চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয় ও জনগণের ঐক্য প্রয়োজন

লায়ন এ কে জাহেদ চৌধুরী

৭ মে, ২০১৯ | ১:১২ পূর্বাহ্ণ

মানুষ সামাজিক জীব। অনাদিকাল ধরে মানুষ সামাজিক কাঠামোর মধ্যে বসবাস করে এসেছে। আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ (দঃ) এর পৃথিবীতে আগমনের পূর্বে মানুষ একে অন্যের সাথে হানাহানিতে লিপ্ত ছিল। জাতি, ধর্ম ও গোত্রীয় সংঘাত লেগেই ছিল। মানবতা, সৌহার্দ, সম্প্রীতিবিহীন পৃথিবীতে নবীজি নিয়ে এলেন শান্তির বাণী। সেই শান্তির বাণী শুনে সকল ধর্মের বর্ণের মানুষ শান্তিপূর্ণ সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করে। কিন্তু ১৪০০ বছর পরে এসে মনে হচ্ছে আবারও মানবজাতি সেই অন্ধকার যুগে ফিরে গেছে।
সকল ধর্মেই আছে মানব হত্যা মহাপাপ। কিন্তু মানুষ নামের কিছু বিপথগামী, ধর্মের নামে অহরহ মানুষ হত্যা করে চলেছে। গত ২১ শে এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় একটি জঙ্গি গোষ্ঠী তিনটি গীর্জা ও তিনটি পাঁচতারকা হোটেলসহ আটটি জায়গায় সিরিজ বোমা হামলা করে তিন শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে। ঐ হামলায় পাঁচ শতাধিক মানুষ আহত হয়, যাদের মধ্যে অনেকেরই অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই হামলার জন্য শ্রীলংকান সরকার স্থানীয় উগ্রপন্থী ন্যাশনাল তাওহীদ জামাতকে (এনটিজি) দায়ী করেছে। যদিও প্রধানমন্ত্রীর নিলবিক্রমা সিংহে আর্ন্তজাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস (ইসলামিক এস্টেট)-এর সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে ধারণা করেছেন। আইএস (ইসলামিক এস্টেট) এক বার্তায় এই হামলায় নিজেদের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে।
তারও কিছুদিন পূর্বে নিউজিল্যান্ডে জুমার নামাজ আদায়রত মুসল্লীদের উপর এক বন্দুকধারী ব্রাসফায়ার করে অর্ধ শতাধিক লোককে হত্যা করে এবং অনেক লোক আহতও হয়। বাংলাদেশেও জঙ্গি গোষ্ঠী বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে হামলা করে অনেক লোককে হত্যা করেছে। সকল প্রকার সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হামলাগুলো ধর্মীয় লেবাসে করা হলেও তাদের সাথে ধর্মের ন্যূনতম সম্পর্ক আছে কিনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। যারা ধর্ম ও সন্ত্রাসকে একাকার করতে চায় তাদের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞান নাই বলেই প্রতীয়মান হয়।
মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সকল ধর্মেই পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও শান্তির বাণী নিহিত আছে। কাউকে অত্যাচার করে বা জোর করে নিজ ধর্মের অনুসারী করার কথা কোন ধর্মেই উল্লেখ নাই। বরং পরমতে সহিষ্ণুতার কথাই বলা আছে। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ (দ:) তার বিদায় ভাষণে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহনশীল হতে বলে গেছেন। মহামতি বুদ্ধও বলেছেন, অহিংসা পরম ধর্ম। ঠিক এইভাবে খৃস্টধর্মেও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নিজ ধর্ম পালনের নির্দেশনা আছে। প্রতিটি ধর্মের এমন সহনশীল ও শান্তিময় নীতি থাকার পরেও যারা ধর্মের নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায় এবং মানুষ হত্যা করে , তাদের কি আদৌ কোন ধর্ম আছে? নাকি তারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বা স্বার্থাণে¦ষীমহল দ্বারা প্ররোচিত হয়ে এমন গর্হিত কাজ করে যাচ্ছে।
এই প্রশ্ন এখন সচেতনমহল ও ধর্মপ্রাণ মানুষের। কয়েকদিন আগে পত্রিকান্তরে প্রকাশ আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় এক ব্যক্তি মুসলিম ভেবে হত্যার উদ্দেশ্যে পথচারীদের উপর ইচ্ছাকৃত ভাবে গাড়ি তুলে দেয়। যদিও পরে দেখা গেল ঐ পথচারীরা মুসলিম নয়। মিয়ানমারে দীর্ঘদিন ধরে বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও সরকার কর্তৃক চলমান মুসলিম নিধনযজ্ঞ সরাবিশ্বে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। হাজার হাজার নারী, শিশু ও পুরুষকে হত্যা, ধর্ষণসহ পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধর্মের নামে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও জঙ্গি গোষ্ঠী এধরনের মানবঘাতী অপকর্ম করে চলেছে। লক্ষণীয় বিষয় হল, বাংলাদেশেও জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ধর্মের নামে বিভিন্ন সময় বোমা হামলাসহ নানাভাবে মানুষ হত্যা করেছে।
সর্বশেষ ২০১৬ সালে পবিত্র রমজান মাসে রাজধানী ঢাকার হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা করে দেশী বিদেশীসহ অনেক লোককে হত্যা করেছে। এরপর থেকে বাংলাদেশ সরকার জঙ্গি বিরোধী বিভিন্ন সফল অভিযানের মাধ্যমে তাদের অপ-তৎপরতা দমন করতে সক্ষম হয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখলেও বাংলাদেশে কোন ঘটনা ঘটলেই পশ্চিমা দেশ ও আর্ন্তজাতিক কিছু মানবাধিকার সংগঠন সেটাকে পুঁজি করে অপপ্রচার চালায়। যা সত্যিই দু:খজনক।
বাংলাদেশ থেকে জঙ্গি নির্মূল হয়েছে সেটা বলা না গেলেও জঙ্গি দমনে সফলতায় সরকারকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। তবে তথ্যাভিজ্ঞমহলের মতে, আমাদের আত্মতৃপ্তিতে ভুগলে চলবে না। জঙ্গিদের মূল উৎপাটন করেই যেন আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারি। শ্রীলংকায় দীর্ঘ কয়েক বছরের গৃহযুদ্ধের পর বিগত এক দশক ধরে শান্তির সুবাতাস বইছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ২১ শে এপ্রিলের সিরিজ বোমা হামলায় তাদের চৈতন্য ফিরে এসেছে। সুতরাং আমাদের দেশের সরকার ও আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে সদাসতর্ক থাকতে হবে বলে সচেতন মহল মতামত ব্যক্ত করেছেন।
পৃথিবীতে তালেবান জঙ্গি সংগঠনের পর আইএস (ইসলামিক এস্টেট) নামের জঙ্গি সংগঠনের অপতৎপরতা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভিৎ কাঁপিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়া সরকার দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করে তাদের দমন করেছে বলে দাবী করেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর দাবীও একই। যদি তাদের দাবী সঠিক বা যৌক্তিকও হয়ে থাকে, তবে এটাও মনে রাখতে হবে ঐ জঙ্গিরা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সুতরাং বিশ্বব্যাপী শান্তিপ্রিয় সকল মানুষের জানমাল রক্ষার্থে সম্ভাব্য সকল প্রকারের সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী হয়ে পড়েছে। নচেৎ শ্রীলংকার ঘটনার পূণরাবৃত্তি হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না।
ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে হামলার আশংকা করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি জনগণকেও সতর্ক থাকতে বলেছেন। ভারতীয় দৈনিক টাইম্স অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, আর্ন্তজাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর একটি টেলিগ্রাম চ্যানেল তাদের হামলার পরবর্তী টার্গেট হিসাবে বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের নাম উল্লেখ করেছে। আইএস বাংলায় লিখিত একটি পোস্টারে উল্লেখ করেছে, শীঘ্রই আসছি ইন্শাল্লাহ। যেহেতু পোস্টারটি বাংলায় লিখা হয়েছে, সেহেতু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন জঙ্গিরা বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গে হামলা করতে পারে এবং তারা এটিকে হামলার পরিকল্পনার নির্দেশনা বলে মনে করেন। তাদের অভিমত, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো বিশেষ করে মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা, বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, তারকা হোটেল, আদালতভবন, সংসদ ভবনসহ সম্ভাব্য সকল জায়গায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
জঙ্গি তৎপরতা দমনে বাংলাদেশ সফল হলেও আত্মতৃপ্তি নিয়ে বসে থাকলে বিপর্যয়ের শংকা রয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য বিশ্ববাসীর প্রশংসা অর্জন করেছে এবং বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মডেল হিসাবে বিশ্ববাসী স্বীকৃতি দিয়েছে। এই অর্জনকে কোনোভাবে ম্লান হতে দেওয়া যায় না।
জঙ্গিদের সকল অপতৎপরতা রুখে দিয়ে বাংলাদেশকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসমুক্ত দেশ হিসাবে বিশ^বাসীকে আবারও জানান দিতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সকল শাখার মধ্যে সমন্বয় ও জনগণের সুদৃড় ঐক্য গড়ে তোলার মাধ্যমেই অর্জিত সুনাম ধরে রাখা সম্ভব।

লেখক : কলামিষ্ট, প্রাবন্ধিক ও সাবেক ছাত্রনেতা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট