চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চিকিৎসা শ্রমিকের দিনলিপি

চিকিৎসকদের পেশা পরিবর্তন

ডা. হাসান শহীদুল আলম

১১ মার্চ, ২০২০ | ২:০৯ পূর্বাহ্ণ

পর্ব ৩। মাঘের শেষ সপ্তাহ। ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। পটিয়াস্থ চেম্বার। লেখা হচ্ছিলো চিকিৎসকদের পেশা পরিবর্তনের কারণসমূহের পর্যালোচনা। গেলো বারের ধারাবাহিকতায় আজ লিখছি। খ) আন্তঃ ক্যাডার বৈষম্য অর্থাৎ অন্যান্য বিসিএস ক্যাডারের তুলনায় বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার এর প্রতি বৈষম্যমূলক বিধি আরোপ।
১) বেতন কাঠামোতে বৈষম্য : স্বাস্থ্যক্যাডারসহ বিভিন্ন ক্যাডারকে বঞ্চিত করে আমলাদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে অষ্টম বেতন কাঠামো বা পে স্কেল কার্যকরী করা হয়েছে। এতে সিলেকশান গ্রেড বাতিল করে অন্য সব ক্যাডারের শীর্ষস্থানীয় পদসমূহ থেকে স্ব স্ব ক্যাডারধারীদের সরিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের জায়গা করা হয়েছে। এর ফলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক পদটিতে আর হয়তো কোন চিকিৎসক নিয়োগ পেতে পারবেন না ভবিষ্যতে। কারণ পদটি ২য় গ্রেডের।
আর সিলেকশান গ্রেড এবং টাইম স্কেল না পেলে চিকিৎসকরা হয়তো ২য় গ্রেডে উন্নীতই হতে পারবেন না। প্রশাসনসহ অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা সহজেই পদোন্নতি পেয়ে দ্রুততম সময়ে বড় কর্মকর্তা বনে যান। সদ্য ঘোষিত পে-স্কেল-এ সর্বোচ্চ গ্রেড ১ এবং ২ শুধুমাত্র আমলাদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। অন্য ক্যাডারের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও সিনিয়র সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব নামে আরো দুটি স্কেল শুধু আমলাদের জন্য আগেই নির্ধারিত করা হয়েছে। স্বাস্থ্যক্যাডারের অধ্যাপকগণ গ্রেড ৩ অনুযায়ী বেতন ভাতা ও সুবিধা পান। সিলেকশন গ্রেড পেলে তারা গ্রেড-২ এ উন্নীত হতে পারতেন। কিন্তু সিলেকশান গ্রেড বাতিল হওয়ায় তাঁদের গ্রেডের উন্নতি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এ ব্যাপারটা যতোটা না আর্থিক তার চেয়েও বেশী অবমাননাকর। অতএব স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক পদে সচিবালয় থেকে কোন অতিরিক্ত সচিব আমদানী করা হবে। একজন চিকিৎসক অধ্যাপক হয়েও যেহেতু যুগ্মসচিব এর পদমর্যাদায় চাকুরী করবেন, তিনি অচিকিৎসক মহাপরিচালক এর অধীনে থাকবেন।
২) চিকিৎসকদের জন্য টাইম স্কেল ও সিলেকশান গ্রেড এর প্রভিশন না থাকা :
৩) একজন উপসচিব যখন গাড়ী কেনার সরকারী ঋণ পাচ্ছেন ৩০ লাখ টাকা। সাথে মাসে রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ আরও ৫০,০০০ টাকা নগদ, তখন একজন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ কি পাচ্ছেন? সবচেয়ে মেধাবী হয়েও সরকারী ডাক্তারগণ এই রাষ্ট্রের সবচেয়ে কম সুযোগ সুবিধাসম্পন্ন চাকুরী করে থাকেন। দাপ্তরিক আমলাতন্ত্র যখন একটি রাষ্ট্রের ক্ষমতা, মর্যাদা আর সুযোগ সুবিধার স্থায়ী কেন্দ্র হয়ে যায়, তখন সমাজের মেধাবী মানুষগুলোর একটা বিরাট অংশ যথাযথ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মূল্যায়ন পান না। বছরকয়েক আগে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ উল্লেখযোগ্য। ‘মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি বলেছেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দিয়ে সব কাজ করানো যায়। ফলে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা একটু বেশীই পাবেন, এটাই স্বাভাবিক।’ (যুগান্তর, ৩০-৬-১৮)। বস্তুতঃ আমলানির্ভর শাসনব্যবস্থায় আমলাদের প্রতি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নীতি নির্ধারণী মহলের মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ যেভাবে হওয়া উচিৎ উল্লিখিত তথ্যে সেটাই প্রকাশিত হয়েছিলো। বিসিএস স্বাস্থ্যক্যাডারের উপর বৈষম্যমূলক ধারা আরোপিত হতে দেখে সেজন্য আমলাতন্ত্রকে দায়ী করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শেখ আদনান ফাহাদ বলেছিলেন, “বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের কোন কোন অংশ আজ এতোটাই আধিপত্যবাদী হয়ে উঠেছে যে, স্বাস্থ্যের মতো মহা গুরুপূর্ণ খাতেও নানা খুঁত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সবচেয়ে মেধাবী পেশাগত শ্রেণি হওয়া সত্ত্বেও এদেশের সরকারী ডাক্তারগণ এই রাষ্ট্রের সবচেয়ে কম সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন চাকুরী করে থাকেন (মেডিভয়েস, ২২-১১-১৮)।” ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, যে সিস্টেমে আজকে আমরা দেখি, সেই বৃটিশ কলোনিয়াল সিস্টেমে, এতে দেশের মঙ্গল হতে পারে না। সেই এডমিনিস্ট্রেশান, সেই আইন, সেই সবকিছু পরিবর্তন করার নামই বিপ্লব।” ১৯৭৫ থেকে ২০২০, আমলাতন্ত্রের পরিবর্তন আমরা করতে পারিনি। বিপ্লবী হওয়া দূরে থাক্, আমাদেরকে আপোষকামী হতে বাধ্য করা হয়েছে। আর আপোষ করতে গিয়ে আমরা দিন দিন ভীরু ও কাপুরুষ জাতিতে পরিণত হয়েছি।
গ) প্রশাসন, পুলিশ, জুডিশিয়ারী, ভূমি ইত্যাদি ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ ক্ষমতার গর্বে সুযোগ পেলেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে অহেতুক চিকিৎসকদের হেস্তনেস্ত করতে থাকেন জনগণের কাছে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য।
১) “পাবনা সদর হাসপাতালের দক্ষ ও রোগীবান্ধব সহকারী পরিচালক ডা. মাঞ্জুরা রহমান মিটিং এ বসেছেন অন্য চিকিৎসক সহকর্মীদের নিয়ে নতুন ইন্টার্ন চিকিৎসকদের আগমণ উপলক্ষে। সে সময় উনার ল্যান্ডফোনে একজন ফোন করে বলেন, স্যার অসুস্থ। ডাক্তার পাঠান। উনি বললেন, ভালভাবে শুনতে পাচ্ছি না, কোন স্যার অসুস্থ আর আপনি কে বলছেন? ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভদ্রলোক বললেন, আমি পিএস বলছি, স্যার অসুস্থ। তখন ডা. মানজুরা বললেন, আপনার ঠিকানা বলেন, আর রোগী বেশী অসুস্থ হলে আমরা এ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিচ্ছি। হাসপাতালে অক্সিজেনসহ সব ব্যবস্থা আছে, আপনারা তাড়াতাড়ি রোগী নিয়ে আসেন। তখনই ডা. মানজুরা ফোনের অপর প্রান্তে একটি তাচ্ছিল্যের হাসি শুনতে পেলেন। সেই হাসির মর্ম হলো, স্যার হাসপাতালে যাবে? ফোন রাখার পর ডা. মানজুরা এর সহকর্মীরা জানতে চান, কার ফোন ছিলো? উনি বললেন, আমি তো বুঝলাম না কোন স্যার অসুস্থ। শুধু বললো, স্যার অসুস্থ ডাক্তার পাঠান। পরের দিন ডা. মানজুরাকে একজন সিনিয়র ফোন দিয়ে জানান, উনাকে ওএসডি করে বদলি করা হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। পরে ডা. মানজুরা একজন সাংবাদিক এর কাছ থেকে জানতে পারেন সেই অসুস্থ স্যার ছিলেন পাবনার তৎকালীন ডিসি। তাকে বাসায় দেখতে না যাওয়াতে ডিসি ক্ষিপ্ত হয়ে উনার ক্ষমতা জাহির করলেন। এক রাতেই পাবনা থেকে ঢাকায় বদলী (আই নিউজ, ১৮-১০-১৭)।”
২) “প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজের লেকচারার ডা. রাফিউল মিরাজ উনার বন্ধুদের সাথে জয়ন্তিকা ট্রেনে সিলেট আসছিলেন। প্রচন্ড গরমে ঘেমে সবাই অস্থির ছিলেন। মনতলা স্ট্রেশনে ট্রেন থামতেই জ¦লন্ত সিগারেট নিয়ে ট্রেনে উঠে ফুঁকতে থাকেন একজন। প্রচ- গরমের ভিতর সিগারেটের ধোঁয়া অসহনীয় লাগায় ডা. রাফিউল সেই ব্যক্তিকে ধূমপান না করতে অনুরোধ জানান। ধূমপায়ী সেই লোকটা কথা না শুনে উদ্যত ভঙ্গিতে বললেন, আমারে চিনোস? দাঁড়া সামনের স্টেশনে তোদের সব কয়টারে বানামু। ‘ট্রেন শায়েস্তা গঞ্জ স্টেশনে থামলে সেই ধূমপায়ী লোকের ডাকে ২০-২৫ জন ট্রেনে উঠে ডা. রাফিউল সিরাজ ও তার বন্ধুদের টেনে হিঁচড়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে মারধর করে। সেই ধূমপায়ী ব্যক্তি ছিলেন মৌলভীবাজার সদরের এসি ল্যা- সুনজিত কুমার চন্দ। তাঁকে ট্রেনে ধূমপানে বাধা দেয়ায় উনার ভেতর প্রবল ক্রোধ জন্ম নেয় এবং উনি শায়েস্তাগঞ্জ থানার এস আই টুটলকে নিয়ে উনার ক্ষমতার কিছুটা দেখিয়ে দিলেন ডা. রাফিউল সিরাজ ও তার বন্ধুদেরকে (আই নিউজ ২১-৬-১৯)।”
৩) “দুপুরের দিকে বাগাতিপাড়া থানার ওসি মোবাইল ফোনে জনৈক মেডিকেল অফিসারের কাছে জানতে চান তাঁরা কি রিপোর্ট দিয়েছেন, ধর্ষণ নাকি ধর্ষণ চেষ্টা? ঐ সময় উক্ত মেডিকেল অফিসার তাঁকে জানান, তিনি ঐ মুহূর্তে দায়িত্বে নেই। তিনি হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সঙ্গে সরকারী নাম্বারে কথা বলার পরামর্শ দেন। কিন্তু ওসি ফোন না কেটে বরং ঐ চিকিৎসকের সঙ্গেই উচ্চবাচ্য করতে থাকেন। এক পর্যায়ে উত্তেজিত ওসি ঐ চিকিৎসককে মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার হুমকি দেন।
এ ফোনালাপটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ওসির আচরণে সকলেই সোচ্চার হয়ে উঠেন। চিকিৎসকদের মতে, কথোপকথন জুড়ে ওসি-এর অভিব্যক্তি ছিলো ঔদ্ধত্যপূর্ণ, অশোভনীয় এবং ভদ্রতা বিবর্জিত। বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রজাতন্ত্রের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। অপরদিকে নন ক্যাডার কর্মকর্তা ওসি দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হন। তাই ওসির পক্ষ থেকে এমনি আচরণ সরকারী কর্মচারী (শৃংখলা ও আপীল) বিধিমালা ১৯৮৫ এর সুস্পষ্ট লংঘন (ডাক্তার প্রতিদিন, ২২-০২-১৯)।”
উল্লিখিত সংবাদচিত্র তিনটি কিছুটা বিশ্লেষণের দাবী রাখে। সংকটাপন্ন রোগীর চিকিৎসা হাসপাতালে হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় এবং এজন্যে দায়িত্বরত চিকিৎসক কর্মকর্তা এ্যাম্বুলেন্স পাঠাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তিনি রোগীর বাসায় গিয়ে কেন ডিসিকে নিজে নিয়ে আসলেন না এবং সেটাই কেন তাঁর অপরাধ হলো সেটা বোধগম্য হচ্ছে না। ধূমপান নিষিদ্ধ এ কথাটা মনে করিয়ে দেয়াটা কেন অপরাধ হবে? থানার ওসি সাহেবকে হাসপাতালের ফোন নাম্বার দিয়ে ঐ নাম্বারে কথা বলতে বলাটা একজন দায়িত্বরত মেডিকেল অফিসারের অপরাধ কেন হবে?
ভদ্রসমাজে আচার-আচরণে পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকাটাই নিয়ম। এটা সমাজের ছোট বড় সকলের জন্য প্রযোজ্য। অশ্রদ্ধা অপমান নিয়ে মানুষ কাজ করতে পারে না। তাই চিকিৎসকদের প্রতি এরূপ অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হলে যে তাঁরাও চিকিৎসা পেশার প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলবেন। অন্যান্য পেশাজীবীদের ক্ষেত্রেও একথাটা খাটে। আর এরূপ হলে সেটা হবে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা এবং জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। পরবর্তী লেখায় এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত থাকছে।

ডা. হাসান শহীদুল আলম ডায়াবেটিস ও চর্মরোগে ¯œাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট