চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নৈতিক অবক্ষয় ও আমাদের রাজনীতি

লায়ন এ কে জাহেদ চৌধুরী

৩০ এপ্রিল, ২০১৯ | ১:০৮ পূর্বাহ্ণ

বিদেশে ভ্রমণসহ নানা ব্যস্ততার কারণে কিছুদিন আমার সুহৃদ ও পাঠকবৃন্দকে কোন লিখা উপহার দিতে পারি নাই। সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা আামাকে বারে বারে নাড়া দিচ্ছে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কলম ধরতে। মাঝে মাঝে মনে হয় এসব লিখে আর কি লাভ? পরক্ষণে চিন্তা করি আমার লিখার মাধ্যমে যদি অন্তত: একজন মানুষকেও পরিবর্তনের ভাবনায় আনতে পারি, সেটাই হবে আমার সার্থকতা। এর মাধ্যমেই হয়ত সামাজিক ও নাগরিক দায়বদ্ধতার ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করা যাবে।
কিছুদিন যাবৎ লক্ষ্য করছি মানুষের মধ্যে নৈতিকতা ও মানবতা বোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। উদ্বেগের বিষয় হল, এই অবক্ষয় বেশী পরিলক্ষিত হচ্ছে স্কুল শিক্ষক, মাদ্রাসা শিক্ষক, কলেজ শিক্ষকসহ – সমাজকে যারা শুদ্ধ পথে পরিচালিত করবে তাদের মধ্যে। যে কারিগর ঘর তৈরী করবে সেই কারিগর যদি বিকলাঙ্গ হয়, তাহলে সেই ঘরও হবে নড়বড়ে। শিক্ষক সমাজকে মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয় এবং সমাজের সকলেই শিক্ষক সমাজকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকে। কিন্তু শিক্ষক নামের কিছু কুলাঙ্গারের দ্বারা সংঘটিত সাম্প্রতিক কালের কিছু ঘটনা পুরো সমাজের জন্য লজ্জা হয়ে উঠেছে। যদিও গুটি কয়েক শিক্ষক নামের নরপশুদের জন্য পুরো শিক্ষক সমাজকে দায়ী করা কোন ভাবেই সমীচিন হবে না।
সাম্প্রতিক কালের ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সবচাইতে আলোচিত ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হল ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত হত্যাকা-। সোনাগাজী থানার ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস, এম সিরাজুদৌল্লাহ-এর লোলুপ দৃষ্টি নুসরাতের উপর পতিত হলে নুসরাত তার প্রতিবাদ করে। শুধু তাই নয় সাহসিকতার সাথে থানায় মামলাও করে। যার পরিণতিতে জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে লম্পট সিরাজুদৌল্লাহ ও তার দলবল পরিকল্পিত ও নৃশংসভাবে আগুনে পুড়িয়ে নুসরাতকে হত্যা করে। নুসরাত হত্যার প্রতিবাদে দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ রাস্তায় নামে। নুসরাত হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঐ মাদ্রাসা শিক্ষকের অপকর্মের আরো অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বের করে আনে। শুধু তাই নয়, বের হয়ে আসে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের চাঞ্চল্যকর তথ্য। ঘটনার ইতিবৃত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ঐ এলাকার কিছু সমাজপতি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আশ্রয় ও প্রশ্রয় পেয়ে অধ্যক্ষ সিরাজুদ্দৌল্লাহ সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার অনেক ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করেছে, যা এতদিন অপ্রকাশ্যই ছিল। নুসরাত বলিদানের মাধ্যমে সবকিছু বেরিয়ে এসেছে। নুসরাতের সাহসী ভূমিকার জন্য তাকে শতবার স্যালুট জানাই। এক নুসরাতের আত্মাহুতি শত নুসরাতকে ‘মানব’ নামের কলঙ্কিত দানবের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
বর্তমানে সমাজে যত রকমের অন্যায়, অবিচার ও অনৈতিক কার্মকা- ঘটে চলেছে এসবের পিছনে কোন না কোন প্রভাবশালী মহলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রশ্রয় বা ইন্ধন রয়েছে বলে প্রতীয়মান। নুসরাত হত্যাকা- তদন্তে দেখা যায় স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দায়িত্বরত পুলিশের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে ও আশ্রয়ে অধ্যক্ষ সিরাজুদ্দোলা দোর্দ- প্রতাপে দীর্ঘদিন ধরে অনৈতিক কাজগুলো করে এসেছে। ইতোমধ্যে পুলিশ নুসরাত হত্যাকা-ের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সোনাগাজী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতিকে গ্রেফতার করেছে। তাছাড়া, আরও কয়েকজনকেও গ্রেফতার করেছে যাদের রাজনৈতিক পরিচয় মিলেছে।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ছোট্ট ভূখ-টিতে অনেক হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজের ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে যা মিডিয়া পর্যন্ত পৌছায় না বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী বা পুলিশের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে এধরনের অপকর্মগুলো ঢাকা পড়ে যায়। এক্ষেত্রে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা বা অনৈতিক কর্মকা- প্রতিরোধে সরকার বা দলীয় হাইকমান্ডের কার্যকারী ভূমিকা প্রয়োজন বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করেন। তা নাহলে, লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশটি অকার্যকর শাসনব্যবস্থা উদাহরণে পরিণত হবে। পাশাপাশি দেশের ছাত্রসমাজ, যুব সমাজ, পেশাজীবীসহ সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সম্মিলিত ভাবে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড-এর তথ্যমতে ২০১৮ সালে দেশে ৯৪২টি ধর্ষণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। তন্মধ্যে ধর্ষণপূর্বক হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৬৩টি। এছাড়াও যৌন নির্যাতন সংঘটিত হয়েছে ১৪৬টি। এতসব ঘটনা ঘটলেও ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া পর্যন্ত সব ঘটনা পৌঁছায় নাই। ফলে, দেশের মানুষও সব ঘটনা জানতে পারে নাই আইনানুগ প্রতিকারও মিলে নাই। আরও উল্লেখ্য যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে এধরনের জঘন্যতম ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয় বা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বা স্থানীয় প্রভাব প্রতিপত্তিকে ব্যবহার করা হয়।
সুতরাং দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা পূর্বক এধরনের অপকর্মে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতীব জরুরী বলে সমাজের সচেতন মহল মনে করেন। প্রয়োজন ধর্ষণের শাস্তি সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রয়োগ করে উদাহরণ সৃষ্টি করা। যাতে, ধর্ষককূল আতঙ্কিত হয়ে নিজেদের নিবৃত্ত করতে আত্মশাসনের পথ গ্রহণ করে।

লেখক : কলামিষ্ট ও মানবাধিকার কর্মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট