চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মরণ ডা. ফজলুল আমীন

মনোজ কুমার দেব

১০ মার্চ, ২০২০ | ২:৪১ পূর্বাহ্ণ

যাঁরা অসাধারণ তাঁদের চাওয়ার যে বৃত্ত তার পরিধি অনেক বড়। আমরা সাধারণরা ছোট ছোট স্বপ্নের পেছনে ছুটতেই হয়রান হয়ে যাই। আর মহৎ স্বপ্নগুলো অসাধারণকে তাড়া করে নিরন্তর। তাইতো মহৎ স্বপ্নকে লালন করে অসাধারণ মানুষগুলো অন্যের কাছে কিংবদন্তীতে পরিণত হন।
আজ ১০ মার্চ, ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এমনি একজন কিংবদন্তী কৃতিপুরুষের জীবনের গল্প শোনাতে চাই। র্কীর্তিমান এ পুরুষ মরহুম ডা. ফজলুল আমীন। ফিরে তাকাই তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার দিকে।
মা ওমরাও খাতুন আর বাবা মনোয়ার আলী চৌধুরী। বাসস্থানটি ‘হোসেন চৌধুরী বাড়ি’ নামে খ্যাত। এ বাড়িতেই ১৯২১ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে জন্ম হলো ফজলুল-আমীনের। বাবার ছিল খুবই ভালো এক চাকরি ব্রিটিশ সওদাগরি জাহাজ ও.ঋ (ইয়াবতী ফ্লোটিলা) কোম্পানীতে। কিন্তু ফজুলল আমীন যখন হাইস্কুলে উত্তীর্ণ হয়েছেন তখনই ভাগ্য বিড়ম্বিত হন মনোয়ার আলী চৌধুরী। জাহাজের কর্মচারীদের ধর্মঘটের কারণে এবং একটি উপদলের হটকারিতায় চাকুরীচ্যুত হলেন অনেকের সাথে মনোয়ার আলী চৌধুরীও। বার্মা ফেরত হলেন তিনি। দেশে ফিরে আরও বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলেন তিনি। মহাজন প্রসন্ন হোড়ের কূটকৌশলে হারালেন অনেকগুলো জমি।
ফজলুল-আমীন উদয়াস্ত পরিশ্রম করে মুসলিম হাইস্কুলে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুলের একটি ঘটনা ফজলুল আমীনকে অনন্য মর্যাদা দেয়। স্কুলে পরিদর্শক আসবেন। প্রধান শিক্ষক এম.এ সামাদসহ অন্যান্য শিক্ষকরা উদ্বিগ্ন। পরিদর্শক বেশ কয়েকটি ক্লাস ঘুরলেন। কিন্তু মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না। ঢুকলেন ৮ম শ্রেণিতে। বালক ফজলুল আমীনের প্রত্যুৎপন্ন্ উত্তরে খুবই প্রীত হলেন পরিদর্শক। ফজলুল আমীন পেলেন ডাবল প্রোমোশন আর বীরের খ্যাতি। এ পরিবারের আরেকটি বেদনাদায়ক ঘটনা ফজলুল আমীনকে খুবই নাড়া দিয়েছিলো।
মনোয়ার আলী চৌধুরী পিতৃহারা ভাইপো রুহুল আমীনকে নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। বানিয়ে ছিলেন চিকিৎসক। ডা. রুহুল আমীন অকালপ্রয়াত হলে পরিবারটি চিকিৎসকশুন্য হয়ে যায়। ইতোমধ্যে ফজলুল আমীন স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছেন কৃতিত্বের সাথে। ভর্তি হলেন চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে মানবিক বিভাগে। হঠাৎ চোখে পড়ে মেডিকেল স্কুলের ভর্তিবিজ্ঞপ্তি।
একান্ত গোপনে পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হলেন। অর্থের টানাপোড়েনের একটু দ্বিধা থাকলেও ২টি বৃত্তি পেয়ে কোর্স সমাপ্ত করলেন সাফল্যের সাথে। তখন ১৯৪২ সাল। দু’বছর সরকারী চাকুরী করে ১৯৪৪ সাল থেকে নিয়মিত রোগী দেখা শুরু করলেন। অল্পদিনেই খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। রোগ নিরুপনে আধুনিকতা তখনো আসেনি। সহজললভ্য হয়নি সব ওষুধ। তবু ডা. ফজলুল আমীন সফল হলেন তাঁর নিবিড় পর্যবেক্ষণ আর গভীর অন্তর্দৃষ্টির কারণে। কয়েকটি ঘটনাতো তাঁকে রীতিমত কিংবদন্তীর চিকিৎসকে পরিণত করেছিল। ডবলমুরিং থানার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব খান বাহাদূর সাহেব দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হলেন একবার। গঠন করা হলো মেডিকেল বোর্ড। সদস্য হলেন ডা. পূর্ণ দে (এম.বি.বি.এস) আর ডা. বনমালী (এমবিবিএস)। তাঁরাও রোগ নির্ণয়ে সফল হলেন না।
মেডিকেল বোর্ডে অন্তর্ভূক্ত হলেন ডা. ফজলুল আমীন। নিবিড় পর্যবেক্ষণ শেষে মত দিলেন খান বাহাদুর সাহেবের যক্ষা হতে পারে। অন্য দু’জন বিশেষজ্ঞ একমত হলেন না। শেষে রক্ত পরীক্ষায় যক্ষার জীবাণু সনাক্ত হলো।
ডা. ফজলুল আমীনের চিকিৎসায় ভালো হলেন খান বাহাদুর।
চিকিৎসার পাশাপাশি শিক্ষা বিস্তারেও অসামান্য অবদান রেখেছেন তিনি। ১৯৬০ সনের প্রবল ঝড়ে প্রাণহরি একাডেমী সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হলে অর্থ, সাহস, লোকবল দিয়ে তা পুনঃনির্মাণ করেন ডা. ফজলুল আমীন। নিজে স্বপ্ন দেখেছেন এবং অন্যকে দেখিয়েছেন একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। ১৯৭৬ সনের ১০ মার্চ তাঁর অকালপ্রয়াণ হলে তাঁরই উত্তরসূরীদের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় ডা. ফজলুল হাজেরা কলেজ, যা পরবর্তীতে ডিগ্রি কলেজে পরিণত হয়।
সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত না থেকেও চট্টগ্রামের দু’বরেণ্য রাজনীতিবিদ জহুর আহমদ চৌধুরী ও এম এ আজীজের স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। মুক্তিসংগ্রামে, ই পি আর মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে অর্থ আর চিকিৎসা দিয়ে সেবা করেছেন।
ডা. ফজলুল-আমীন আজ এ নশ্বর পৃথিবীতে না থাকলেও তাঁর প্রজ্ঞা, মহৎ স্বপ্ন আর অগ্রসর চিন্তাচেতনার জন্যই চিরকাল তিনি স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন।

মনোজ কুমার দেব সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রি কলেজ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট