চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

৭ মার্চের ভাষণ ও বাংলাদেশের জন্ম প্রসঙ্গ

শাহিদা আক্তার জাহান

৭ মার্চ, ২০২০ | ৩:২১ পূর্বাহ্ণ

৭ মার্চ ১৯৭১ সাল। এ কোন ক্যালে ন্ডারে কালো হরফে লেখা সাধারণ তারিখ নয়। এ দিন ছিল বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের সকল অধ্যায় ও সকল অংকের এক মঞ্চায়ন। লক্ষ-লক্ষ জনতার ¯্রােতে পরিপূর্ণ ছিল রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। আর তখন এই রেসকোর্স ময়দানকে মনে হচ্ছিল একটি বাংলাদেশ। আগামীর বাংলাদেশ। শহর, নগর, বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ, সড়ক-মহাসড়ক, জনপথ, রাজপথ, সরু গলি’র, সবাই যেন এক মোহনায় মিলিত হয়ে জন্ম দিল বিশাল ইতিহাস। বাঙালির এমন মিলন হাজার বছরের ইতিহাসে আরেকটি আছে কিনা জানা নেই। সেদিন সকলের মনে এক চাওয়া, একটি স্বাধীন বাংলাদেশ। মুক্তি আর স্বাধীনতা। কণ্ঠে এক ধ্বনি ‘জয় বাংলা’। মার্চের রৌদ্রজ্জ্বল খরতাপে এ ব-দ্বীপের আবাল বৃদ্ধের রক্তেও চরম উত্তেজনা।

বাতাসেও ছিল কাল বৈশাখীর ঝড়-ঝাপটা। এই প্রচ- খরতাপে যে যেখান থেকে পেরেছে উপস্থিত থেকেছে। যারা দূরে ছিলেন তারাও অপেক্ষায় ছিলেন, কি হচ্ছে? নেতা আসবে। আমাদের নেতা আমাদের সামনে আসবে। এই নেতার সাথে বাঙালির আপামর জনসাধারণ একই কাতারে দাঁড়াল। একটি স্বাধীন বাংলার জন্যে সবাই মুখিয়ে ছিল। অনেককাল পর হলেও একটি সুন্দর বাংলার জন্যে অধীর অপেক্ষায় ছিল সর্বজন। অপেক্ষার প্রহর শেষ হল, যখন বাংলার অবিসংবাদিত ও অবিস্মরণীয় নেতা যিনি নিজে শুধু স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেন নি, সারা জাতিকে একই স্বপ্নে বিভোর করে তুলছেন। বাঙালি জাতির আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দু, জাতীয় স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। তিনি আর কেউ নন কালজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার মঞ্চারোহন ভঙ্গি যেন বাঙালির বহুদিনের লালিত স্বপ্ন। মেঘের কঠিন পর্দা সরে দেখা দিল স্বাধীনতার প্রথম সূর্য। এই বুঝি উদিত হচ্ছে এক নৈসর্গিক আবহ। সারা ময়দান তথা সারা বাংলা একসাথে অমিত তেজে গর্জে উঠল জয় বাংলা ধ্বনিতে। সেই থেকেই প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীনতা শব্দটা বাঙালির একান্তই নিজের হয়ে গেল। বুকে সঞ্চারিত দ্রোহের অনির্বাণ শক্তি ধারণ করে রেসকোর্সের সবুজ গালিচায় বসে ছিল এই উৎসুক জনতা। আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুনছিল নেতার নির্দেশের জন্য। চারপাশের রক্ত চক্ষুর সামরিক-বেসামরিক মরণাস্ত্র উঁচানো পাহারা, উপরে সামরিক হেলিকপ্টার-র চক্কর। যেন ভীতি প্রদর্শনের সামরিক মহড়া। তাতে এতটুকু বিচলিত ছিল না, শঙ্কিত ছিল না জনতা কিম্বা নেতা কেউ। শঙ্কাহীন চিত্তে বজ্রকন্ঠে ঘোষণা দিলেন, ‘লক্ষ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবি জানেন এবং বোঝেন।’ ভাষণে তিনি বলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’

বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অনন্য দিন ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। সুদীর্ঘকালের আপোসহীন আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৭১ সালের এই দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে এই মহান নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

আমাদের গন্তব্যে পোঁছার সকল পথ ও করণীয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিলেন মহান এই নেতা। বুঝিয়ে দিলেন রক্তের দামে কিনতে হবে স্বাধীনতা। চুড়ান্ত ত্যাগের জন্য জাতিকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করলেন। চুড়ান্ত ত্যাগ না থাকলে মুক্তি যে সম্ভব নয় তাও বুঝিয়ে দিলেন। পুরো বক্তৃতা যেন এক মহাকাব্য। সারা জাতি একাগ্র চিত্তে গভীর আগ্রহ ও মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করল। আর মানসিকতায় একেকজন যুদ্ধাংদেহী নিখাদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সৈনিকে রূপান্তরিত হল। একটি মাত্র বক্তৃতা, যা পুরো জাতিকে সম্পূর্ণ খোলস থেকে বের করে বীরবেশে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ করালো। আর দীর্ঘ ৯ মাস পর এলো কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। জন্ম নিলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এখন আমাদের সবার প্রধান দায়িত্ব হবে জাতির জনকের স্বপ্নের আদলে বাংলাদেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলায় পরিণত করা।

শাহিদা আক্তার জাহান সদস্য, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট