চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

কমনওয়েলথ দিবস মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ও উন্নয়নে চাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা

খন রঞ্জন রায়

৯ মার্চ, ২০২০ | ৩:৩৭ পূর্বাহ্ণ

ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিন্তু বর্তমানে স্বাধীন দেশ, সাথে ব্রিটিশ আশ্রিত দেশসমূহ নিয়ে গঠিত যে সংস্থা বা সংগঠন তার নামই ‘কমনওয়েলথ’। এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা এখন ৫৪। এইসব স্বাধীন দেশের বিস্তার-বিস্তৃতি নিয়ে যে অবিভক্ত ‘সূর্য্য না ডোবা’ সা¤্রাজ্য ছিল সেটিই ছিল ব্রিটিশ সা¤্রাজ্য। স্বাধীন হয়ে যাওয়া কানাডার অন্টারিও ডুনডামে ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম মহারানী ভিক্টোরিয়ার জন্মদিন পালন করা হয়। পরের বছর পুরো কানাডাতে নিবিড়ভাবে পালিত হয়। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘লর্ডমিথ’ যুক্তরাজ্যে ‘অ্যাম্পায়ার ডে’ পালনের সূচনা ঘটান। শুরু হয় দিবস। পর্যায়ক্রমে স্বাধীন হয়ে যাওয়া ব্রিটিশ দেশসমূহে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন শুরু হয়। রাজ পরিবার, রাজকীয় শাসনতন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে এই দিবস পালন হতে থাকে প্রাসঙ্গিক। ব্রিটেনের রাজকীয় পরিবারের ঐতিহ্য, ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের কৃতিত্ব ইত্যাদির প্রশংসা ও প্রচারে দিবসটির কর্মসূচি দিন দিন জনপ্রিয় হতে থাকে।
সংকুচিত ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের পড়ন্ত অবস্থায় মহারানী ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতিতে এই দিবসের বৈচিত্রময় অনুষ্ঠান নানামাত্রিক বৈশিষ্ট্য বহন করতে থাকে। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘অ্যাম্পায়ার ডে’ নামটি বেমানান বলে প্রতীয়মান হওয়ার নতুন নামকরণ করা হয় ‘কমনওয়েলথ দিবস’। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে দিবস সংক্রান্ত প্রস্তাবনা নিয়ে বিষদ আলোচনা হয়। ঐ সম্মেলনেই সর্বসম্মতক্রমে মার্চ মাসের ২য় সোমবার কমনওয়েলথ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। বেশ জাকঁজমকের সাথে ভাবগাম্ভির্য নিয়ে নানা অনুষ্ঠানমালায় পালন হয় এই দিবস। বিশেষ করে কমনওয়েলথ সদস্য রাষ্ট্রসমূহের আন্তরিক নিষ্ঠা আবেগ আর সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করতে পালিত হয় এই দিবস।
লন্ডন ঘোষণার আলোকে ২৮ এপ্রিল ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে যাত্রা শুরু করা ‘কমনওয়েলথ অব নেশন্স’ এর সদর দপ্তর মার্লবোরো হাউস, লন্ডনে। ২ জুন ১৯৫৩ সাল থেকে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এর প্রধানের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে নিপুণভাবে পালন করে আসছেন। অবশ্য গঠনতান্ত্রিক কাঠামো মোতাবেক প্রধান নির্বাহী হলো সেক্রেটারি জেনারেল। সদস্য রাষ্ট্রসমূহের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রতি চার বছরের জন্য নির্ধারিত হয়। একব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদ এই দায়িত্ব পালনের সুযোগ রয়েছে। ১ এপ্রিল ২০১৬ সাল থেকে স্কটল্যা-ের বাসিন্দা ‘প্যাটিসিয়া’ কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব দৃঢ়তার সাথে পালন করে আসছেন।
সদস্যভুক্ত দেশের সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় পরামর্শ ও সহযোগিতার লক্ষ্য নিয়ে গঠিত এই সংস্থার ৭৫ বছরের দীর্ঘ সমৃদ্ধ সম্প্রীতির ইতিহাসে এই প্রথম কোন নারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করছেন। এই সংস্থার মৌলিক প্রতিনিধিত্বমূলক দায়িত্বের অংশ হিসেবে শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন হয়। আলোচনা হয় আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজা হয়। পরামর্শমূলক দিকনির্দেশনার ফিরিস্তি থাকে। দেশসমূহের সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় কারিগরী সহায়তা ভাগাভাগি করা হয়। ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের প্রয়োজনীয় স্বীকৃতি দিয়ে পারষ্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝোতা বৃদ্ধির নিয়ামক শক্তি হিসাবে ভূমিকা রাখে। এর বাইরেও সুনির্দিষ্ট কিছু আদর্শ উদ্দেশ্য নিয়ে কমনওয়েলথ সৃষ্টিশীল সৃজনশীল ভূমিকা পালন করছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করা এই সংস্থা আন্তর্জাতিক পরিম-লে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় বৃহৎ ভূমিকা রাখে।
দরিদ্রতা, অজ্ঞতা, রোগ-ব্যাধির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের লড়াইয়ে ‘কমনওয়েলথ’ প্রতিনিধিত্বমূলক অনুসন্ধিৎসু কার্যক্রম পরিচালনা করে। অবাধ ও মুক্তবাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে, বর্ণবৈষম্য-লিঙ্গবৈষম্য হ্রাস করতে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার বিকাশে সহায়তা, ব্যক্তি স্বাধীনতার সুরক্ষা নিশ্চিত ইত্যাদির মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে শ্রদ্ধাশীল সর্বাধিক গুরুত্ববাহী পরামর্শমূলক কাজ করে থাকে।
সারা বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী এই সংগঠন দেশে দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা বিষয়ে বাধ্যবাধকতার পরামর্শ ও কার্যকর করে থাকে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশসমূহের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থার ২০১২ সাল পর্যন্ত কোন লিখিত সংবিধান ছিল না। অথচ তাদের কার্য পরিধির বিস্তৃতিও কম ছিল না। পৃথিবীর মোট ভূমির এক চতুর্থাংশের বেশি মালিকানা নিয়ে গঠিত এই সংস্থার বৈশ্বিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে বেশি। ১৮ এপ্রিল ১৯৭২ সালে ৩২ তম সদস্য রাষ্ট্রের গর্বিত মর্যাদা নিয়ে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এরপর থেকে বাংলাদেশ কমনওয়েলথের আদর্শ উদ্দেশ্য সমুন্নত রাখতে, নেতৃত্ব বিকাশে, উন্নয়ন সহযোগী হতে নানাভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছে। উপকারভোগী, সুবিধাভোগী হিসাবেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কমনওয়েলথের সেবাকর্ম-সৃষ্টিকর্ম ও শিক্ষাকর্মের সহযোগী হয়েছে।
‘কমনওয়েলথ গেইমস’ সাড়া জাগানো একটি অধ্যায়। বাংলাদেশ বরাবরই এতে ভাল করছে। সবচেয়ে বেশী সুবিধা ভোগ করে শিক্ষাক্ষেত্রে। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলিতে একে অপরের জন্য শিক্ষাবৃত্তি চালু করেছে। মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থী ছাড়াও পেশাজীবীদের জন্য আলাদা ক্যাটাগরিতে সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান, পাবলিক সার্ভিস, বিভিন্ন স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের জন্য ¯œাতক, ¯œাতকোত্তর, পিএইচডিসহ সম্পূর্ণ বিনা খরচে। অনেক ক্ষেত্রে মাসিক ভাতা প্রাপ্তির সুযোগে এই বৃত্তি গ্রহণ করে আসছে।
স্বল্প, মধ্য, দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা কোর্স ছাড়াও আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক, সভা-সমাবেশ সম্মেলনে যোগদান সুযোগেও সমগ্র খরচভার বহন করে কমনওয়েলথ। প্রতি বছর আট শতাধিক শিক্ষার্থী নানা ক্ষেত্রে এই বৃত্তি পাওয়ার সুযোগ ভোগ করে থাকে। এখন পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ হাজার শিক্ষার্থী কমনওয়েলথ কমিশনের আওতাই সুবিধা সুযোগ ভোগ করে নিজকে সমৃদ্ধ করেছে। কমনওয়েলথ দাঁড়িয়েছে শক্তপোক্ত ভিতের উপর। আসুন আমরা মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ও উন্নয়নে, কমনওয়েলকে সর্বসম্মতভাবে নিঃস্বার্থ সর্মথন জানিয়ে দায়মুক্তির পথে অগ্রসর হই।

খন রঞ্জন রায় টেকসই উন্নয়নকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট