চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট : সর্বত্র সবার জন্য

ডা. শেখ শফিউল আজম

৭ মে, ২০১৯ | ১:১২ পূর্বাহ্ণ

জ্ঞানী-গুণীজনেরা বলেছেন, ‘মানুষ মানুষের জন্য-জীবন জীবনের জন্য’ এবং সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষ যা করতে পারে পৃথিবীর অন্য কোন প্রাণীর পক্ষে তা করা সম্ভবপর নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক জ্ঞানীগুণী সমাজসেবক মহৎপ্রাণ মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন।
১৮২৮ সালের ৮ই মে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের রুভার দেইনিতে জীন হেনরী ডুনান্ট জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জীন জ্যাকুয়াস ডুনান্ট এবং মাতা এ্যানা এন্টো ইনেট কোলাডন। ১৮৫৯ সালের ২৪ শে জুন উত্তর ইতালীর সলফেরিনো নামক স্থানে ফ্রান্স ও অষ্ট্রিয়ার মধ্যে মানব ইতিহাসের ভয়াবহতম যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার মধ্য দিয়ে সমাজসেবামূলক কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট হন যা তিঁনি অমৃত্যু জড়িয়ে ছিলেন। ১৮৬২ সালের নভেম্বর মাসে অ গবসড়ৎু ড়ভ ঝড়ষভবৎরহড় (সলফেরিনো স্মৃতি) নামক গ্রন্থ রচনা করেন, যা পৃথিবীতে সে সময়ে খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৮৬৩ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি হেনরী ডুনান্ট ও অপর ৪ জন সদস্য নিয়ে ঈড়সসরঃঃঃবব ড়ভ ঋরাব গঠন করেন। ১৮৬৩ খ্রীঃ ২৬ শে অক্টোবর বিশ্বের সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক মানব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রেডক্রসের জন্ম লগ্নে প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯০১ খ্রীঃ ডিসেম্বর মাসে শান্তিতে তিনি প্রথম ‘নোবেল’ পুরস্কার লাভ করেন । ১৯১০ খ্রীঃ ৩০ শে অক্টোবর পূর্ব সুইজারল্যান্ডের হেইডনে ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ।
১৮৫৯ সালের ২৪ শে জুন তৎকালীন ইউরোপের দুই বৃহৎ শক্তি ফ্রান্স ও অষ্ট্রিয়ার মধ্যে ইতালীর এক পল্লী প্রান্তর সলফেরিনোতে তুমুল যুদ্ধ হয়। মোট তিন লক্ষ সৈন্যের মাত্র ১৫ ঘন্টা যুদ্ধে শুধুমাত্র আহতদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪২ হাজার। একদিকে বিজয়ী সৈন্যরা বিজয় উৎসবে মত্ত আর অন্যাদিকে ৪২ হাজার আহত মানুষের মৃত্যু যন্ত্রণার আর্তনাদ। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। মানব জীবনের প্রতি এই চরম অবজ্ঞা মানবসেবী ডুনান্টের হৃদয়ে দারুণভাবে রেখাপাত করে। তিনি তাৎক্ষণিক ভাবে তাঁর সকল ব্যবসায়িক কর্মসূচী বাতিল করে আহতদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন।
মহাত্মা জীন হেনরী ডুনান্ট ও তাঁর চারজন সহকর্মী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমর্থন ও সহায়তার আশায় ১৮৬৩ সালে ২৬ অক্টোবর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহবান করেন। মোট ১৬ টি দেশের প্রতিনিধি উক্ত সম্মেলনে যোগদান করেন ও হেনরী ডুনান্টের প্রস্তাব অনুযায়ী রেডক্রস নামে একটি আন্তর্জাতিক সেবামূলক নিরপেক্ষ সংস্থা গঠিত হয়। বর্তমান বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক মানব সেবামূলক সংস্থা রেড ক্রস এমনি ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে জন্ম লাভ করে।
আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের সংগঠন সমূহঃ আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইআরসি) ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (আইএফআরসি) ও জাতীয় রেড ক্রস’ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সমন্বয়ে বিশ্বব্যাপী রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি বা আইসিআরসি হচ্ছে রেডক্রস আন্দোলনের জন্মদাতা সংস্থা। ১৮৬৩ সালে ২৬শে অক্টোবর জেনেভা অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গঠিত রেডক্রসই হচ্ছে আইসিআরসি সংগঠনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত নিরপেক্ষ রাষ্ট্র সুইজারল্যান্ডের ২৫ জন নাগরিক নিয়ে এই কমিটি গঠিত। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধকালীন সময়ে আইসিআরসি আহত সামরিক/বেসামরিক লোকের সেবা যুদ্ধ ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়ে আহতদের চিকিৎসা নিপাপত্তার ব্যবস্থা ও ফিল্ড হাসপাতালের ব্যবস্থা করে থাকে। যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে যুদ্ধ বন্দীদের তদারকী ও বিনিময়ের ব্যবস্থা করে থাকে। জেনেভা কনভেনশনের সংরক্ষণ ও প্রয়োগ কেবলমাত্র আইসিআরসি সম্পাদন করে থাকে। এ যাবৎ ৪টি জেনেভা কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৯ সালের ২২ শে আগস্ট অনুষ্ঠিত এই কনভেনশনে পূর্ববর্তী সকল কনভেনশনের বিধিসমূহ চূড়ান্ত করা হয়।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (আইএফআরসি) বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সমূহের সমন্বয়ে ইন্টারন্যানাল ফেডারেশন অফ রেডক্রস ও রেড ক্রিসন্টে সোসাইটিজ গঠিত। ১৯১৯ সালে ৫ই মে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৯ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় স্থায়ীভাবে এর সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। আইএফআরসি বিশ্বের সকল জাতীয় রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সমূহের মধ্যে বন্যা, ঘুর্ণিঝড় দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুঃস্থদের সাহায্যার্থে বহুবিদ সেবামূলক কাজ করে থাকে। ১৯৯১ সালের নভেম্বর মাসের সাধারণ পরিষদের সভায় লীগ অফ রেডক্রস এন্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ এর নাম পরিবর্তন করে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ রেডক্রস এন্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ করা হয়।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে সরকার প্রধান সহযোগী ত্রাণ সংস্থা হিসেবে নিয়োজিত করেছে। সেহেতু, দেশের সার্বিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এবং আতৃ মানবতার সেবায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জাতীয় সদর দপ্তর সরাসরি এবং ইউনিটের মাধ্যমে বিপন্ন মানবতার সেবায় বিভিন্নমুখী কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। যেমনঃ দুর্যোগ ত্রাণ ও পুনবার্সন কার্যক্রম, ঘুর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী (সিপিপি), সিসিএ, ভিটুআর, স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম, অনুসন্ধান, সমাজ ভিত্তিক দুর্যোগ মোকাবেলা ব্যবস্থাপনা কর্মসূচী (সিবিডিএম), ওডি, যুব ও স্বেচ্ছাসেবক কার্যক্রম, রক্তদান কর্মসূচী, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, সিইপি, রেড ক্রিসেন্ট নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রচার এবং প্রসার, ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সাড়া প্রদান কর্মসূচী (ইউডিআর) প্রভৃতি।
বিশ্ব রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট দিবস-২০১৯ এর এই দিনে বাংলাদেশের আপামর জন সাধারণের প্রতি আকুল আবেদন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন মানবিক কার্যক্রমে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন আর্ত মানবতার সেবায় এগিয়ে আসুন।
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘ভালবাসা সর্বত্র সবার জন্য’।

লেখক : ব্যবস্থাপনা পর্ষদ সদস্য, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ভাইস চেয়ারম্যান, রেড ক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট