চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

দিল্লিতে নজিরবিহীন সহিংসতা দ্রুত শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক

২ মার্চ, ২০২০ | ২:৫৯ পূর্বাহ্ণ

বিতর্কিত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে কয়েকদিন ধরে যে নজিরবিহীন সহিংসতা চলছে তা খুবই দুঃখজনক ও অনাকাক্সিক্ষত। ভারতে গত কয়েক দশকে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সংঘাতের চেয়ে এ ঘটনা কয়েক গুণ ভয়ানক ও উদ্বেগজনক। গণমাধ্যমে দাঙ্গার যে চিত্র উঠে আসছে তাতে এটাই স্পষ্ট হচ্ছে যে এই সহিংসতা ভারতের হিংসার রাজনীতিরই মহাবিস্ফোরণ। ভারতের মতো একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশে এমন ঘটনা অত্যন্ত পরিতাপের। সন্দেহ নেই, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও হিংসার রাজনীতির জেরে সৃষ্ট এ ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা ভারতের জন্যে অশুভ ফলই বয়ে আনবে। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনাগুলো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে প্রতিবেশী দেশগুলোতেও। বিষয়টি একই সঙ্গে উদ্বেগ এবং আতঙ্কের।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত ‘ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্র ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সহিংসতায় মারা গেছে ৪২ জন, আহত হয়েছে কয়েকশ’। হতাহতদের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও আছে। মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে অগ্নি সংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল পরিস্থিতিকে ‘ভয়ানক’ বলে বর্ণনা করে দাঙ্গা কবলিত এলাকাগুলোতে আশু সেনাবাহিনী মোতায়েন ও কারফিউ জারি করার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু তার অনুরোধ উপেক্ষিত হয়েছে। তবে সেনাবাহিনীকে সতর্কভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং কিছু কিছু স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী এখনও দিল্লির পরিস্থিতি উদ্বেগজনক রয়ে গেছে। দিল্লির সহিংসতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, দেশটির বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের পক্ষ ও বিপক্ষ গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের সূচনা হয়েছিল রবিবার। পরে তা সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোতে এমন সহিংসতাকে ‘কমিউনাল ভায়োলেন্স’ বা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। দাঙ্গার নানা পৈশাচিক ছবি ও ভিডিওচিত্রতে সয়লাব হয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়া। এসব ছবিতে দেখা গেছে, মুসলিমদের বাড়িঘর আগুনে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। লাঠিসোটা নিয়ে ভাংচুর চালাচ্ছে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠাননে। মসজিদে মসজিদে আগুন লাগিয়ে মিনারে টানাচ্ছে হনুমান পতাকা। মুসলিমদের ঘর থেকে টেনে রাস্তায় বের করে এনে বেদম পেটানো হচ্ছে। এ অবস্থায়ও উসকানি দিয়ে যাচ্ছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে! পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলেছেন, তারা এই দাঙ্গার মধ্যে ২০০২ খ্রিস্টাব্দে ঘটে যাওয়া গুজরাটের দাঙ্গার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দুই দিনের ভারত সফরকালে সিএএর সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে তুঙ্গে ওঠা ওই সংঘর্ষ নিয়ে গত কয়েক দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মৌন থাকলেও তিনি বৃহস্পতিবার টুইটারে বিবৃতি দিয়ে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে দিল্লিতে শান্তি ফেরানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি উত্তরপূর্ব দিল্লির সহিংসতাকবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করে ‘সরকার শান্তি ফিরিয়ে আনবে’, ব্যক্তিগতভাবে এমন আশ্বাস দিলেও বাস্তবিকপক্ষে শান্তি ফিরে আসেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে একের পর এক রিভিউ মিটিং করে গেলেও দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থতার জন্য পুলিশকে তিরস্কার করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। এ ছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষুব্ধ দিল্লি হাইকোর্ট পুলিশকে ঘৃণা ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে বলেছে। চার বিজেপি নেতার বক্ততৃার ভিডিও দেখার পর আদালত এমন নির্দেশনা দিয়েছে। কংগ্রেস নেত্রী বলেছেন, ‘এই সংঘর্ষের পেছনে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র রয়েছে। অনেক বিজেপি নেতা উসকানিমূলক মন্তব্য করে ভয় ও হিংসার পরিবেশ তৈরি করেছেন।’

বলার অপেক্ষা রাখে না, মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে একের পর এক মুসলিমবিদ্বেষী তৎপরতা শুরু হয়। ভারতের ইতিহাস গ্রন্থগুলোতেও আনা হয় আমূল পরিবর্তন। ৭০০ বছরের মুসলিম শাসনামলকে অত্যাচারী দখলদারি শক্তি হিসেবে দেখানো হয়। মুসলিম বীরদের হেয় করা হয়। মুসলিম শাসনামলের স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন স্থানের নাম পরিবর্তন করে সেগুলোকে বৈদিক যুগের নামে নামকরণ করা হয়। গোহত্যার মিথ্যা অভিযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে হতদরিদ্র মুসলমানদের ওপর হিং¯্র আক্রমণ চালানো হয়, যার ধারণ করা ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু বারবার এ রকম নৃশংস ঘটনা ঘটলেও এসব হত্যাকা-ের ফলে কারও শাস্তি হওয়ার নজির নেই। উপরন্তু দলের নেতারা শুরু থেকেই ঘৃণা ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। এনআরসি ও সিএএ’র পর বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করে। এখন মূলত হিংসার রাজনীতি চর্চারই বিস্ফোরণ ঘটেছে। কিন্তু এমন চিত্র ভারতের জন্যে কোনো শুভ ফল বয়ে আনবে না। জাতিগত বিভাজন দেশটিকে অন্ধকার গহ্বরে নিক্ষেপ করবে। শুধু তাই নয়, ভারতের এমন হিংসাত্মক পরিস্থিতিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি ও উন্নয়ন বিঘিœত হবে। পাশর্^বর্তী দেশগুলোতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও অমূলক নয়। সবদিক বিবেচনায় দেশটির উচিত হবে কঠোর হস্তে সহিংসতার অবসান ঘটিয়ে দ্রুত শান্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে মনোযোগী হওয়া। আমাদের দেশে যাতে ভারতের উত্তপ্ত ঘটনার আঁচ না লাগতে পারে তার জন্যও সরকারসহ সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট