চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

তুরস্কের সুলতান সুলায়মান কে ছিলেন?

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

৬ মে, ২০১৯ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

দেশের একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে মাসের পর মাস ধারাবাহিক বাংলা ডামি করা তুরস্কের সুলতান সুলায়মানের উপর উপন্যাস জাতীয় নাটক প্রচার করে। এতে মানুষের স্বভাবতই তুরস্কের এ সুলতানের উপর কম বেশি ধারণা এসে যাওয়া স্বাভাবিক।
বাংলায় ডাব করা উক্ত ধারাবাহিক নাটকে দর্শক আকর্ষণ করার জন্য রূপ দেয়া স্বাভাবিক। বাস্তবতার নিরিখে তিনি কে ছিলেন?
বস্তুতঃ সুলতান সুলায়মানকে মহামতি সুলায়মানও বলা হয়ে থাকে। তিনি এক নাগাড়ে ৪৬ বছর অতি জাঁকজমকের সাথে বিশাল তুর্কি সা¤্রাজ্য নিয়ে রাজত্ব করেন। তার পিতা ছিলেন সুলতান সেলিম। তুর্কি সুলতানগণের মধ্যে তিনিও যোগ্যতার প্রমাণ রাখেন। কিন্তু মাত্র ৫৪ বছর বয়সে দুরারোগ্যে আক্রান্ত হয়ে ১৫২০ খ্রিস্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। সুলতান সেলিমের আমল হতেই একাধারে সুলতান ও খলিফার পদ মর্যাদার অধিকারী প্রথা চালু হয়। সুলতান সেলিম যুদ্ধের ক্ষেত্রে তার পিতার দুর্বল ও নিষ্ক্রিয়নীতি পরিহার করে বলিষ্ঠ নীতি গ্রহণ করেন।
ফলে পারস্য, মিশর, মূলকে শাম, জজিরাতুল আরবের বিশাল বিশাল অঞ্চল তুর্কি সা¤্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এতে ইসলামের পবিত্র স্থান সমূহ তথা পবিত্র মক্কা, পবিত্র মদিনা ও পবিত্র জেরুজালেম জয় করে মুসলিম বিশ্বে একচ্ছত্র আধিপাত্য কায়েম করেন। এতদ্ব্যতীত তিনি আব্বাসীয় বংশের নাম সর্বস্ব খলিফা আহমদ আল-মুতাওয়াক্কিলের নিকট হতে খেলাফতের দায়িত্বভার নিজের হাতে গ্রহণ করেন। তখন হতেই তুর্কি শাসকগণ একাধারে সুলতান ও খলিফার পদমর্যাদার অধিকারী হন।
তারই যোগ্যপুত্র সুলতান সুলায়মান। তিনি ছিলেন তুর্কি তথা অটোমান বংশের দশম সুলতান। অভিজ্ঞতার বলেই মাত্র ২৬ বছর বয়সে বিশাল তুর্কি সা¤্রাজ্যের শাসনবার লাভ করেও সুষ্ঠুভাবে শাসন করতে সামর্থ্য হন। যুবরাজ হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন বিধায় তিনি সিংহাসনে আরোহণ করা মাত্র সা¤্রাজ্যের জনগণ আনন্দ উল্লাসে তাকে স্বাগত জানায়। দয়া ও ক্ষমশীলতার জন্যও তিনি সা¤্রাজ্যে বিশেষ প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। তিনি ইউরোপের প্রায় অর্ধেকের মত দেশ অধিকার করতে সক্ষম হন। তাঁর দৃঢ় শাসনব্যবস্থায় ইউরোপে দারুণভীতি ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বেলগ্রেড, রোডস দ্বীপ, হাঙ্গেরী, ভিয়েনা, ইত্যাদি দেশ তার নিয়ন্ত্রণে তটস্থ থাকত।
এদিকে বাগদাদ,তাবরীজসহ আরব পেরিয়ে পারস্যের বিশাল অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হন। তার আমলে স্থল বাহিনীর ন্যায় নৌশক্তিও চরম উন্নতি লাভ করে। বিশ্বের নামকরা সুদক্ষ নৌ সেনাধ্যক্ষের সাহায্য ও সহযোগিতা লাভ করেছিলেন। এতে ভূমধ্যসাগর, লোহিত সাগর ও আরব সাগরে তুর্কি নৌবাহিনীর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে তিউসিনিয়া, ত্রিপোলী, ওমান, এডেন, ইয়েমেন ও ভূমধ্যসাগরের কতগুলো দ্বীপ অধিকার করেন।
সুলতান ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে হাঙ্গেরী আক্রমণ করে রাজধানী বুদাপেস্ট অধিকার করেন। এ হাঙ্গেরীকে পাঁচটি প্রদেশে বিভক্ত করে পৃথক পৃথক গর্ভণর নিয়োগ করেন। অতঃপর সুলতান ক্রোয়েশিয়া দখল করে নেন। সুলতান সুলায়মান যেমন ছিলেন শ্রেষ্ঠ বিজেতা তেমনি ছিলেন একজন সুশাসকও। শাসনকার্য সুবিধার জন্য তিনি সমস্ত সা¤্রাজ্যকে ২১ টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। এ প্রদেশগুলোকে আবার ২৫০ টি ‘সানজাক’ (জেলা) এ বিভক্ত করেন। সানজাক আবার কাজাসে বিভক্ত হয় এবং প্রত্যেকটি কাজাস কার্য দ্বারা শায়িত হত। প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন গর্ভণর এবং জেলার শাসনকর্তা ছিলেন পাশা।
সুলতানের নি¤œলিখিত প্রদেশগুলো হল- (১) রুমেনিয়া (গ্রীস, ম্যাসোডোনিয়া, থ্রেস,ইপিরাস, ইলিরিয়া, ডারমাসিয়া ও মেয়োসিয়া নিয়ে গঠিত) (২) আকিপেরাগোর দ্বীপসমূহ (৩.) আলজিরিয়া ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল (৪) ত্রিপোলী (৫) বোদা (পশ্চিম হাঙ্গেরীর বিজিত অংশসমূহ ) (৬) তেমেশ্বর (হাঙ্গেরীর পূর্বাংশ ও ট্রানসিলভানিয়া) (৭) আনাতোলিয়া (এশিয়া মাইনরের উত্তর পশ্চিমাংশ) (৮) কারামানিয়া,ল্যাকোনিয়া, সিলিসিয়া,কাপডোসিয়া ও গ্যালাতিয়া একজন গর্ভনরের অধীনে ছিল। (৯) রোম অ্যামিসিয়া ও প্রাচীন প্রন্টাস মিলিয়া একটি প্রদেশ। (১০) সুলাকাদার (মালাতিয়া,সামোছাটা ও মাউন্ট টাউরাসসহ), (১১) ত্রিবিজোন্দ, (১২) দিয়ারবেকির (১৩) আর্মেনিয়া ও কুর্দিস্তানের অধিকাংশ অঞ্চল, (১৪) আলেপ্পো, (১৫) দামাস্কাস, (১৬) মিসর, (১৭) (পবিত্র) মক্কা ও (পবিত্র) মদিনা জেদ্দা নিয়ে হেজাজ (১৮) ইয়েমেন ,এডেন, পারস্য ও ভারতীয় উপকূলভাগ, (১৯) বাগদাদ, (২০) মসুল ও (২১) বসরা। এছাড়া সুলতানের অধীনে বহু করদ রাজ্যও ছিল। যথা- ওয়ালাবিয়া, মালদাভিয়া, রেগুসা ও তুর্কিস্তানের অংশবিশেষ।
সুলতান সুলায়মানের সাফল্যের মূলে ছিল তাঁর সুশিক্ষিত ও সুশৃংখল সেনাবাহিনী। তাঁর আমলে তুরস্কের সৈন্য ছিল, ২ লাখ হতে ৩ লাখ। এরা সে যুগের সেরা সুসজ্জিত সৈন্যদের অন্যতম ছিল। সৈন্যবাহিনী প্রথমে জেনিসারীদের নিয়ে গঠিত হয়। জেনিসারীদের সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার। সুলতানের সিপাহী ও তাদের অনুচরদের সংখ্যা ৪০ হাজার এর মত ছিল। জায়গীরদারদের প্রেরিত সিপাহী ইউরোপে প্রায় ৫০ হাজার এবং এশিয়ায় ৩০ হাজার ছিল। এছাড়াও সৈন্যবাহিনীতে অন্যান্য দল; যথা- জেবিজী (পদাতিক ও তীরন্দাজ), আখেঞ্জী (অশ্বারোহী) এবং আজাস (অনিয়মিত পদাতিক) ছিল। সামরিক শিবিরে পরিচ্ছন্নতা,শৃংখলা ও মততার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেয়া হত।
সুলতান একজন বিখ্যাত আইন প্রণয়নকারী ছিলেন। তাঁর রাজত্বকাল আইনের সংস্কারের জন্য সমধিক প্রসিদ্ধ। ভূমি-সংস্কার এ সংস্কার কার্যের মধ্যে প্রধান। সামন্ত প্রথা সহজ ও উন্নত করা হয়। তিনি উপ-সামন্তবাদকে ধ্বংস করে সাম্রাজ্যকে সামন্তবাদের কুফল হতে মুক্ত করেন। রাজস্বের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে ন্যায়সঙ্গত হার নির্ধারণ করে দেন। তাঁর আইনের নিকট সকল প্রজা সমান ছিল। উদার ও সদয় শাসনে আকৃষ্ট হয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশ হতে হাজার হাজার খ্রিস্টান তাদের শাসকের অত্যাচার ও নির্যাতনের হাত হতে রক্ষা পাবার জন্য তুরস্কে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক লর্ড ক্রেজি বলেন, খ্রিস্টান জগতে রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্টদের মধ্যে অত্যাচার ও বিচারের যুগে সমসাময়িক কোন শাসকই সুলায়মানের ন্যায় প্রশংসা অর্জন করতে পারেন নি। সুলতান তুরস্কের আইনসমূহ আধুনিকীকরণ করেন। তিনি অপরাধের জন্য অঙ্গচ্ছেদন রহিত করে এবং ফৌজদারী আইনের কঠোরতা হ্রাস করে তুরস্কের আইনের আধুনিক পর্যায়ে উন্নীত করেন। তিনি দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের বরখাস্ত করে সৎ ও যোগ্য কর্মচারী নিয়োগ করেন। তাঁর শাসন ব্যবস্থায় কোন পক্ষপাতিত্ব ছিল না। তিনি ন্যায়বিচারের স্বার্থে নিজের জামাতাকে পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগে গর্ভণরের পদ হতে বরখাস্ত করেছিলেন।
সুলতান সুলায়মান শিক্ষা ও শিক্ষিতদের একজন উদার পৃষ্টপোষক ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালকে তুরস্কের ইতিহাসে ‘অগাস্টন যুগ’(অঁমঁংঃধহ অমব ড়ভ ঞঁৎশবু) বলা হয়। তাঁর আমলে তুর্কি-সাহিত্য বিশেষ সমৃদ্ধি লাভ করে। সুলতান নিজের দর্শনশাস্ত্র ও কবিতার চর্চা করতেন। তিনি প্রজাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য উদার হাতে অর্থ ব্যয় করতেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় রাজ্যে বহু স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর রাজ দরবারকে বহু বিখ্যাত কবি ও প-িত অলংকৃত করেন। এসব বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে পিরি, রায়েস ও সিদি আলীর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
শিল্প স্থাপত্যের ক্ষেত্রে সুলতান সুলায়মানের তুলনা হয় না। নির্মাতা হিসেবে তাঁকে জাস্টিনিয়াসের সাথে তুলনা করা যায়। কিন্তু ঐতিহাসিক ক্রেজি বলেন, “সুলতান ও জাস্টিনিয়ানের মধ্যে তুলনা করলে সুলায়মানের প্রতি অসম্মান করা হবে।” মসজিদ, হাসপাতাল, ¯œানাগার ও সেতু কেবলমাত্র কনস্টান্টেনোপলেই ছিল না, রাজ্যের প্রধান প্রধান শহরেও এগুলো নির্মিত হয়েছিল। মসজিদের মধ্যে ‘সুলেমানিয়া’ মসজিদ সবচেয়ে সুন্দর ছিল। এসব জনহিতকর প্রতিষ্ঠান সুলতানের স্থাপত্য শিল্পের প্রতি অনুরাগের পরিচয় দেয়। এ সমস্ত বিবেচনা করে অটোমান সা¤্রাজ্যের ইতিহাসে সুলায়মানের যুগকে ‘গৌরবের যুগ’ বলা হয় এবং এটাকে গ্রীসের ‘পেরিক্লিয়ান যুগ’ ও ইংল্যান্ডের এলিজাবেথিয়ান যুগের’ সাথে তুলনা করা হয়।
(আগামীবারে সমাপ্ত)

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট