চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও সুপারবাগ নিয়ে দুর্ভাবনা

৪ মে, ২০১৯ | ১:০৯ পূর্বাহ্ণ

ফার্মেসিগুলোতে নিবন্ধিত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের অবাধ বিক্রির ঘটনা বহুল আলোচিত। দেশে এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে বলে বছরকয়েক ধরেই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। নানা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও গবেষণা রিপোর্টেও এর প্রমাণ মিলেছে। এখন রোগনিরাময়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ফার্মেসিতে গিয়ে দোকানির পরামর্শে এন্টিবায়োটিক ওষুধ কেনা। পরিণতিতে রোগপ্রতিরোধে এখন আগের মতো কার্যকর ফল মিলছে না। আবার সাময়িকভাবে রোগ সেরে গেলেও, রোগীকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগতে হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে ওষুধপ্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও কার্যকর পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হয়নি। শেষ পর্যন্ত যথাযথ তত্ত্বাবধান ও নিবন্ধিত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিটের প্রাথমিক শুনানিশেষে সরকারকে এই নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টর এ নির্দেশ তাৎপর্যের দাবিদার। আমরা উচ্চআদালতের এমন নির্দেশকে স্বাগত জানাই। আশা করা যায়, যথাযথ বাস্তবায়ন হলে আদালতের এ নির্দেশ দেশের জনস্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার মানবজীবনের জন্য এক পরম আশীর্বাদ। রোগ-জীবাণুর বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। রোগচিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের যথাযথ ব্যবহার রোগীকে সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। কিন্তু পাশাপাশি এর অপব্যবহার স্বাস্থ্যঝুঁকিরও বড় কারণ। বিভিন্ন গবেষণা ও অনুসন্ধানী রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ ব্যবহারের প্রবণতা প্রবল। ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ফার্মেসি থেকে প্রায় সব ধরনের ওষুধ কেনা যায় সহজে। আবার চিকিৎসকদেরও অনেকেই রোগ নিরাময়ে যথেচ্ছভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শপত্র দিয়ে থাকেন। ফলে দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য তা অন্যতম প্রধান হুমকি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠার পেছনে নিবন্ধিত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি এবং ওষুধবিক্রেতা ও ক্রেতার অসাবধানতা বড় ভূমিকা রাখছে। যেসব এ্যান্টিবায়োটিক বিভিন্ন জটিল রোগ প্রতিরোধে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে, সেগুলোর অনেক এ্যান্টিবায়োটিক আজ জীবনের ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সাবধানী না হলে খুব শীঘ্রই মানবজাতি জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রাণরক্ষার যুদ্ধে পরাস্ত হবে।
দিনকয়েক আগে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র বা আইসিইউ-তে থাকা রোগীদের একটি বড় অংশের মৃত্যুর পেছনে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দায়ী, যাদেরকে এই ক্ষমতার জন্য ‘সুপারবাগ’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, এক দশক আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি ব্যাকটেরিয়া ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। ২২ এপ্রিল প্রকাশিত দ্য টেলিগ্রাফের ‘‘সুপারবাগস লিঙ্কড টু এইট আউট অব টেন ডেথস ইন বাংলাদেশ আইসিইউ’স’’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) ৮০ শতাংশ মৃত্যুর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সুপারবাগ দায়ী। বিষয়টি অত্যন্ত আতঙ্কজনক এক বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে। অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি শরীর প্রতিরোধ গড়ে তুললে সে অবস্থাকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। এই প্রবণতার কারণে প্রতিবছর বিশ্বে সাত লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ২০৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াতে পারে এক কোটিতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, পশুখাদ্য, মাছ এবং কৃষিতে অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষিতে, যা দেশে ব্যবহৃত মোট অ্যান্টিবায়োটিকের প্রায় অর্ধেক।
ফলে খুব সহজেই কৃষিখাদ্যের মধ্য দিয়ে এই অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের শরীরে ঢুকছে। এতে একদিকে যেমন অ্যান্টিবায়াটিকের কার্যকারিতা হারাচ্ছে, তেমনি শরীরও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারাচ্ছে। অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে সামান্য জীবাণুু সংক্রমণও এখন ব্যবহারকারীর জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য যে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে তা উদ্বেগজনক। এই চিত্রের অবসানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে জাতিকে এর চরম খেসারত দিতে হবে। আমরা দেশবাসীকে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ দেখতে চাই। আমাদের বিশ^াস, ঔষধপ্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সবাই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিলে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ধীরে ধীরে কমে আসবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট