্কিন ডলার বা ১ ডলার= ৮০ টাকা হিসেবে ১ লক্ষ ৪৬ হাজার ১৬০ টাকা (অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯)। যে দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ লক্ষ ৫২ হাজার টাকার ওপরে সে দেশে এখনো ২০ শতাংশ লোক দরিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে, তা কখনো হতে পারে না। অথচ বিশ^ব্যাংকের হিসেব অনুসারে বাংলাদেশের মোট জনগণের মধ্যে এখনো ২০ শতাংশ লোক দরিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। তা যদি সত্য হয়, তবে কেন? তথ্য কি সঠিক নয়। না। প্রতিটি তথ্যই সঠিক। এর প্রধান কারণ হচ্ছে যে, মাথাপিছু আয়ের সমবন্টন হচ্ছে না। এ দেশের ‘স¤্রাটরা’ অধিকাংশ লোকের মাথাপিছু আয়কে খেয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়। এ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের আয়কে তারা বিদেশেও পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেকেন্ড হোম তৈরি করছে বিদেশে। ফলে অর্থনীতির অগ্রগতি তেমন চোখে পড়ছে না। যেদিন সমাজব্যবস্থায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করা যাবে সেইদিন অর্থনীতির অগ্রগতি আরো দ্রুত হবে। থাকবে না এ দেশে অতি দারিদ্র।

প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য পরীক্ষানিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট