চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ইসলামে নারীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা

মুফতি আতিকুর রহমান

৮ মার্চ, ২০২০ | ২:১২ পূর্বাহ্ণ

মদিনা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে রাসুল (সা.) নারীর মতামত প্রদানকে আইনগত ভিত্তি দান করেন। তাঁর এ সুন্নাতের ওপর আমল করে খোলাফায়ে রাশেদিন তাঁদের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে নারীদের মতামতের গুরুত্ব নিশ্চিত করেন। রাসুল (সা.) পুরুষদের ন্যায় নারীদের থেকেও বিভিন্ন বিষয়ে অঙ্গীকার গ্রহণ করতেন।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী, যখন আপনার কাছে মুমিন নারীরা এই কথার ওপর অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার উদ্দেশ্যে উপস্থিত হয়- তারা শিরক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, নিজ সন্তানকে হত্যা করবে না, নিজের হাত ও পায়ের মধ্যখান থেকে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করবে না, শরিয়তের কোনো বিষয়ে অবাধ্যাচরণ করবে না, তখন আপনি তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করুন আর (তাদের ভুলভ্রান্তির জন্য) আল্লাহর কাছে মার্জনা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ বড় ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়াবান’- (সুরা মুমতাহিনা : ১২)। কেবল অঙ্গীকার গ্রহণই নয়; বরং কোনো বিষয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করা, কোনো বিষয়ে দাবি উপস্থাপন করা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা- এসবের পূর্ণ অধিকার ইসলাম নারীকে প্রদান করেছে। ইসলামের সোনালি যুগের নারীরা সে অধিকার প্রয়োগ করতে কসুরও করেননি। এমনকি স্বয়ং রাসুল (সা.)-এর সঙ্গেও নারীদের বাদানুবাদ করার ঘটনা কোরআনে উল্লেখ আছে।
শুধু তাই নয়; এই বাদানুবাদ বিষয়ে ‘মুজাদালাহ’ (তর্ক-বিতর্ক) নামে একটি সুরাও নাজিল করা হয়েছে। ঘটনাটি হলো, একবার হজরত আউস ইবনে সামেত (রা.) তাঁর স্ত্রী খাওলা (রা.)-কে বললেন, ‘তুমি আমার কাছে আমার মায়ের পিঠের মতো অর্থাৎ হারাম’। জাহেলি যুগে স্ত্রীকে এ ধরনের কথা বললে স্ত্রী চূড়ান্তভাবে তালাক হয়ে যেত। খাওলা (রা.) মহানবী (সা.)-এর দরবারে এসে এর সমাধান চাইলেন। আরবের প্রথা অনুযায়ীই রাসুল (সা.) তালাকের রায় দিলেন। খাওলা (রা.) বললেন, ‘আমার যৌবন যার কাছ নিঃশেষ করেছি, বার্ধক্যে সে আমার সঙ্গে এমন আচরণ করল! আমি কোথায় যাব? আমার বাচ্চাদের কী হবে?’ এ রায় হজরত খাওলা (রা.)-এর মনঃপূত না হওয়ায় তিনি আল্লাহর দরবারে এ অভিযোগ পেশ করেন। আল্লাহ এর মীমাংসা করে তাঁর বিধান নাজিল করেন। শরিয়তের পরিভাষায় তাকে ‘জিহারের বিধান’ নামে অভিহিত করা হয়। সুরায়ে মুজাদালায় বিধানটি উল্লেখ আছে। খলিফা থাকা অবস্থায় একবার হজরত ওমর (রা.) মদিনায় জনসাধারণের বিভিন্ন বিষয়ে অবগত হতে বের হলেন। এক ঘরে তিনি এক মহিলার স্বামীর বিরহগাঁথা শুনতে পেলেন।
তার স্বামী দীর্ঘদিন ঘরের বাইরে ছিল। বিষয়টি ওমর (রা)-কে বেদনাহত করে। তিনি ঘরে এসে উন্মুল মুমিনিন হজরত হাফসা (রা.)-এর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করে স্বামীদের ঘর থেকে দূরে থাকার সর্বোচ্চ সময় চার মাস নির্ধারণ করেন। অন্য একদিন মসজিদে খুতবা দানকালে ওমর (রা.) বেশি পরিমাণ দেনমোহর প্রদানে নিরুৎসাহিত করেন। তাঁর এ ভাষণ শুনে এক মহিলা প্রতিবাদ করে বলল, “আল্লাহ তো আমাদের দিয়েছেন আর আপনি কেড়ে নিচ্ছেন। আপনি কি জানেন না, আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের একেকজন স্ত্রীকে বিপুল পরিমাণে মোহরানা দিচ্ছ’- (সুরা নিসা : ২০)।” মহিলার এ কথা শুনে ওমর (রা.) সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বললেন, ‘একজন নারী সত্য বলেছে; ওমর ভুল করেছে।’ এটাই ইসলাম। এরাই মুসলিম নারী।
মুসলিম নারীর এই তেজোদীপ্ত প্রতিবাদী রূপ পরবর্তী যুগেও লক্ষ করা গেছে। বিখ্যাত সাহাবি আবদল্লাহ বিন জুবাইর (রা.)-কে হত্যার পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ হজরত আসমা (রা.)-এর কাছে অর্থাৎ হজরত আবু বকর (রা)-এর কন্যার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, তুমি তার পার্থিব জীবন নষ্ট করেছ, আর সে তোমার পরকালীন জীবন নষ্ট করেছে। রাসুল (সা.) বলেছিলেন সাকিফ গোত্রে একজন ঘাতক রয়েছে। ঘাতক হিসেবে তোকে ছাড়া আর কাউকে আমি দেখছি না।’
এরপর অত্যাচারী হাজ্জাজ মাথা নিচু করে এই প্রতিবাদী নারীর সামনে থেকে চলে যায়- (মুসলিম শরিফ)। বোঝাই যাচ্ছে, এসব ঘটনা ব্রিটেন ও ইংল্যান্ডে ১৮৯৭ সালে শুরু হওয়া নারীর মতামত দেওয়ার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের হাজারো বছর আগের!

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট