চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সুফি সাধক হজরত শাহজাহান শাহ (র.)

লিয়াকত আলী

৮ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:১৯ পূর্বাহ্ণ

সুফীবাদ এমন একটি দর্শন যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে আত্মার স্বাধীনতা, আধ্যাত্মিক সাধনার উন্নতি এবং মানবজীবনের সমস্টিকতা যা সমসাময়িক বিশ্বজাগতিক প্রেক্ষাপট মোকাবেলা করার জন্য নিজের মধ্যে এক বাধ্য-বাধকতা জাগিয়ে তোলে। সুফী সাধক হজরত শাহজাহান শাহ (র.) জেগে উঠেছিলেন সেই বাধ্যবাধকতায়। মানবসমাজকে ধাবিত করেছিলেন একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে। যেটি মানবতার একটি চূড়ান্ত লক্ষ্য। যেখানে মানুষ লাভ করবে একটি স্বর্গীয় পবিত্র জীবন। তিনি এমন এক আদর্শে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন যা এই বিশ্ব ভ্রহ্মান্ডের যিনি সৃষ্টিকর্তা তাঁর চাহিদা অনুসারে একটি বিশ্বজনীন মানবসমাজ গড়ার পথে সত্য, শৃংখলা, শান্তি এবং মানবকর্মের নৈতিক বিচক্ষণতায় একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্টা করে। আর সেই আদর্শই হল সুফিবাদ।

সুফী সাধক হজরত শাহজাহান শাহ (র.) উনার জীবদ্ধশায় এমনি একটি জীবন-দর্শন চর্চায় নিজেকে সর্বক্ষণ লিপ্ত রেখেছেন। যাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার আলোতে আলোকিত সুফীসমাজ দীর্ঘ ৫১৩বছর ধরে বিশ্বশৃংখলা প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য ভূমকিা রেখে চলেছে। তাঁর লক্ষ-কোটি ভক্ত বা অনুসারী সর্বক্ষণ নিজেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত রেখে মহান সৃষ্টিকর্তার সার্নিধ্য লাভে মগ্ন রয়েছেন। যাঁদের ধ্যান এবং সাধনা সকল প্রকার অনৈতিক কর্মকা- থেকে মানুষকে দূরে রেখে একটি সুশৃংখল শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্টায় সহায়তা করে যা সভ্যতাকে একটি সুনির্দিষ্ঠ গন্তব্যের দিকে নিয়ে চলে। পথভ্রষ্ট হওয়া বা লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে না। এই পথ স্বর্গীয় ও পবিত্র। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের সকলকে সেই পথের দিকে পরিচালিত করুক।

আজকের এই অস্থির বিশ্ব পরিস্থিতি মোকাবেলায় একজন সুফির ভূমিকা হতে পারে শান্তির পথে একমাত্র চাবিকাঠি। সুফীবাদ ভ্রাতৃত্ব, ভগ্নীত্ব, ধৈর্য্য এবং সম্পূর্ণতার লক্ষ্যে  কাজ করে রোগগ্রস্ত সমাজের সামাজিক চিকিৎসা করে এবং প্রতিশোধ প্রবণতাকে এড়িয়ে চলে। সুফী-বিশ্বাস ন্যায়বিচারের প্রতীক, যেখানে সকল প্রকার অবিচার বা অন্যায়ের দরজা সবসময় আগে থেকেই বন্ধ থাকে। সুফীদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে এই বিশ্বকে পরিবর্তন করে একটি উত্তম রোগমুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখা। সুফী সাধক হজরত শাহজাহান শাহ (র.) সেই রকম একটি বিশ্ব গড়ার অগ্রদূত হিসাবে কাজ করে গিয়েছিলেন।

ঐতিহাসিকভাবে সকল ধর্মই আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধিকে গুরুত্ব দিয়েছে। অধিকাংশ ধর্ম এবং ধর্মীয় পন্ডিতদের মতে – আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি বা আত্মার উন্নতি ব্যতিত নিজের মধ্যে খোদার অস্তিত্বকে অনুভব করা সম্ভব নয়। পরিশুদ্ধি প্রক্রিয়া শুরু হয় মানুষের ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ করে খোদার সমস্ত সৃষ্টির নির্যাশ গ্রহণের মাধ্যমে। প্রত্যেক ধর্মেই ইচ্ছাশক্তির এবং নিজের ভিতরকার শক্তিকে জোরালো করে কিভাবে মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টিলাভ করা যায় সে বিষয়ে ধারনা দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্যই হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টিলাভ করা। এ বিষয়ে ধারনা দেয়া হয়েছে প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে, হিন্দুধর্মে, অন্যান্য পাশ্চাত্য ধর্মগুলোতে, বাইবেলের ওল্ডটেস্টাম্যান্ট এবং পবিত্র কোরানে। এটি মানুষের জন্য একটি সাধারণ আহ্বান। সকল গোত্র, বর্ণ, শ্রেণি, জাতি, গোষ্টির সহমর্মিতার জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

একজন ধার্মীক ব্যক্তির ঐতিহাসিক গুরুত্ব দাবী করে শৃংখলা, সততা এবং পরিশুদ্ধতা। যিনি নিজের এবং সমাজের সকল চাহিদা পূরণ করেন। আবুল হাসান নদবী তাঁর “জবষরমরড়হ ধহফ ঈরারষরংধঃরড়হ” বইয়ে আধ্যাত্মিকতার ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, ‘প্রত্যেক ধর্মীয় দর্শন এই বিষয়টাকে অধিক গুরত্বের সাথে বিবেচনা করেছে যা মানুষের আকাক্সক্ষাকে সুসংগঠিত, যথাযথ গ্রহণযোগ্য এবং আইনসম্মত হতে সহায়তা করে। ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার মধ্যে থেকে যে ব্যক্তি জীবনের সকল আকাক্সক্ষা বা চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ বা অক্ষম, এমন ব্যক্তি সুফিবাদে কখনও কাম্য নয়।”… নিজের ইচ্ছাশক্তিকে সংযত বা নিয়ন্ত্রিত রেখে পার্থিব জগতের সকল প্রকার পেশায় নিয়োজিত থেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় লিপ্ত হওয়া যায়। যে কেউ বিবাহিত হতে পারে, তাদের সন্তান থাকতে পারে, তারা কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে পারেন, তাদের চাকুরী থাকতে পারে, অথবা তাদের এই  জগত সংসারের নানাবিধ কাজ থাকতে পারে, আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্যে থেকে তারা সবাই তাদের নিজ নিজ কাজ করতে পারেন।

সকল ধর্মে মানুষের তৃষœা/আকাক্সক্ষা মনের কুচিন্তা বা দূষণের উৎসের কথা বর্ননা করা হয়েছে এবং সেসব থেকে পরিত্রাণ লাভের উপায়ও বলা হয়েছে। এ বিষয়ে বিষদ ব্যখ্যা সকল ধর্মে রয়েছে। ইসলামী যুগের পূর্বে মহানবী মোহাম্মদ (স.) প্রত্যেক মানুষকে ধর্মীয় উপদেশের মাধ্যমে পরিচালিত করতেন এবং তাদের কাজ কর্মে রহমত দান করার জন্য মহান আল্লাহর নিকট শুপারিশ করতেন। এই বিশ্বে বস্তুগত এবং সংস্কৃতিগত বিভাজনের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তথা বিকশিত হতে থাকা পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে এবং জীবনে চলার পথ সুগম করতে সকল প্রকার আধ্যাত্মিক সাধনার উৎসগুলোকে এবং বিশ্বময় ইসলামী প্রজ্ঞাকে কাজে লাগানো অত্যন্ত জরুরী।

আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন থাকা সুফিবাদ ইসলামী-বিশ্ব এবং সাম্প্রতিক কালের সমস্ত বিশ্বশৃঙ্খলার মাঝে সতেজতা ফিরিয়ে আনার ডাক দিচ্ছে। সুফিবাদ ইসলামের একটি সুপ্ত আকৃতির নাম, যার আকার বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। এটি ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু। এর সৌরভ হচ্ছে আত্মশুদ্ধি, নিজ চিত্তকে আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরী করা যা বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন ও মহান সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি নিজের মধ্যে অনুভব করতে এবং বুঝতে শেখায়। আর এটা তাঁরাই শুনতে বা বুঝতে পারে যাঁরা সেই স্তরে নিজেকে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছেন। সুফি শিক্ষার মূল কেন্দ্রবিন্দুই হচ্ছে মহান সৃসিষ্টকর্তার সবকিছুতে বা সর্বত্র বিরাজমান এ বিশ্বাসকে মনে ধারন করা। এটা বুঝতে পারার জন্যই একজন সুফি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একজন সম্মানিত ও পবিত্র ব্যক্তি বলিয়া সমাজে পরিগণিত হন। সুফিরা বিশ্বাস করেন যে, একমাত্র আল্লাহর সাথে এক অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগই পারে নিজেকে এক স্বর্গীয় জীবনের দিকে ধাবিত করতে এবং আলোকিত করতে।

অতি প্রাকৃত উপায়ে লব্ধজ্ঞান এবং পরিশুদ্ধির মৌলিক ধারনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, মানবতার সকল সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান একমাত্র ধর্মই দিতে পারে। মনের বা আত্মার যে বুদ্ধিমত্তা তার সারসংক্ষেপই হচ্ছে মানুষের উপলব্ধি, যা আধ্যাত্মিক সত্তার পরিশুদ্ধির অনুরুপ।

সকল প্রকার ধর্মীয় কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ বা আধ্যাত্মিক অনুশীলনের পূর্বে আমাদের অবশ্যই দিকনির্দেশনা অনুসারে নিজেকে পরিশিলীত এবং পরিচ্ছন্ন করে নেয়া দরকার। পরিচ্ছন্নতার অনুশীলন-শৃংখলা যা মানব শরীরকে পূত পবিত্র রাখে এবং চিত্তে এক স্বর্গীয় অনুভূতির জন্ম দেয় যার ভীত মনের অতি গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত, সেটি মানবচিন্তার যৌক্তিকতার চেয়েও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রকার আধ্যাত্মিক মতবাদে ধ্যান এবং বিশুদ্ধতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এটাই আত্ম-উপলব্ধির সবচেয়ে দ্রুত এবং নিশ্চিত পন্থা। এই রকম এক আত্ম-উপলব্ধির সাধনায় হজরত শাহজাহান শাহ (র.) নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।

পরিশুদ্ধি চর্চার প্রতীকি রুপ একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হয়ে থাকে। বিশেষ করে যেখানে প্রায় সব ধর্মেই অন্তর আত্মার পরিশুদ্ধির বা পরিচ্ছন্নতার বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ব্যাখ্যা করেছে। সৃষ্টির উদ্দ্যেশ্য কি? কিভাবে নিজ সত্ত্বার সাথে যুদ্ধ  করে পরিশুদ্ধ জীবন লাভ করা যায়? এই সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাঁরা সাধনায় ডুবে ছিলেন তারাই সুফি। মানবতার প্রতি ভালবাসা সকল ধর্মের উর্দ্ধে, এই সকল মতের উপর বিশেষভাবে জোড় দেয় সুফি দর্শন।

আধ্যাত্মিকতার মাঝে এমন এক গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে যা আমাদের এই জীবনকে পরিবর্তন করে একটি সত্যিকারের জীবন গড়ার শিক্ষা দেয়। তাই আধ্যাত্মিক জগতে তিনিই একমাত্র কাক্সিক্ষত ব্যক্তিত্ব হতে পারেন যিনি ধর্মীয় চেতনা নিজের মধ্যে ধারন করে ধর্মীয় বাণী প্রচার করে সংস্কারের মাধ্যমে সমাজে আমূল পরিবর্তন আনেন। অতঃপর এটা ধরে নেয়া যায় যে, ভালবাসা, সৎচরিত্র, আত্মার পরিশুদ্ধি একই টিকেটে সংগৃহীত এমন সব গুণাগুণ সম্ভলিত জীবন যা সকল অপকর্মকে দূর করে সমাজে সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা ফিরিয়ে আনে। সুফি সাধক হজরত শাহজাহান শাহ (র.) এমনি একটি জীবন লাভের জন্য সচেষ্ট ছিলেন এবং তিনি সফল হয়েছেন। আজ আমরা তাঁর জীবন ও কর্ম অনুসরণ করে স্বর্গীয় জীবন লাভ করে বিশ্বজগতে শান্তি এবং শৃঙ্খলা প্রতিষ্টা করতে পারি।

লিয়াকত আলী : গবেষক ও হজরত শাহজাহান শাহ’র (র.) মাজার ভবনের ডিজাইনার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট