চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

শারদ উৎসব আনন্দ জাগায় হৃদমন্দিরে

তাপস কুমার নন্দী

৭ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:৪৪ পূর্বাহ্ণ

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এইবছর মহামায়া জগতজননী শ্রীদুর্গার আগমন ঘটেছে ঘোটকে। মা ফিরে যাবেন কৈলাশধামে একই বাহন ঘোটকে চড়ে। ৫দিন ব্যাপি দুর্গোৎসবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দশভুজার রাতুল চরণে তাঁদের মনবাসনা পূরণের আকুল প্রার্থনা জানান। সকলে চান মহামায়ার কাছে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু।

শরতের আকাশে এখন মেঘ থেমে থেমে বৃষ্টিও। শহর গ্রামে মন-প্রাণ মাতানো কাশফুল, শিউলি ফুলের অভিরাম মাখামাখি। এসব দৃশ্য দেখে সবাই আনন্দিত ও আত্মহারা হন। প্রকৃতির রূপ সৌন্দর্যের মধ্যে সকলখানেই চলছে এখন মাতৃদেবী বন্দনা। বছরঘুরে উমা দশভুজা এলেন তার বাপের বাড়ি। ঢাক ঢোল, কাসি, করতাল, ঘণ্টা কাসার মাতাল ছন্দ, মঙ্গল শাঁখ ও উলুধ্বনিতে মুখরিত জনপদ। দুর্গোৎসব মানেই বাঙালির প্রাণের উৎসব।

দুর্গাপূজা বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। ধর্মীয় পরিচয় থাকলেও দুর্গাপূজায় বাঙালিরা মিলিত হয় অভিন্ন মোহনায় সামাজিকীকরণ ও ইহজাগতিকতা বোধের এক অনন্য অনুষ্ঠান দুর্গাপূজা। ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র শরৎকালে অকালবোধ করে দেবী দুর্গার কৃপা লাভে সক্ষম হয়ে রাবণকে বধ করেছিলেন। মন্দিরে দুর্গার পারিবারিক মিলনচিত্রটা আসলে বাঙালির মিলিত জীবনেরই ছবি।  বসন্তকালের পরিবর্তে বাঙালি দুর্গাপূজা পালন করে শরৎকালে। মূলে, সেই প্রতœসময়ে এটি কৃষি উৎসব ছিল বলেই শরৎকালে বাঙালি আয়োজন করে এই উৎসবের। একসময়ের শস্যদেবী দুর্গাই আর্যপুরাণে পরিণত হন রণরঙ্গিনী দেবীতে।

বাংলার লোকবিশ্বাসে দেবী দুর্গা কেবল গৃহস্থ ঘরের বউ নন, তিনি দেশজননী। পরাশক্তির আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করাই দুর্গা কল্পনার কেন্দ্রীয় ভাব-এমন কথা ভেবেছেন অনেক  দার্শনিক চিন্তাবিদ। প্রসঙ্গত, স্মরণ করা যায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিমত। ‘আমার দুর্গোৎসব’ শীর্ষক এক রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র বিষদভাবে লিখেছিলেন, মূলত : মাকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বানের মধ্যদিয়ে বাঙালি যেন সবাইকেই আহ্বান করে অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য।

বিভিন্ন শাস্ত্রে দুর্গাদেবীর আদ্যাশক্তি মহামায়া, চন্ডী, উমা, ভগবতী, পার্বতী প্রভৃতি নামে পূজিতা। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কালিপুরাণ, দেবীপুরাণ, দেবী ভগবত প্রভৃতি গ্রন্থে দেবী দুর্গার কাহিনী, কাঠামো ও লীলার বর্ণনা পাওয়া যায়। আবার সেখানে কিছু কিছু পার্থক্য দেখা যায়। শরতের শারদীয় দুর্গোৎসব মূলত মার্ক-েয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রী শ্রী চ-ীগ্রন্থ অনুসারে হয়ে থাকে।

ঋগে¦বেদে বিশ^দুর্গা, সিন্ধুদুর্গা, অগ্নি দুর্গা এই তিনটি নাম পাওয়া যায়। দুর্গাপূজা কেবল শাক্ত সমাজেই নয়, প্রাচীন বৈষ্ণব সমাজেও অনুষ্ঠিত হয়েছে। মহাপ্রভু  চৈতন্যদেব চ-ীমন্ডপেই চতুষ্পটি চালু করেন। প্রাচীণ বৈষ্ণব কবি চ-ীদাস, বৈষ্ণবাচার্য নিত্যান্দজীও দুর্গাদেবীর ভক্ত ছিলেন। মার্কন্ডেয় পুরাণ মতে সত্য যুগের রাজা সুরথ, সমাধি বৈশ্য দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি গড়ে পূজা আরম্ভ করেছিলেন। কৃত্তিবাস রামায়ণ থেকে জানা যায়, ত্রেতা যুগে লঙ্কার রাজা রাবণ দেবীপূজার আয়োজন করে দেবীর আশীর্বাদধন্য হয়েছিলেন। অন্যদিকে রাবণ বধ এবং জানকীকে উদ্ধার করার জন্য শ্রী রামচন্দ্র বসন্তকালের পূর্বে শরৎকালে দেবীপূজা করেছিলেন। উল্লেখ্য, শ্রী রামচন্দ্র দেবী ভগবতীকে অকালে বোধন করেছিলেন। শরতের সঙ্গে সঙ্গে হেমন্ত কাত্যায়নী দুর্গা, বসন্তে বাসন্তী পূজারও প্রচলন আছে। বাল্লীকি রামায়ণে দেখা যায়, রামের জয়লাভের জন্য স্বয়ং ব্রহ্মা দুর্গার স্তব করেছিলেন। মহাভারতে পাওয়া যায়, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের  আদর্শে অর্জুন দুর্গার স্তব করেছিলেন। দেবী দুর্গা দেবতাদের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। বাংলাদেশে প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন হয় মোগলসম্রাট আকবরের রাজত্বকালে, ষোড়শ শতাব্দীতে।

দেবী দুর্গার প্রতিমাকে ঘিরেই ভক্তদের যতো উৎসব-আনন্দ। মোগল আমল অর্থাৎ ১৬০৬ সাল থেকে বাঙালির শারদোৎসবে বেশ বদল ঘটেছে দেবীমুখশ্রীতে। আজকাল স্যাটেলাইট চ্যানেল ও ইন্টারনেটও প্রভাব ফেলেছে এই প্রতিমার অলংকরণ, মেকআপ ও আউটফিটে। স্থান, কাল ও পাত্রভেদে দেবী দুর্গাকে আমরা বিভিন্ন গড়নে দেখতে পাই। মৃন্ময়ী দুর্গামূর্তি তৈরী করা হয় খড় মাটি দিয়ে। সবচেয়ে সুন্দর, গ্রহণযোগ্য, কর্মক্ষম ও ক্ষমতাধর ব্যক্তির ইমেজকে ভিত্তি করে দেবী দুর্গাকে গড়া হয়। অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পুরোহিত ও জমিদারদের ইচ্ছেমতো আগেকার দিনে প্রতিমা তৈরী হতো। কিন্তু হাল আমলে দেবী দুর্গাকে দেখা যায়, বিখ্যাত কোন নায়িকা, গায়িকা রাজনৈতিকবিদসহ নামকরা সেলিব্রিটিদের আদলে।

দেবী দুর্গাকেও রূপসীর সাজে সাজতে চান মৃৎশিল্পীরা। যেন দেবী দুর্গার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ভক্তরা তাঁকে প্রাণভরে পূজো করেন।

ভাবতে অবাক লাগে ওয়েট ও কার্লি হেয়ারস্টাইলের দুর্গাকে দেখা গেছে হাজার হাজার বছর আগেও। এখনো তেমনটি দেখা যায়। বলতে দ্বিধা নেই দেবী দুর্গার বিউটি স্টেটমেন্ট এখনো অনুকরণীয়।

জমিদারদের আমলে দেবী দুর্গার প্রসাধন হিসেবে ব্যবহৃত হতো আসল গয়না। সেই সব দিন ফুরিয়ে গেছে অনেক আগে। শ্রদ্ধা, ভক্তি সবই অটুট আছে, কিন্তু নিরাপত্তার কথা ভেবে বদলে গেছে দেবী দুর্গার সাজসজ্জার ধরন। আসল গয়নার জায়গায় স্থান পেয়েছে কারুকাজ করা শোলার গয়না। দেবী দুর্গা অনুকরণীয়, পূজনীয় ও ঈর্ষনীয়। দেবীই আমাদের সব ইচ্ছাপূরণে সক্ষম।

দুর্গাদেবীর সঙ্গে আমাদের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। বাংলার বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকৃতির সঙ্গে সহজেই মিলিয়ে দেয়া যায় দেবীর স্বভাবসত্তাকে। প্রতি বছর এই সময়ে তিনি আসেন বাপের বাড়িতে, সঙ্গে থাকা চার সন্তান লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। দেবীর ¯œান, প্রতিষ্ঠা ও পূজা হয় নবপত্রিকায়। তারপর সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত ঢাকের শব্দ, শঙ্খ, নিনাদ আর উলুর ধ্বনির সঙ্গে চলতে থাকে মায়ের ভোগের আয়োজন। অষ্টমীতে চলে কুমারী পূজা। সবশেষে দশমীর দিন ভক্তকুলকে শূন্যতা ও দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে বিদায় নেন দেবী। দেবী যথারীতি স্বর্গে চলে যান আর ভক্তদের জন্য রেখে যান আর্শীবাদ।

বৈদিক সাহিত্যে মহাশক্তিরূপিনী দেবী, পুরাণশাস্ত্রে দেবী দুর্গা বাঙালিভক্ত, কবিদের কাছে বাঙালি গৃহবধু, গৃহকন্যা, গৃহদেবী রূপে পূজিত। দুর্গা সাহিত্যের প্রেরণা। কৃত্তিবাস, মধুসুদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল-‘এদের সাহিত্যে দেবী দুর্গা জায়গা করে নিয়েছেন, হয়েছেন সৃষ্টির উৎস। দেবীর রূপ, গুণ ও শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে  বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন-‘বাহুতে তুমি মা শক্তি/হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি। অন্যদিকে দুর্গার কাছে শক্তি, সাহস, বিদ্যা, ধৈর্য ও  সৌন্দর্যবোধ ইত্যাদি চেয়ে নজরুল লিখেছেন অনেক গান ও কবিতা। এভাবেই দেবী দুর্গা আমাদের কাছে প্রেরণা ও শক্তির উৎস হয়ে আছেন।

দুর্গা পূজাতে ঐক্যের কথা, মিলনের কথা, সৌন্দর্যের কথা, সকল প্রাণী ও  উদ্ভিদের মঙ্গলের কথা নিহিত আছে। এই পূজা মানুষের মনকে পবিত্র করে। আসুরিকতা, অপবিত্রতা ত্যাগ করে সমাজের মানুষের মধ্যে মিলনই হচ্ছে দুর্গা পূজার অন্যতম লক্ষ্য। পূজার প-িত তন্ত্রধারা, পূজার ব্রাহ্মণ, শুদ্ধাচারী কর্মনিপুণ কর্মকার, মঙ্গলারতির জন্য সুজন বাদ্যকর। পূজার উদ্ভিদ, বৃক্ষ, শষ্য, রতœ, ঔষধী, মৃত্তিকা, জলরাশি ইত্যাদির সংরক্ষণ ও সংগ্রহে কর্মকার আত্মনিবেদিত হবার মহাকাজে সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়।

পূজায় প্রয়োজন হয় আ¤্রপল্লব, পাকুড় পল্লব, বট পল্লব, অশ্বত্থ পল্লব, যজ্ঞডুমুর পল্লব। কোন কোন ক্ষেত্রে তান্ত্রিক মতে পূজায় কাঁঠাল পল্লব, আ¤্রপল্লব, বট পল্লব, অশ্বত্থ পল্লব, বকুল পল্লব। পূজার মহা¯œানের জলে পাঁচ প্রকার গাছের কষ বা রসের প্রয়োজন হয়। সেগুলো হচ্ছে-জাম গাছের কষ, শিমুল গাছের কষ, বেড়েলা গাছের কষ, কুল গাছের কষ, বকুল গাছের কষ।

দুর্গাপূজা বাঙালি সনাতনী ধর্মীয় কৃত্য হলেও দুর্গোৎসবের সার্বজনীন ও বৈপ্লবিক তাৎপর্য অনেক।  এজন্য সার্বজনীন দুর্গোৎসব বাঙালির  বৈপ্লবিক ভাবনারও ধারক  হয়ে ওঠেছে। তাই আসুন, দুর্গোৎসবের এ শুভ দিনে আমাদের প্রার্থনা হোক, আমরা সমাজ জীবন থেকে হিংসা, বিদ্বেষ, সংকীর্ণতা ধুয়ে-মুছে ফেলি। আসুরিক শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে মনুষ্যত্বের বেদিমূলে দেশ ও জাতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করি। আদ্যাশক্তি মহামায়ার মহামন্ত্রের উজ্জীবিত হই। দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গা আমাদের সহায় হোক। শারদ উৎসব সকল বাঙালির প্রাণে অসাম্প্রদায়িক মহামিলনের আনন্দ অনুভূতি বহমান রাখবে অনন্তকাল এই প্রত্যাশা করি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট