চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাঙালি, বঙ্গবন্ধু এবং মার্চ মাস

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি

৪ মার্চ, ২০২০ | ১:৪৩ পূর্বাহ্ণ

পতাকা উত্তোলন করা হয় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসভবনের সামনে। ২ মার্চ ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ৩ মার্চের ইয়াহিয়ার আলোচনা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সারাদেশে পূর্ণদিবস হরতাল পালিত হয়। ৩ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শপথ নেন। ২ ও ৩ মার্চের হরতালের ফলে সকল সরকারি কর্মকা- অচল হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গ্রহণ করে। সভায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা ও কর্মসূচি শীর্ষক একটি ইশতেহার প্রচার করা হয়। ইশতেহারের লক্ষ্যগুলোর অন্যতম ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি সৃষ্টি করা। বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করা।

ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’- ঠিক করা হয়। সভায় স্লোগান দেয়া হয়, ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ-দীর্ঘজীবী হোক। ‘স্বাধীন কর স্বাধীন কর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ স্বাধীন বাংলার মহান নেতা- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।’ ‘গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়- মুক্তিবাহিনী গঠন করো।’ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ মুক্তি যদি পেতে চাও- বাঙালিরা এক হও।’ জাতীয়তাবাদী এই স্লোগানগুলো প্রতিটি বাঙালির চেতনায় স্বাধীনতার তীব্র তাড়ণার সৃষ্টি করে।
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ৪ দিনব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালনের আহ্বান জানানো হয়। সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন তিনি। ৪ মার্চ সারাদেশে প্রায় একশত জন নিহত ও কয়েক শত আহতের তথ্য প্রকাশ করেন তিনি। ৫ মার্চ সামরিক বাহিনীর গুলিতে তিনশত নিহত এবং দুই হাজার আহত হওয়ার তথ্য প্রকাশ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ৬ মার্চ ইয়াহিয়া কর্তৃক ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়। ঘরের ছাদে ঘৃণা ও প্রতিবাদের ভাষা কাল পতাকা উত্তোলন করা হয়। এভাবেই আসে ৭ মার্চ।

৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে ১০ লাখ জনতার জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ১৯ মিনিটের ভাষণে তিনি ২৩ বছরের পাকিস্তানি শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরেন। তিনি স্বাধীনতার সার্বিক দিকনির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ জনতাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব -এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ উত্তাল জনসমুদ্রে তিনি ঘোষণা করেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
৮ মার্চ দেশব্যাপী সহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। কালো পতাকা উত্তোলন ও সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। গেরিলা যুদ্ধের প্রচারপত্র বিলি করা হয়। সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করা হয়। টিক্কা খানের শপথে বিচারপতিরা অস্বীকৃতি জানায়।
৯ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অফিসারদের পরিবারবর্গকে করাচিতে পাঠানোর হিড়িক পড়ে যায়। লে. জেনারেল টিক্কা খানকে বাংলাদেশের গভর্নর নিযুক্ত করা হয় এই দিনে। ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করা হয়। ১০ মার্চ টিক্কা খানকে বাংলাদেশের সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলকে বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি দেয়ার জন্য ১১ মার্চ মুজিব আহ্বান জানান। চট্টগ্রাম শহরে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা শুরু হয়। এতে অনেকে হতাহত হয়।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ দৃশ্যত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং নির্দেশে বাংলাদেশের অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, স্কুল কলেজ, শিল্প কারখানা, চলতে থাকে। ১২ মার্চ ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনায় বসতে রাজি হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন, ‘আমার জনগণ স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশ বাস করতে চায়।’
এই দিনে মার্শাল আজগর খানের বিবৃতি, ‘বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর দপ্তর ছাড়া কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখা যায়নি।’ ১৩ মার্চ মুজিবের ঘোষণা, ইয়াহিয়া ঢাকায় এলে তার সঙ্গে আলোচনায় তিনি রাজি। ১৪ মার্চ বাঙালির স্বাধীন নাগরিক অধিকার না পাওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শেখ মুজিব। ১৫ মার্চ শেখ মুজিব কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ। কাজ-কর্ম পরিচালনার জন্য ৩৫ টি বিধি জারি করা হয় এই দিনে। ইয়াহিয়া ২৩ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবার ঘোষণা দেন। ১৬ মার্চ শেখ মুজিবের সাথে ইয়াহিয়ার আড়াই ঘন্টা ব্যাপী প্রথম দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। চীন থেকে আমদানিকৃত সরঞ্জামবাহী একটি জাহাজ থেকে মাল খালাস করতে বন্দরকর্মীরা অস্বীকৃতি জানায়। ১৭ মার্চ এক ঘণ্টাব্যাপী মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা হয়। ১৮ মার্চ বাংলাদেশের মানুষকে যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে আহ্বান জানান শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯ মার্চ ইয়াহিয়ার সঙ্গে মুজিবের ৯০ মিনিট আলোচনা হয়। ২০ মার্চ উপদেষ্টাসহ ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা হয়। ২১ মার্চ ইয়াহিয়ার সাথে মুজিবের ৭০ মিনিটের অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২২ মার্চ ৭৫ মিনিট ধরে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক চলে।

এভাবেই স্বাধীনতার খুব কাছাকাছি চলে আসে বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে ‘বাংলার স্বাধিকার’ শীর্ষক ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। ২৩ মার্চের পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে প্রতিরোধ দিবস পালন করে ছাত্রজনতা। পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়।কুচকাওয়াজে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানের মাধ্যমে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। চীনা দূতাবাস ভবনশীর্ষ থেকে ছাত্রলীগ কর্তৃক পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। চীনা দূতাবাস ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখা যায়নি সেদিন। ২৫ মার্চ সামরিক বাহিনীর গুলিতে কমপক্ষে ১১০ জন নিহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র খালাস করতে বাধা প্রদানকারী জনতার উপর সেনাবাহিনী গুলি চালায়। প্রচুর হতাহত হয়।
শেখ মুজিব কর্তৃক ২৭ মার্চ সারাদেশে হরতাল আহ্বান করা হয়। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে ঘুমন্ত নরনারীর উপর ইয়াহিয়ার বাহিনীর বর্বর হামলা পরিচালনা করে। নির্বিচারে পৃথিবীর জঘন্যতম গণহত্যা সংঘটিত হয় এই রাতে। ইয়াহিয়া -ভুট্টো গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যার বাংলা রূপ, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছো এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার শত্রু বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে এদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’
বঙ্গবন্ধুর বার্তা ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পাঠিয়ে দেয়া হয় চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি সৈনিক ও অফিসার দের মাঝে। তারা সম্ভাব্য প্রতিরোধ গড়ে তুলে। ২৬ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে।

২৬ মার্চ দুপুরের পর চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রচার করেন। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরে এই ঐতিহাসিক মার্চ মাস আবার ফিরে এসেছে। বাঙালির অহংকারে ভরা, অর্জনে ভরা, রক্তবেদনায় ভরা, অশ্রু আর অনুভূতিতে ভরা বিসর্জনে ভরা মার্চ মাস। অহংকারের মাস। স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের মাস। আজকের এই মাসে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মা কে। তিন লাখ সম্ভ্রম হারা মা বোনকে, জায়া জননী কে। (সমাপ্ত)

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, কর্ণফুলী গবেষক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট