চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সম্পাদকীয়

করোনা প্রতিরোধে চাই সম্মিলিত উদ্যোগ

১২ মার্চ, ২০২০ | ৩:০১ পূর্বাহ্ণ

করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সারাবিশে^। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের বাইরে ১৭ গুণ দ্রুতগতিতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। গতকাল পর্যন্ত ১২০টি দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবর এসেছে গণমাধ্যমে। বিশ্বব্যাপী করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ১৯ হাজার। মৃত্যু হয়েছে ৪ হাজার ২৭০ জনের। বাংলাদেশেও আক্রান্ত হয়েছেন তিন জন। এই ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক না থাকায় বিশ্বের সর্বত্র দেখা দিয়েছে ব্যাপক উদ্বেগ, শংকা ও আতংক। তবে আতঙ্কিত না হয়ে সুচিন্তিত উপায়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হলে মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় আক্রান্ত মানেই মৃত্যু নয়। প্রতিরোধ ও প্রতিকারে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ থাকলে করোনার ছোবল থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। পরিসংখ্যান বলছে, করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ২ শতাংশেরও কম। আক্রান্ত ৯৮ ভাগেরও বেশি রোগী সুস্থ হয়েছেন। হাসপাতালে যাননি কিংবা শনাক্ত হননি করোনায় আক্রান্ত এমন অনেকেও রয়েছে। তাই শঙ্কিত না হয়ে সতর্ক-সাবধান থাকাই শ্রেয়।
রোববার সরকারের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে তিনজন আক্রান্ত হওয়ার কথা বলেছে। এর মধ্য দিয়ে করোনা আক্রান্ত শতাধিক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের নামও যুক্ত হলো। উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসকে বিশ্বের এক নম্বর শত্রু হিসাবে চিহিৃত করে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনা ভাইরাসে আরো বিপুল সংখ্যক মানুষের আক্রান্ত ও অনেকের মৃত্যুর আশংকা রয়েছে। অভাবিত মানবিক ক্ষতির পাশাপাশি অভূতপূর্ব আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে এই অভিশপ্ত করোনাভাইরাস। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, করোনার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির ৭ হাজার ৭০০ কোটি থেকে ৩৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হতে পারে। অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড ইকোনমিকস তাদের পূর্বাভাসে বলেছে, করোনা ভাইরাস এশিয়ার বাইরে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বঅর্থনীতির ক্ষতি হবে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি (১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন) ডলারের, যা বিশ্বের মোট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ১ দশমিক ৩ শতাংশ। করোনাভাইরাস সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ দিকে গেলে বাংলাদেশ ৩০২ কোটি ১০ লাখ ডলার পর্যন্ত অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এডিবির পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, বিশ্ববাসী সবচেয়ে ভালোভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ সামাল দিতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে ৮০ লাখ ডলার। আর মোটামুটি ভালোভাবে অর্থাৎ সংক্রমণ তীব্র হওয়ার তিন মাসের মাথায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা গেলে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে এক কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা জিডিপির দশমিক ০১ শতাংশ। পর্যটন, ভ্রমণ, বাণিজ্য ও উৎপাদনব্যবস্থায় ধাক্কা, অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাস, সরবরাহ ব্যাহত ও স্বাস্থ্যগত প্রভাবে এই ক্ষতি হবে। তবে অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রা কী হবে তা নির্ভর করছে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কতটা বিস্তৃত হবে তার ওপর, যা এখনো খুবই অনিশ্চিত।
গত ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনা সংক্রমণের পর বাংলাদেশেও এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশজুড়ে এই ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চলছিল। অবশেষে দেশে তিনজন করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছে বলে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হলো। আক্রান্তদের মধ্যে দু’জন সম্প্রতি ইতালির দুটি শহর থেকে দেশে ফিরেছেন। তাদের একজনের সংস্পর্শে আসায় পরিবারের অন্য এক সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। এ অবস্থায় ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। তবে সবাই সতর্ক-সাবধান থাকলে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকবে না। ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার, গণপরিবহন এড়িয়ে চলা, প্রচুর ফলের রস এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা, ঘরে ফিরে সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নেয়া, কিছু খাওয়া কিংবা রান্নার আগে ভালো করে হাত ধুয়ে নেয়া, ডিম কিংবা মাংস রান্না করার আগে ভালোভাবে সিদ্ধ করা, ময়লা কাপড় দ্রুত ধুয়ে ফেলা, নিয়মিত ঘর এবং কাজের জায়গা পরিস্কার রাখা এবং অপ্রয়োজনে ঘরের দরজা-জানালা খুলে না রাখাসহ কিছু স্বাস্থ্যবিধি মানলে করোনার সংক্রমণ ঠেকানো সহজ হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে একগুচ্ছ পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে সরকার। এ ক্ষেত্রে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে করোনা মোকাবিলা কঠিন হবে না।
মনে রাখতে হবে, নানামাত্রিক প্রচেষ্টার পরও করোনাভাইরাসের কোনো টিকা বা ভ্যাকসিন এখনো তৈরি হয়নি। ফলে এমন কোনো চিকিৎসা এখনও মানুষের জানা নেই, যা এ রোগ ঠেকাতে পারে। এ অবস্থায় সতর্কতাই রোগটি থেকে নিরাপদ থাকার একমাত্র উপায়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাহস ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারলে করোনার বিস্তার ঠেকানো কঠিন হবে না। একইসঙ্গে করোনাভাইরাসের বৈশি^ক বিস্তারের কারণে অর্থনীতি মন্দার ধাক্কা সামলানো এবং তা কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারেও বাংলাদেশকে প্রস্তুত ও দৃঢ় থাকতে হবে। দেশের নিত্যপণ্যের বাজারে যাতে করোনার প্রভাব না পড়ে, সেদিকেও খেযাল রাখতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট