চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ব্যবহার কমাতে তামাকপণ্যের কর বৃদ্ধি জরুরি

সৈয়দ মোহন উদ্দিন

৩০ এপ্রিল, ২০১৯ | ১:০৯ পূর্বাহ্ণ

নগরীর জামালখান মোড়ে শাদা শার্ট পরিহিত কিছু কিশোরের জটলা। দেখে বোঝা যায়, বড়জোর স্কুলের গ-ী পেরিয়ে কলেজে উঠেছে তারা। একটু এগিয়ে দেখা যায়, সেই শিক্ষার্থীরা একটি সিগারেট তিনচারজন ভাগ করে টানছে। এই নিয়ে চলছে তাদের মধ্যে খুনসুটি।
কথার ছলে জিজ্ঞেস করলাম, এসব খেয়ে কি লাভ? তোমরা তো অনেক ছোট! দ্ব্যর্থহীন উত্তরে একজন বলে উঠলো, ভাই স্মার্ট হতে হলে এগুলো খেতে হয়, এটা স্টাইল, ফ্যাশন!
ভাবতে বিস্ময় লাগলেও এটিই এখন বাস্তবতা। সাথে সাথে কোন প্রতিক্রিয়া না থাকায় সময় কাটাতে তামাক সেবনে এভাবেই জড়িয়ে পড়ছে অসংখ্য তরুণ-কিশোর। এছাড়া, সাহস দেখানো, গ্রুপে মিশে থাকার জন্য, আর তারকাদের দেখেও তামাকের অভ্যাস গড়ে উঠছে তাদের মধ্যে। তবে, সব কিছুর উর্ধ্বে তামাকপণ্যের স্বল্পমূল্য এবং সহজলভ্যতাই যেন এসব তরুণদের ঠেলে দিচ্ছে তামাকের মরণনেশার দিকে। বর্তমানে বাজারে ৩ টাকা থেকে শুরু করে ১১ টাকার মধ্যে বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি ব্রান্ডের সিগারেট পাওয়া যায়। শিশুদের কাছে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় আইনত নিষিদ্ধ হলেও সে আইন মান্য করছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে, খুব সহজে হাতের নাগালে মিলছে এসব তামাকপণ্য।
নগরীর অধিকাংশ স্কুল-কলেজের ১০০ গজেরও কম দূরত্বে রয়েছে বেশ কয়েকটি সিগারেটের দোকান।শিশু-কিশোরদের নিকট তামাকপণ্য বিক্রয় সম্পর্কে জানতে চাইলে এক সিগারেট বিক্রেতার বলেন, কেউ সিগারেট চাইলে আমরা দিতে বাধ্য হই। আমি না বিক্রি করলে আরেক দোকান থেকে তারা কিনবে। তবে, সিগারেট খেতে বারণ করলে তারা আমাদের উল্টো জ্ঞান দিয়ে চলে যায়। আরেক ব্যবসায়ী বলেন, আইনে তো প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়াও নিষেধ। কয়জনে সে আইন মানে? আর, এতো আইন দেখলে তো আর ব্যবসা করা যাবে না।
গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোবাকো সার্ভে (গ্যাট্স)-এর ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। তাদের মধ্যে ধূমপায়ী ১৮ শতাংশ (১ কোটি ৯২ লাখ) এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী ২০.৬ শতাংশ (২ কোটি ২০ লাখ)। বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে তামাকে আসক্তি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ১৩-১৫ বছর বয়সী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯.২ শতাংশ (সূত্র: এঝঐঝ, ২০১৪)।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ : এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। একই সময়ে তামাকখাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয় ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের চেয়ে তামাক ব্যবহারে অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বেশি।
এসব গবেষণা আমাদের একটি কথাই জানান দিচ্ছে, যেকোন মূল্যে তামাকপণ্যের ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। একটি দেশে তামাকের ব্যবহার কমানোর একটি কার্যকর উপায় হলো তামাকের পণ্যের দাম বৃদ্ধি। আর তামাকপণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন কার্যকর- ‘কর ব্যবস্থা’। দেশের বর্তমান তামাক কর-কাঠামোর দিকে তাকালে দেখা যায়, এটি অত্যন্ত জটিল এবং তামাক ব্যবহারে নিরুৎসাহিতকরণের জন্য যথেষ্ট নয়। কেননা, সিগারেটের ওপর করারোপের ক্ষেত্রে বর্তমানে বহুস্তরবিশিষ্ট এডভ্যালোরেম (মূল্যের শতকরা হার) প্রথা কার্যকর রয়েছে, যা বিশ্বের মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি দেশে চালু আছে।
একাধিক মূল্যস্তর এবং বিভিন্ন দামে তামাকপণ্য ক্রয়ের সুযোগ থাকায় তামাকের ব্যবহার হ্রাসে কর ও মূল্যপদক্ষেপ সঠিকভাবে কাজ করে না। পাশাপাশি তামাক কোম্পানিগুলোও উচ্চস্তরের সিগারেট নি¤œস্তরে ঘোষণা দিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের তথ্যমতে, পৃথিবীতে যেসব দেশে সিগারেটের মূল্য অত্যন্ত কম তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। আমাদের দেশে বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাক সিগারেটের চেয়ে বেশি সস্তা। ‘গ্যাট্স’-২০১৭ অনুযায়ী, ২০০৯-এর তুলনায় ২০১৭ সালে সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লক্ষ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ সিগারেটের প্রকৃত মূল্য ক্রমশ হ্রাস পাওয়ায় সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
অতএব, শুধু তামাকের কর বৃদ্ধি করলেই হবে না, তামাকের ব্যবহার কমাতে কিছু সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে তামাকের কর-কাঠামোতে। আসন্ন ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিতব্য বাজেটে তামাক পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে আনতে তাই কিছু সুপারিশ করেছে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা। সেগুলো হলো, তামাকপণ্যের সহজলভ্যতা কমিয়ে আনতে মূল্যস্ফীতি এবং আয় বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক নিয়মিতভাবে বাড়ানো, বিভিন্ন তামাকপণ্য ও ব্রান্ডের মধ্যে সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য ব্যবধান কমিয়ে আনার মাধ্যমে তামাক ব্যবহারকারীর ব্রান্ড ও তামাকপণ্য পরিবর্তনের সুযোগ সীমিত করা, সকল ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য উৎপাদনকারীকে সরকারের করজালের আওতায় নিয়ে আসা, পর্যায়ক্রমে সকল তামাকপণ্য অভিন্ন পরিমাণে (শলাকা সংখ্যা এবং ওজন) প্যাকেট বা কৌটায় বাজারজাত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা, একটি সহজ এবং কার্যকর তামাক কর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন (৫ বছর মেয়াদি) করা, সকল প্রকার ই-সিগারেট এবং হিটেড (আইকিউওএস) তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি এবং বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা এবং স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বৃদ্ধি (২%) করা।
এসব প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে প্রায় ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী (১.৩ মিলিয়ন সিগারেট ধূমপায়ী এবং ১.৯ মিলিয়ন বিড়ি ধূমপায়ী) ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সিগারেটের ব্যবহার ১৪ শতাংশ থেকে কমে প্রায় ১২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বিড়ির ব্যবহার ৫ শতাংশ থেকে কমে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ হবে। দীর্ঘমেয়াদে ১ মিলিয়ন বর্তমান ধূমপায়ীর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে এবং ৬ হাজার ৬৮০ কোটি থেকে ১১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার মধ্যে (জিডিপি’র ০.৪ শতাংশ পর্যন্ত) অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে।
শুধু তাই নয়, তামাকপণ্যের দাম কার্যকরভাবে বাড়ানো হলে, যারা নতুন করে তামাক ব্যবহার শুরু করতে চায় তারাও নিরুৎসাহিত হবে। এছাড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে তামাক ব্যবহারের ক্ষতি থেকে সুরক্ষা করা সম্ভব হবে। তামাক ব্যবাহারকারীদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আনতে, তাই, এ পদক্ষেপ নেওয়া অতীব জরুরি। আমাদের প্রত্যাশা, জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৯-২০ অর্থ-বছরের বাজেটে তামাকজাত পণ্যের উপর কার্যকর ও বর্ধিত হারে ‘কর আরোপে’ জন্য প্রস্তাবিত সুপারিশসমূহ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল।

লেখক : মিডিয়া ম্যানাজার, ইপসা

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট