চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

মঙ্গললোকে আনন্দে থাকো

একাত্তরের আলো শান্তনু বিশ্বাস

সুশীল বড়–য়া

১১ মার্চ, ২০২০ | ২:০৮ পূর্বাহ্ণ

বাঙালির বিকাশের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। সেই অষ্টম শতকের পালদের সময় থেকে। পাল রাজত্ব সময়টা ছিল বাংলার ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। রাজা গোপাল ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসক। পাল রাজত্বের আমালেই বাংলা একটি সুনির্দিষ্ট আকার ধারন করে। বাঙালি সংস্কৃতির কাঠামো তৈরী হয় সেই সময়। বাঙালি নামক জনগোষ্ঠী সর্বপ্রথম ছন্দোবন্দ উচ্চারণ ‘চর্যাপদ’ বলে ধরা হয়। পাল রাজত্বের সময়টাই ছিল অতীত বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণযুগ।
দ্বিতীয়তঃ পনের ও ষোল শতকে সুলতানী আমলে বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যাপক উন্মেষ ঘটে। এ সময়ে রাজকীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহৃত হতে দেখি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম অংকুর রোপিত হয় এই সুলতানী আমলে। তারই ধারাবাহিকাতায় আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এবং চৈতন্যদেবের সময় ইসলামী সংস্কৃতি এবং বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে বাঙালির জীবন ধারা ‘জাগরণের’ সূচনা হয়।
পরবর্তীতে ঊনিশ শতকে ইউরোপীয় রেঁনেসার প্রভাবে ঘটে যায় বেঙ্গল রেঁনেসা। যার পথপ্রদর্শক ছিলেন রাজা রাম মোহন রায়, দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর, ডিরোজিও ও তার অনুসারীরা, ঈশ্বর চন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, মাইকেল মধুসুধন দত্ত, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মোশারফ হোসেন প্রমুখ। বেঙ্গল রেনেসা মূলত কলকাতাকেন্দ্রীক বিত্তবান অভিজাত ও উচুঁ শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলার আপামর জনগণের মধ্যে এই রেঁনেসার কোন সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েনি। প্রভাব পড়েনি বৃহত্তম বাঙালি সমাজের মধ্যে। এবং বাঙালি সমাজের ভিত্তিমূলের কোন গ্রহণযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারেনি।
অনেক বৌদ্ধিক গবেষকদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, বাঙালি আর কোনদিন তাদের জাতি সত্ত্বার পরিচয় নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু রবীন্দ্র নাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, ড. শহিদুল্লাহ্রা তাঁদের দর্শন ও সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন বাঙালির সম্ভবনার কথা। ১৯৩৪ সালে বিহার প্রদেশে অনুষ্ঠিত প্রবাসী বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন-‘ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ভারতের অংশ হলেও কার্যত বাংলা ও বাঙালি সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন দেশ এবং ভিন্ন সংস্কৃতির অধিকারী। এর পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতিসত্ত্বার পুর্ণাঙ্গ বিকাশের পর তাদের চিন্তা ভুল প্রমাণিত হয়। বাঙালির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বাঙালীর ‘তৃতীয় বা চতুর্থ জাগরণে” এর পথকে প্রশস্ত করে দিল। এই জাগরণ বাঙালির ভিত্তিমূলে আমূল পরিবর্তন এনে দিল। তাদের মনন সম্পূর্ণ পাল্টে দিল। এক এক নব পরিচিতি, যার মাধ্যমে বাঙালি বিশ্বের যে কোন সম্পূর্ণ জাতির সমতুল্য।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দী গ্রীক সভ্যতা সমগ্র বিশ্বের জন্য সৃষ্টি করেছিল সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টেটল, সফেক্লিশের মতো বিখ্যাত দার্শনিক, নাট্যকার।
অষ্টম শতক বাঙালি ও বাংলা ভাষার ভিত রচনা করেছিলেন লুইফা, কুক্করীপা, বিরুপা, গুন্ডরীপা, চাটিল পা, ভুসুকুপা, কাহ্নপা, শান্তিপা, মহিধরপা, বীনাপা, সরহপা, আর্যদেব, দারিকপা, ধামপা, ভাদেপা প্রমুখ।
ঊনিশ শতকে বেঙ্গল রেঁনেসা সৃষ্টি করেছিল রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও, দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর, অক্ষয় কুমার দত্ত, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসুধন দত্ত, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মীর মোশাররফ হোসেন, কাজী নজরুল ইসলাম, ভাই গিরিশ চন্দ্র, উইলিয়াম কেরী, আলেকজান্ডার গফ, কেশব চন্দ্র সেন, জীবনানন্দ দাশ, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, সুকুমার রায়, জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যন্দ্র নাথ বসু প্রমুখ।
তেমনিভাবে একত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক, প্রফেসর রেহমান সোবহান, ড. রনক জাহান, তালুকদার মনিরুজ্জামান, ড. আহমদ শরীফ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. এমাজউদ্দিন আহমদ, ড. অনুপম সেন, মনির চৌধুরী, ড. মো. ইউনূস, প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম, স্যার ফজলে হোসেন আবেদ, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, শিল্পী রশিদ চৌধুরী, শিল্পী শাহাবুদ্দিন, শিল্লী মনিরুল ইসলাম, ভাস্কর্য্য আবদুল্লাহ খালেদ, শিল্পী কালিদাশ কর্মকার, কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, শহীদ কাদেরী, রফিক আজাদ, আবুল হাসান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, কবি ও উপন্যাসিক সৈয়দ শামসুল হক, তসলিমা নাসরিন প্রমুখ।
বেঙ্গল রেঁনেসার ফসল হলো কলকাতাকেন্দ্রীক ব্যাপক মঞ্চনাটকের বিকাশ। সৃষ্টি হয়েছিল অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়, সম্ভু মিত্র, বিভাস চক্রবর্ত্তী, রুদ্র প্রসাদ সেনগুপ্ত, উৎপল দত্ত, বিনোদনী দাসী, কিরণ বালা, তারা সন্দুরী, শাওলী মিত্রের মত বহু অভিনেতা ও অভিনেত্রী।
তেমনীভাবে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৭২ সাল থেকে ঢাকার বেইলী রোড কেন্দ্রীয় মঞ্চনাটকের মঞ্চায়ন হিড়িক পড়ে যায়। সৃষ্টি হয় বিখ্যাত সব নাট্যগ্রুপ। থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার, নাগরিক, নাট্যচক্র, ড্রামা সার্কেল, পদাতিক, আরণ্যকসহ বিখ্যাত বহু নাট্যদলের জন্ম। শুধু ঢাকায় নয় চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের মফস্বল শহরগুলিতেও বহু নাট্যদলের জন্ম হয়। চট্টগ্রামে ১৯৭২/৭৩ সালে জন্ম হয় থিয়েটার ৭৩, অরিন্দমের মতো নাট্যদল। এই সব দলের বেশীর ভাগ প্রতিষ্ঠাতা হলো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। অরিন্দমের প্রতিষ্ঠাতারা হলেন-সদরুল পাশা, খালেদ নোমান নমি, শিশির দত্ত, শুক্লা সেনগুপ্ত, (ইফতেহার), জয়ন্তী বড়–য়া প্রমুখ। আর থিয়েটার ৭৩ এর প্রতিষ্ঠাতারা হলেন আলতাফ হোসেন জাকারিয়া মামুন, জিয়াউল হাসান কিসলু, আশরাফ বাদল প্রমুখ। এরা সাবই ছিল প্রফেসর মমতাজ উদ্দিনের ছাত্র। পরবর্তীতে আরো বেশকিছু নাট্যদল চট্টগ্রামে জন্ম নেয়। সেগুলো হলা গণায়ন, অঙ্গন, কালপুরুষ, তীর্যক, প্রতিনিধি, কথক থিয়েটার, মঞ্চমুকুট, নান্দিকা, সেইম, কথা সুন্দর।
গণায়ন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন মিলন চৌধুরী ১৯৭৬ সালে। এই উদ্যোগের সাথে সামিল হন সনজিব বড়–য়া, শান্তনু বিশ্বাস, রণজিত রক্ষিত, শিশির সেন, দেবব্রত দেওয়ানজী, মনোতোষ ধর প্রমুখ।
সনজিব বড়–য়া ও শিমুল বড়–য়ার সাথে আমি আগে থেকেই পরিচিত ছিলাম। মিলন চৌধুরীর সাথে পরিচিত হলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ. রহমান হলে। তার বন্ধু আবার আমারও বন্ধু। মিলন চৌধুরী মাঝেমধ্যে এফ. রহমান হলে থাকতেন তার বন্ধুদের সাথে। হলে শিমুল আল সাইফুল্লাহর সঙ্গে মিলন চৌধুরী অবস্থান করতো। দু’জনই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রেনে শহরের যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়। মিলন চৌধুরী হলে অবস্থান করলে গভীর রাত অবধি আড্ডা হতো। আড্ডায় সমকালীন বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন এবং চট্টগ্রামের নাট্যগ্রুপগুলো নিয়ে আলাপ হতো। সেই আলোচনায় সনজিব বড়–য়া, শিমুল বড়–য়া, শান্তনু বিশ্বাস অভিনয় নিয়ে আলোচনা হতো। যদিওবা শান্তনু বিশ্বাসের সাথে আমার কোন পরিচয় ছিল না তখনও।
শান্তনু বিশ্বাসের সাথে আমার পরিচয় নব্বই দশকে কোন এক সময়ে ওআর নিজাম রোডে সিদ্ধার্থ হক ও রূপালী চৌধুরীর বাসায়। এখানে প্রতি শুক্র ও শনিবার আড্ডা হতো। আড্ডায় আসতো ফারুক মঈন উদ্দিন, বিশ্বজিৎ চৌধুরী সহ অনেকে। মাঝে মাঝে এই সব আড্ডায় ঢাকা এবং কলকাতার অনেক নাম করা কবি, সাহিত্যিক, সম্পাদক, অভিনেতা অভিনেত্রীও অংশ নিতো। পরবর্তীতে সিদ্ধার্থ হক ও রূপালী চৌধুরী বাসা পরিবর্তন করে চট্টেশ্বরী রোডের ম্যাকিন্যান হাউসে নিয়ে যায়। আড্ডার স্থানও পরিবর্তন হয়ে যায়। আড্ডার বৈশিষ্ট হলো-পুরো পরিবার নিয়ে আসা হতো। বাচ্চারা তাদের নিয়ে মেতে থাকতো, আর বড়রা আড্ডা আর খানাপিনা নিয়ে মেতে থাকতো। শান্তনু ও শুভ্রা বিশ্বাস তাদের দুই মেয়ে বাবুই, টুই, বিশ্বজিৎ ও সুষ্মিতা চৌধুরী তাদের দুই মেয়ে ফারুক মঈন উদ্দিন-মিনার দুই ছেলে মেয়ে, আমার আর অঞ্জলীর দুই ছেলেও থাকতো। ঢাকা থেকে প্রতি মাসে তুসার দাস পরিবার আড্ডায় অংশ নিতো। আজকে বিস্মিত হচ্ছি ২০০০ সালের সেই পিচ্ছিগুলো সংসার জীবনে প্রবেশ করেছে এবং করছে।
আমি জানতাম না শান্তনু বিশ্বাসের বড় ভাই অতনু বিশ্বাস। সে ১৯৭১ সালে মারা যায়। অতনু বিশ্বাস ছিলো ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম কলেজে আমার সহপাঠী। সেও ছিলো খুবই সাংস্কৃতিক মনা। কোকরানো চুল, হালকা-পাতলা সৌম্য খান্ত চেহরার। ভালো তবলা বাজাতে পারতো। সবার সাথে মিশতে পারতো। অল্প বয়সে ১৯৭১ সালে তার মৃত্যু হলো।
কলেজজীবন থেকে আমার সিনেমা, গান, নাটকের প্রতি বেশ ঝোক ছিল, এখনও আছে। সত্তর সালে যখন কলেজে ভর্তি হলাম, তারপর শুরু হলো আমার রাত ৯ টা থেকে ১২টায় সিনেমা হলে ঢু মারা। কয়েকজন বন্ধু মিলে সিনেমা দেখতে যেতাম। ষাট দশকের শেষে এবং সত্তর দশকে ছিলো বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ। সবগুলো না দেখতে পারলেও এই সময়ের প্রায় সব সিনেমা দেখেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের পর বাহাত্তর সাল গ্রুপ থিয়েটার গুলোর নাটক দেখাও শুরু করি। থিয়েটার ৭৩, অরিন্দমে নাটক দেখা শুরু করি। ঢাকা থেকে প্রতি বছর প্রতিষ্ঠিত নাট্যদলগুলি চট্টগ্রামে এসে নাটক মঞ্চায়ন করতো। কোনটাই বাদ দিতাম না।
পরবর্তীতে চট্টগ্রামে অন্যান্য নাট্য দলগুলোর নাটকও গোগ্রাসে দেখতে থাকি। শান্তনু বিশ্বাসের প্রায় সব নাটক দেখেছি। তার অভিনয়ের বিশ্লেষণ করার স্পর্ধা আমার নাই। তবে সেই পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সম্পূর্ণ একজন অভিনেতা। শান্তনু বিশ্বাস ছিল একজন নাট্যকার, গীতিকার, নাট্যনির্দেশক, অভিনেতা, গায়ক, সুরকার, অনুবাদক, নাট্য পত্রিকা সম্পাদক, সর্বোপরি সে ছিল একজন কর্পোরেট সিও। শান্তনু বিশ্বাসের গান নিয়ে গবেষণার দরকার আছে বলে আমি মনে করি। গানের বাণী সুরের প্রচলিত ধারাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে নতুন ধারার সৃষ্টি করছে তা গবেষণার দাবি রাখে। তার এই নবসৃষ্টির প্রয়াস না শুনলে এবং তার গায়কি ঢং না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
চট্টগ্রাম হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন। অথচ চট্টগ্রামকে কেন্দ্র থেকে নানাভাবে অবহেলা করা হচ্ছে। সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে গুণীদেরকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে চোর, জোচ্চোরদেরকে। অবহেলা করা হচ্ছে সৃষ্টিশীলদেরকে। ৭১ এর রেঁনেসার আলো হচ্ছে শান্তনু বিশ্বাস। তিনি হয়ে উঠবেন আগামী প্রজন্মের আইডল। তার সৃজনশীল সৃষ্টিগুলো আগামী প্রজন্মের জন্য আলোর দিশারী হয়ে থাকবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট