চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ব্যাংকিং খাতে সুশাসন

মোহাম্মদ আবু তাহের

২৭ আগস্ট, ২০১৯ | ১:৫০ পূর্বাহ্ণ

মানবদেহে বিভিন্ন শিরা উপশিরার মাধ্যমে রক্ত সঞ্চালনের ফলে মানবজীবন ক্রিয়াশীল থাকে। দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মপ্রবাহে ব্যাংক সঞ্চয় সংগ্রহ ও ঋণপ্রবাহ সৃষ্টির মাধ্যমে সামগ্রিক গতিশীলতা আনয়নের চেষ্টা করে, অর্থনৈতিক কর্মকা-ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, বৈদেশিক রেমিট্যান্স, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, মাঝারি ও বৃহৎশিল্প প্রতিষ্ঠান, কৃষিভিত্তিক যাবতীয় পণ্য উৎপাদন ও বিপণন, আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মসূচি প্রভৃতি। যে কোন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সুরক্ষায় পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধা ব্যতীত সম্ভব নয়, ব্যাংক জনগণ থেকে আমানত গ্রহণ করে এ সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকা-ে অর্থায়ন করে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধন করে। দেশের সকল অঞ্চল ও শ্রমজীবী মানুষের কাছে ঋণপ্রবাহ সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজের সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব।

স্বাধীনতা পূর্বকালে দেশে সীমিত ব্যাংকিং সুবিধা চালু থাকলেও ব্যাংকিং ব্যবস্থা সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে বিস্তার লাভ করেনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শুধুমাত্র বিদেশী ব্যাংক ছাড়া সকল ব্যাংক ১৯৭২ সনের ৩১ শে মার্চ জাতীয়করণ করে ব্যাংকিং কর্মকা- জনগণের নিকট প্রসারিত করার প্রয়াস নেয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের গ্রামীণ জনপদে বিস্তর শাখা খোলা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে কৃষি ব্যাংক এর পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের মাধ্যমে গ্রাম্য মহাজনের কাছ থেকে কৃষকদেরকে রক্ষার উদ্দেশ্যে বিনা জামানতে স্বল্প হার সুদে এটা ১০০ কোটি টাকার শস্য ঋণ প্রকল্প চালু করা হয়। আউশ, আমন ও বোরো ধানের জন্য ঋণ মঞ্জুর করে। এর ফলে বহু বেকার যুবক কৃষি কাজে সম্পৃক্ত থাকে এবং ধীরে ধীরে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে অগ্রগতি পরিদৃষ্ট হলে কৃষিভিত্তিক সকল উৎপাদিত পণ্য খাতে ঋণসুবিধা বৃদ্ধি করা হয়। শস্যঋণ ছাড়া কৃষিভিত্তিক অন্যান্য উল্লেখযোগ্য খাত হচ্ছে; হিমাগার ও আলু সংরক্ষণ, পুকুর খনন ও মৎস্যচাষ, পোল্ট্রিশিল্প, শাক-সবজি, ফল ও ফুল চাষ , বাঁশ ও বেত শিল্প, মৃৎশিল্প, তাঁত বুনন, চিংড়ি চাষ, লবণ উৎপাদন, রেশম শিল্প ইত্যাদি। এতে করে যুবক ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন কর্মসংস্থানমূলক কর্মসূচিতে ঋণপ্রবাহ সঞ্চালনের মাধ্যমে দেশের জনগণকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করা হয়। বিশেষ করে যাদের মধ্যে ঝুঁকি গ্রহণের মনোভাব রয়েছে যাদের উদ্ভাবনী শক্তি বা সৃজনশীলতা প্রবল এবং যাদের মধ্যে অধ্যবসায় ও সাফল্য লাভের তীব্র আকাংখা রয়েছে তাদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রকল্পে অর্থায়ন করে একদিকে যেমন বেকার সমস্যার সমাধান করছে অপরদিকে জাতীয় উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব রাখছে।

দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক ও মেধায় তারা পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সফল উদ্যোক্তা হিসেবে শিল্প, বাণিজ্য ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে তাদের অবদান প্রশংসনীয়। সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে তাদের পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন করে ব্যাংক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি গ্রামের দুস্থ বিধবা ও অনগ্রসর মহিলা যাদের এককালে ঘরকন্নার কাজ করা ছাড়া আর কিছু ছিল না তাদেরকে ব্যাংক বিভিন্ন আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মকান্ডে বিনা জামানতে স্বল্প সুদে ঋণ সাহায্য দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলছে। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংক বৃহৎ আকারের শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্পঋণ ও চলতি মূলধন ঋণ বাবদ স্বল্প সুদে ঋণ মঞ্জুর করে শিল্পায়নকে গতিশীল করছে।

পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান দেশের শিল্পায়নে এক বিস্ময়কর সংযোজন। মোট রপ্তানির শতকরা ৭৬% এই শিল্প যোগান দেয়। এ খাতে শ্রমিকদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ গ্রাম ও শহরের হতদরিদ্র অসহায় নারী। বিজিএমইএ -থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে দেশের প্রায় সাড়ে চারহাজার পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৩৬ লক্ষ শ্রমিক কাজ করছে। এ শিল্পের সাথে সম্পর্কিত আরো বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে, ধীরে ধীরে পোশাকশিল্প অর্জিত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতায় বিশ্বে বাংলাদেশ অত্যন্ত সম্মানের আসন দখল করেছে। ব্যাংক এ খাতে ব্যাক টু ব্যাক ঋণ, প্যাকিং ক্রেডিট, প্রকল্পঋণ ও চলতি মূলধন বাবদ ব্যাপক হারে আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। পোশাকশিল্পের পাশাপাশি দেশে পাট, টেক্সটাইল, কাগজ ও নিউজপ্রিন্ট, সার, চামড়াজাত পণ্য, সিমেন্ট, রাসায়নিক শিল্প, ঔষধ এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্প ব্যাপক হারে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করছে আবার আমদানি বিকল্প হিসেবে পণ্য উৎপাদন করে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে।

বিদেশি ক্রেতাদের বাংলাদেশ পোশাকের ক্রয়াদেশ দেয়ার অন্যতম আকর্ষণ ছিল সস্তা শ্রম, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের কারণে ইতিমধ্যে মহিলাকর্মীসহ দক্ষ জনবল মানসম্পন্ন পোশাক প্রস্তুতে সক্ষমতা অর্জনের কারণে বিদেশী ক্রেতারা বাংলাদেশে ক্রয়াদেশ প্রদানে ঝুঁকে পড়েছে কিন্তু সমস্যা হল তারা তাদের ক্রেতার নিকট চড়া মূল্যের পোশাক বিক্রি করলেও অনেক কম মূল্যে বাংলাদেশকে রপ্তানি মূল্য প্রদান করে। এতে ব্যাংকের গৃহীত ঋণের সুদ, কাঁচামালের মূল্য শ্রমিকের মজুরি প্রদান করে মুনাফার কিঞ্চিৎ অংশ তাদের পকেটে যায়। অপরদিকে মালামাল রপ্তানি করার পরে ক্রেতারা ত্রুটিপূর্ণ ডকুমেন্টের অজুহাতে এলসি মূল্যের চেয়ে আরো ডিসকাউন্ট প্রদানে রপ্তানিকারককে বাধ্য করে। অনেকেই বিদেশী বন্দর থেকে রপ্তানিকৃত পণ্য ফেরত দেয়। এই অবস্থায় সঠিক রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবসিত না হলে দায় বর্তায় ব্যাংকের উপর। কারণ রপ্তানিকারক ইতিমধ্যে ব্যাক টু ব্যাক সহ যাবতীয় ঋণ গ্রহণ করায় ঋণের টাকা ফেরত দিতে পারে না। এ কারণেও বাংলাদেশের বিশাল অঙ্কের খেলাপিঋণ স্থবির হওয়ার জন্য দায়ী। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ মুদ্রা বাজার থেকে স্বল্পমেয়াদী সঞ্চয় গ্রহণ করে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ বিতরণ করে, দেশের বেশিরভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ মূলধন বাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ না করে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে এই মূলধন দীর্ঘমেয়াদি ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে। উচিত ছিল মূলধন বাজার থেকে এই অর্থের যোগান দেয়া কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় এই বাজার সংঘটিত না হওয়ায় অতি সহজে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রকল্পঋণসহ যাবতীয় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের উপর প্রচন্ড চাপ পড়ে। আমাদের দেশে যে পরিমাণ বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে অনুরূপভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ব্যাংকসমূহ অতিমাত্রায় মুনাফামুখী হওয়ায় সীমিত সংখ্যক বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ঋণের যোগান দিয়ে পরস্পর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে। এসব ক্ষেত্রে বিপণন, উৎপাদন ক্ষমতা, মুনাফা অর্জনের সক্ষমতা প্রভৃতি বিচার করে ঋণ প্রদানের সামর্থ্য নির্ণয়ে যথেষ্ট সচেতন হতে পারে না এবং দেশ খেলাপিঋণের ভার সইতে পারে না।
ঋণ পরিশোধে বাধ্যতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি না হলে সহজেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে সকল ব্যাংক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকার সম্মিলিতভাবে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে খেলাপিঋণ সংস্কৃতি সংকুচিত হওয়া সম্ভব।

লেখক : সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট