চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

নারী ও শিশুর ওপর ক্রমবর্ধমান সহিংসতা

পাহাড়ী ভট্টাচার্য

২৯ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৪৭ পূর্বাহ্ণ

রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাদি, স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা ও অপরাপর কতিপয় সেবা, কর্ম-পরিবেশ, জীবনমান, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, বিপরীত লিঙ্গ কর্তৃক আচরণ ও সহিংসতার সামগ্রিক মাত্রা বিবেচনায় আজকের পৃথিবীতে ১০টি দেশকে নারীদের জন্য চরম বিপজ্জনক বলে গণ্য করা হয়। দেশগুলো হল ক্রমানুসারে- ভারত, আফগানিস্তান, সিরিয়া, সোমালিয়া, সৌদি আরব, পাকিস্তান, কঙ্গো, ইয়েমেন, নাইজেরিয়া ও আমেরিকা। বাংলাদেশ কি সে পথে হাঁটছে? আমাদের সমাজ কি ক্রমশ নারী ও শিশুদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে না ?

সাম্প্রতিক সময়ের পত্র-পত্রিকা, টিভি-চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগের তাবৎ মাধ্যম জুড়ে প্রায় প্রতিদিন দেশের কোন না কোন প্রান্তে নারী-শিশুর ওপর একক ও সংঘবদ্ধ আক্রমণ, সহিংসতা-নিপীড়ন-বলাৎকার-হত্যাকা- ও নৃশংসতার অসংখ্য ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। দু-তিন বছরের শিশু থেকে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা-কেউই রেহায় পাচ্ছে না সমাজের এক শ্রেণীর মানসিক-বিকারগ্রস্ত, বিকৃত নরপশুদের হাত থেকে। সুপরিকল্পিত কায়দায় এরা শিশু ও নারীদের টার্গেট করে যৌন-নিপীড়ন, শারীরিক আক্রমণ, ধর্ষণ-হত্যার মত ঘৃণ্য তৎপরতাসমূহ অব্যাহত রেখেছে। সম্প্রতি বেড়ে গেছে গণপিটুনিতে বর্বর কায়দায় প্রকাশ্যে হত্যাকা-ের ঘটনাও।
নারী-শিশুর ওপর পরিচালিত বহুমাত্রিক সহিংসতার চলমান ধারা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। একই দিনে একাধিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাও দেশে ঘটছে। সবচাইতে আশঙ্কার কথা, পত্র-পত্রিকা-সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে ভিকটিম নারী ও শিশুদের ছবি, কোন কোন ঘটনার ভিডিও ফুটেজও। কোন কোন ঘটনার মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতে হচ্ছে আমাদের।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী ২০১৯ সালের প্রথম ৬ মাসে সারাদেশে ৭৩১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। এ সকল সংগঠিত অপরাধের ৩-৪ শতাংশের বিচার হয়েছে মাত্র। বাকি অপরাধী গ্রেফতার ও শাস্তির কথা দূরে থাক, অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনায় থানায় কিংবা আদালতে মামলাও দায়ের হয়নি। অন্যদিকে, গত ১ জুলাই ২০১৯ ঢাকা ট্রিবিউন প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী এবং বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম-এর পরিসংখ্যান মতে, ২০১৯ সালের প্রথম ৬ মাসে সারাদেশে ৪৯৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। গত বছরের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ৩৫১। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত একটি জরিপ বলছে, দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ শারীরিক নির্যাতনকেই কেবলমাত্র নির্যাতন বলে বিবেচনা করে নারীদের ক্ষেত্রে। যদিও অশোভন আচরণ, পারিবারিক পর্যায়ের বহুমাত্রিক সহিংসতা, যৌতুক, তালাকের হুমকি এবং ধর্ষণসহ নারীনির্যাতনের বিবিধ ধরন ও ঘটনাবলি এ সমাজে নিয়ত দৃশ্যমান।

লক্ষ্যণীয়, ধর্ম-বর্ণ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে অবোধ শিশু থেকে শুরু করে ছাত্র-ছাত্রী, গৃহবধূ কিংবা কর্মজীবী নারী প্রায় অনেকে শিকার হচ্ছেন কম-বেশি যৌন-নিগ্রহ, সহিংসতা ও খুন-ধর্ষণের। নিপীড়ক ও ধর্ষকদের মধ্যে আছেন পাড়ার কতিপয় ছিঁচকে মাস্তান থেকে শুরু করে মুদি দোকানদার, ডিশ ব্যবসায়ী, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, ইমাম-পুরোহিত-কথিত পীর, সমাজের প্রভাবশালী ও রাজনীতি-সম্পৃক্ত লোকজন।

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কোন নাগরিক, অন্য কারো দ্বারা শারীরিক-মানসিক আক্রমণ, নিগ্রহ-নিপীড়নের শিকার হলে (ভার্বাল/ফিজ্যিক্যাল-মেন্টাল এবিউস, টর্চার/টরমেন্ট-ইত্যাদি) বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার ও কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। সহিংসতার মাত্রা বিবেচনায় রয়েছে যাবজ্জীবন কারাদ-, জেল-জরিমানা এমনকি এসিড-সন্ত্রাসের মত কোন কোন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে মৃত্যুদ-ের বিধানও। তা সত্ত্বেও, সমাজ এক প্রকার কর্তৃত্ববাদিতা, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, বিলম্বিত বিচারপ্রক্রিয়া ও কোন কোন ক্ষেত্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বহাল থাকায় যাবতীয় অপরাধ ও অপরাধপ্রবণতা ক্রমশ উৎসাহিত হচ্ছে। ফলে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খুন-ধর্ষণ-গণপিটুনির ঘটনাবলি।

সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে খুন হওয়া কিংবা ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত গৃহবধূর কথা ভাবলেই সংবেদনশীল যে কোন মানুষের গা শিউরে উঠবে। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্রটি এ অল্প কয়েকটি ঘটনায় অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বেসরকারী সংস্থা অ্যাকশন এইড এবং জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ফোরামের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দেশের ৬৬ শতাংশ নারী এমনিতেই পারিবারিক নির্যাতনের শিকার। এদের ৭৩ শতাংশই কোনদিন এ নির্যাতন সম্পর্কে মুখ খোলেননি। সাম্প্রতিক সময়ে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিশু নির্যাতন, বলৎকার ও খুনের ঘটনাও।
যে কোন অন্যায়-অপরাধের তদন্ত, দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া ও অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নিশ্চয়তা অপরাধ ও অপরাধ-প্রচেষ্টা নির্মূল করতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজে-রাষ্ট্রে খুব বেশি দৃশ্যমান নয়। এটি ধাপে ধাপে নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে, নারীদের প্রতি আমাদের সমাজের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা ইতিবাচক নয়। আমাদের চর্চিত পারিবারিক অনুশাসনে, জীবনধারায়, সামাজিক কৃষ্টিতে, ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধে নারীদের আদৌ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার শিক্ষা দেয়া হয় কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীকে পুরুষের প্রতিপক্ষ ভাবা হয়। এ সমাজে নারীর অস্তিত্ব, ইচ্ছা-অনিচ্ছা মূল্যহীন, প্রতিপদে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত, নারী অবমূল্যায়িত হতে থাকে প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকতার বহুমাত্রিক প্রভাবে। জনসংখ্যার অর্ধেক-এরও বেশি নারীদের সাথে আমাদের সামষ্টিক আচরণ ও মনোজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির বদল অত্যাবশ্যক। সেটি প্রথমে ব্যক্তি ও পরিবার থেকেই শুরু করা জরুরি।

আমাদের দেশে ব্যক্তিগত-পারিবারিক-রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর নারীর কর্তৃত্ব খুবই ক্ষীণ। অর্থনৈতিক দৌর্বল্য ও সামাজিক পশ্চাদপদতা নারীকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। নারীর সত্যিকারের ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণ একটি উন্নততর সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণের স্বার্থেই আজ অত্যাবশক। এটি নারীর ওপর যে কোন ধরনের সহিংসতা নির্মূলেরও অন্যতম উপায়। একটি গণতান্ত্রিক, বিজ্ঞান-মনস্ক, সেক্যুলার, মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা উদার ও আধুনিক নাগরিক সৃষ্টিতে অপরিহার্য। এর অনুপস্থিতিতে কুসংস্কার সমাজে বাসা বাঁধছে, ফলে প্রজন্মের চেতনা ও মনোজগত নির্দিষ্ট গ-িবদ্ধ ও ক্রমাগত সীমিত হয়ে পড়ছে।

সুস্থ বিনোদনের অভাব, মেধা-মনন চর্চার বিকল্পহীনতাও তৈরি করছে এক প্রকার অপরাধমনস্কতা। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাপকতা, সহজলভ্যতা এবং সেসবের ব্যবহারের ওপর প্রয়োজনীয় নজরদারী প্রয়োজন। নিয়ন্ত্রণহীনতাও সমাজে অপরাধ-প্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ, যা নারী ও শিশুর ওপর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ণ-লুটপাট-বিচারহীনতা সমাজে যতকাল ক্রিয়াশীল থাকবে, লক্ষ্য-নীতি-আদর্শবিহীন অপরাজনীতির ও রুগ্ন সংস্কৃতির ধারা বহাল থাকবে, ততদিন খুন-ধর্ষণের মত অনুরূপ অপরাধ শুধু উৎসাহিতই হবে না, অব্যহত গতিতে বাড়বে। এর মূলোৎপাটনে, আমাদের সক্রিয়, সোচ্চার, ঐক্যবদ্ধ হবার বিকল্প নেই।

লেখক : রাজনৈতিক কর্মী, একটি বেসরকারী শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট