চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরী পটিয়ার আলোকিত বাতিঘর

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী সহকারী সম্পাদক, দৈনিক পূর্বকোণ

২৯ এপ্রিল, ২০১৯ | ১:৫২ পূর্বাহ্ণ

একসময় পটিয়ায় বড়ো ডাক্তার বলতে যাঁকে মনে করা হতো, তাঁর নাম ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরী। বড়ো ডাক্তার এ কারণে যে, তিনি কলকাতা মেডিক্যাল থেকে এমবি পাস করা ডাক্তার। ১৯৫৭ সালে তিনি যখন পটিয়ায় প্র্যাকটিস শুরু করেন, তখন মাত্র দু’জন ডাক্তার অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা করতেন। একজন ডা. হাবিবুল ওয়াহেদ, অপরজন ডা. কামালউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। কিন্তু এমবি ডাক্তার তিনিই প্রথম। এমবি ডাক্তার হিসেবে রেঙ্গুন, কলকাতা এবং চট্টগ্রাম শহরে প্র্যাকটিস করতে পারতেন তিনি। কিন্তু গ্রামের সাধারণ মানুষ যারা শহরে এসে ভালো ডাক্তার দেখাতে পারেন না, আবার গ্রামে যদি ভালো ডাক্তার থেকেও থাকে তাঁর ফি বেশি। সুতরাং তাদেরকে বিনা চিকিৎসায় রোগে-শোকে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়।
বাঙলা মায়ের এই পল্লী সন্তানদেরকে চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য ডাক্তার চৌধুরী গ্রামে চলে আসলেন। প্রকৃত জনদরদী চিকিৎসক ছিলেন তিনি। চিকিৎসা শাস্ত্রে পিএইচডি করার জন্য তিনি দিল্লি গিয়েছিলেন। কিন্তু দিল্লির ভারত-বিখ্যাত অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এ পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি কোর্সে অধ্যয়নরত অবস্থায় একদিন গ্রাম থেকে মায়ের চিঠি পেলেন প্রিয়দর্শন চৌধুরী। মা লিখেছিলেন, দিল্লিতে যতটুকু পড়ার পড়েছ, এবার তোমার গ্রামে ফিরে এসো। তোমাকে এমবি পড়িয়েছি গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করার জন্য। মাতৃভক্ত প্রিয়দর্শনও মাতৃআজ্ঞা পেয়ে তা’ পালনের জন্য অবিলম্বে দিল্লির পড়াশোনার পাট চুকিয়ে স্বগ্রাম বাকখালী চলে এসেছিলেন। পটিয়ার চেম্বারে বসে প্রায় অর্ধশত বছর পটিয়ার মানুষের চিকিৎসা করেছেন তিনি। ধনী-গরীব, ছোট-বড়, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, নারী-শিশু বৃদ্ধ নরনারী সকলেই তাঁর রোগী।
ডাক্তার প্রিয়দর্শন চৌধুরীর হাতযশ ছিলো। তাঁর ওষুধে রোগীরা ভালো হয়ে যেতো। সেজন্য পটিয়া সদরের খাস মহাল এলাকায় তাঁর চেম্বারটিতে রোগীর ভিড় লেগে থাকতো। তাঁর ফি একটা নির্ধারিত ছিলো। কিন্তু সেজন্য কড়াকড়ি ছিলো না। কেউ কম দিলেও নিতেন, না দিলেও কাউকে না দেখে ফিরিয়ে দিতেন না। একারণে তিনি লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।
শুধু যশস্বী চিকিৎসক নন, ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরী পটিয়া শহরের একটি উজ্বল আলোকস্তম্ভস্বরূপ ছিলেন। পটিয়ার সমাজ সংগঠনের যেমন তিনি ছিলেন মাথা, তেমনি তাঁকে পটিয়ার সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধূলা প্রভৃতি সৃজনশীল কর্মযজ্ঞের প্রাণপুরুষ বা পথিকৃৎ বললেও অত্যুক্তি হয় না। চিকিৎসার মতো গদ্যময় নীরস শাস্ত্র যাঁর অধ্যয়ন, গবেষণা ও চর্চার বিষয়বস্তু ছিলো, তাঁর মধ্যে কিভাবে এত প্রাণশক্তি, রস, উদ্যম, স্পৃহা লুকিয়ে থাকতো, যাঁরা তাঁকে দেখেন নি, তাঁদের পক্ষে তা’ বিশ্বাস করা মুস্কিল। নাট্যাভিনয়ে, নৃত্যানুষ্ঠানে, গানের জলসায়, সাহিত্য আড্ডায়, দাশর্নিক আলোচনায় ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরীর উপস্থিতি ছিলো অনিবার্য। খেলাধূলার সংগঠক যেমন ছিলেন, তেমনি ফুটবল খেলায় বাঁশি নিয়ে রেফারিগিরি করতেও যেতেন। পটিয়া ক্লাব ও পটিয়া অফিসার্স ক্লাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। দুটি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কাজে তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থিতি ছিলো অপরিহার্য।
মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, হিন্দি ও বর্মী ভাষাতেও তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তাঁর তীক্ষ্ম মেধা, সুগভীর জ্ঞান ও পা-িত্যের জন্য তাঁকে ‘চলমান বিশ্বকোষ’ মনে করা হতো। ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরী ১৯২১ সালে পটিয়া থানার বাকখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বরদা চরণ চৌধুরী বড়–য়া বার্মার একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি রেঙ্গুন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিন্দুবাসিনী বড়–য়া। পিতামহের নাম রাজচন্দ্র, প্রপিতামহ লোকমান জমিদার, প্রপিতামহের পিতা উদয়চাঁদ জমিদার। ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরী ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশিষ্ট নায়ক, জ্ঞানতাপস পটিয়া থানার সতরপেটুয়া গ্রামের অধিবাসী অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ বড়–য়ার কন্যা শালীনতা চৌধুরীর পাণি গ্রহণ করেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনের একট অনন্যসাধারণ ঘটনা, যার সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন আর একটি ঘটনা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস খুঁজলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আপামর বাঙালির ন্যায় ডা. চৌধুরীও এই ঘটনার দ্বারা আন্দোলিত হয়েছিলেন এবং যুদ্ধে তাঁর পক্ষে সম্ভব সব কিছু দিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্থানীয় যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেছেন তিনি, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে খবর বিনিময় করতেন, পাক-বাহিনী ও দালালদের গতিবিধি সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আগাম সর্তকবার্তা পৌঁছে দিতেন। এদিকে থেকে বিচার করলে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের একজন বিশিষ্ট সংগঠক রূপে চিহ্নিত করা চলে। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দান, ওষুধ, খাবার ও অন্যান্য রসদপত্র সরবরাহ করা-এসব কাজ যিনি মুক্তিযুদ্ধের আরম্ভ থেকে বিজয় পর্যন্ত ক্লান্তিহীনভাবে করে গেছেন, তিনি অবশ্যই একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে প্রতিরোদ যুদ্ধ চলাকালে কালুরঘাট যুদ্ধে আহত ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরীকে পটিয়া আনা হলে প্রাথমিকভাবে তাঁর শরীরে অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসা প্রিয়দর্শন বাবুই করেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট